সময়টা ১৯৪৫ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের মুখে। সোভিয়েতের কব্জায় বার্লিন। শেষরক্ষায় ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করলেন হিটলার।
ক্ষয়ক্ষতি বা যুদ্ধাপরাধ কম-বেশি সব যুদ্ধেই হয়েই থাকে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপে যেভাবে লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল জার্মান নাৎসি বাহিনী, তাতে তার বিচার কিভাবে হবে সে নিয়ে রীতিমতো ধন্ধে পরে যায় মিত্রশক্তি। মিত্রশক্তি প্রথমে জার্মান আদালতকে প্রায় ৯০০ জন নাৎসি নেতার বিচারের নির্দেশ দেয়। কিন্তু অভ্যন্তরীণ বিবাদের জন্য বিচার হয় মাত্র ১২ জনের। এর মধ্যে ৬ জনকে আবার দাঙ্গাবাজরা জেল থেকে বের করে নিয়ে যায়। যেহেতু তখনও অবধি কোন আন্তর্জাতিক আদালত তৈরী হয়নি, তাই কোন আদালতে অক্ষশক্তির যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে সে নিয়েও মিত্রশক্তির মধ্যে স্পষ্ট বিভেদ দেখা দেয়।
তেহরানে মিত্রশক্তির নেতাদের এক নৈশভোজে স্তালিন অনেকটা কৌতুক করেই প্রস্তাব করেন প্রথম সারির ৫ হাজার নাৎসিকে গুলি করা যেতে পারে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টও সে প্রস্তাবে মৌখিক সায় দিলেও সায় ছিলনা ব্রিটেনের। রুজভেল্ট মারা যাওয়ার পর যখন হ্যারি ট্রুম্যান ক্ষমতায় আসেন তখন একটা ট্রাইবুনালের ভিত্তি তৈরি করার উদ্দ্যেশ্য নিয়ে সোভিয়েত, ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের প্রতিনিধিরা যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করেন।
তবে এবার সমস্যা দেখা দিল বিচারব্যবস্থা নিয়ে। ৪ দেশের মধ্যে ২ রকম আইনব্যবস্থা ছিল। একধরনের বিচারব্যবস্থায় বিচারক নিজেও সক্রিয় তদন্তকর্তার ভুমিকা পালন করবেন। আরেকটিতে হবে প্রথাগত বিচার, দুই পক্ষের আইনজীবীরা প্রমাণ উপস্থাপন করবেন। সব বিবেচনা করে রায় দেবে আদালত। শেষমেশ দুই আইনব্যবস্থার সমন্বয়ে বিচারকাজ চালানোর সিদ্ধান্ত হল।
শুরু হল বিচারকাজের জন্য আদর্শ স্থান খোঁজার কাজ। স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে বার্লিনের নাম। জার্মানিকে তখন নিয়ন্ত্রণ করছে মিত্রশক্তির চার দেশ। সোভিয়েতের আওতায় থাকা নুরেমবার্গের কারাগার আর তার পাশের একটি ভবন পছন্দ হয় সবার। নুরেমবার্গের এই ভবনে হয়েছিল বিচারকাজ।
চার রাষ্ট্র লন্ডনে বিচারব্যবস্থার দলিলে সাক্ষর করে। ট্রাইবুনালের নীতি, অভিযোগের ধরণ সবেরই উল্লেখ ছিল দলিলে। ৪ ধরনের অভিযোগের জন্য কোনো অপরাধীকে অভিযুক্ত করা যেত।
১. চক্রান্ত: একজন পেশাদার খুনিকে বন্দুক ভাড়া দেওয়াটা চক্রান্ত বা ষড়যন্ত্রের আওতায় অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। আদেশ পালনের দোহাই দিয়ে কোন সৈনিক যাতে অপরাধীর তকমা থেকে যেন বাঁচতে না পারে সেজন্য এ ধরনের অভিযোগের ব্যবস্থা রাখা হয়।
২. আক্রমণাত্মক যুদ্ধ: বিনা উস্কানিতে এবং চুক্তি ভঙ্গ করে আগ্রাসন।
৩. যুদ্ধাপরাধ: যুদ্ধের প্রচলিত প্রথার খেলাপ। যেমন আত্মসমর্পণ করলে শত্রুকে হত্যা করা যাবে না অথবা অসামরিকদের হত্যা বা তাদের সম্পদের ক্ষতি করা যাবে না।
৪. মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ: যুদ্ধের আগে, পরে এবং যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে লোকজনকে বিনা কারণে হত্যা, ধর্ষণ, দাস হিসেবে ব্যাবহার করা, স্থানচ্যূত করা এবং ধর্ম বা জাতিভেদে বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর উপর আক্রমণ করা।
চার দেশ থেকেই বিচারক এবং প্রসিকিউটর নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রধান বিচারপতি ছিলেন ব্রিটেনের গাফারি লরেন্স। তবে জার্মান কোনো বিচারপতি ছিল না সেখানে। বিচারকাজ যেখানে হয়েছিল, নুরেমবার্গের সেই ভবনের নাম দেওয়া হয় ‘প্যালেস অব জাস্টিস’।
চার ধরনের অপরাধের তদন্তের কাজ চার দেশ ভাগ করে নিয়ে অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করে। একে তো নাৎসি প্রশাসন কীভাবে কাজ করত এটা নিয়েই বেশ ধোঁয়াশা ছিল। তার উপর হিটলার, গোয়েবলস, হিমলারের মতো প্রথম সারির অনেক নেতা তখন মৃত।
প্রথমদিকে হিটলারের নামও ছিল অভিযুক্তের তালিকায়। কারণ হিটলারের মৃত্যু নিয়ে ধোঁয়াশা ছিল। অক্টোবরে প্রথম ২৪ জন অভিযুক্তের নাম প্রকাশ করা হয়। দেখা গেল তালিকায় পক্ষ পরিবর্তন করা লোক এমনকি ১৯৪১ সাল থেকে বিছানায় পড়ে থাকা ব্যক্তির নামও আছে। শেষ পর্যন্ত আবার যাচাই বাছাই করে ২৪ জনের (২ জন পলাতক) বিচার শুরু হয়। এরা ছাড়াও ৭ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্ত এবং বিচার হয়েছিল।
উল্লেখ্য মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধেও যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ আদালতে উপস্থাপন করা হয় কিন্তু আদালত সেটা গ্রহণ করেনি।
নুরেমবার্গের বিচারে ১২ জনকে ফাঁসিতে ঝোলানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। এর মধ্যে ১ জন পলাতক ছিলেন। বাকি ১১ জনকে একই দিনে ফাঁসি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ঠিক কি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন এই ১১ জন, আসুন দেখে নেওয়া যাক।
হারমান গোয়েরিং
১৯৩৪ সালে গেস্টাপো বাহিনী ৮৫ জন রাজনীতিবিদকে হত্যা করে। আর তার নেতৃত্বে ছিলেন এই গোয়েরিং। পরের বছর তিনি জার্মান বিমান বাহিনীর প্রধান হন। ১৯৩৯ সালে হিটলার তাঁকে নিজের উত্তরাধিকারী বলে ঘোষণা করেন। ইহুদীদের তাড়ানো থেকে হত্যা করা এবং তাদের সম্পত্তির দখল নেওয়া এ সবই ছিল তাঁর পরিকল্পনা। নাৎসিদের ৪ বছর মেয়াদি পরিকল্পনার পরিচালক ছিলেন তিনি। জার্মান বিমান আগ্রাসনের সব পরিকল্পনাও ছিল তাঁর। ১৯৪০ সালে হিটলার তাকে ‘রাইখমার্শাল’ পদে উন্নীত করেন (জার্মান পার্লামেন্টের প্রেসিডেন্টের দাপ্তরিক নাম রাইখমার্শাল)। আত্মসমর্পণের পরেও হল্যান্ডের রটারড্যাম শহর ধ্বংস, পোলিশ বুদ্ধিজীবী হত্যা, যুদ্ধবন্ধীদের হত্যা এবং ফ্রান্সের জাদুঘর লুট করার অভিযোগ আনা হয় তাঁর বিরুদ্ধে।
১৬ অক্টোবর রাতের প্রথম প্রহরে ফাঁসি কার্যকর হবে এটা দণ্ডপ্রাপ্ত বেশিরভাগ আসামী জেনে যায়। রাত ১টা ৪৫। কারাগারের কক্ষের মধ্যেই সায়নাইড নিয়ে আত্মহত্যা করে গোয়েরিং।
জোয়াকিম ভন রিবেনট্রপ
ব্যবসায়ী হিসেবে দুনিয়া ঘুরে বেড়াতেন। ১৯৩২ সালে প্রথম হিটলারের নজরে আসেন তিনি। ১৯৩৩ সালে তাঁর বাড়িতেই এক গোপন বৈঠকে হিটলারকে জার্মান চ্যান্সেলর হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। তিনি পরে জার্মান বিদেশমন্ত্রী হন। ইতালিকে অক্ষশক্তিতে আনা ছিল তাঁর কূটনৈতিক সাফল্য। অস্ট্রিয়া, পোল্যান্ড, যুগোস্লাভিয়া আক্রমণের পরিকল্পনায় ছিলেন তিনি। ইহুদী হত্যায় তাঁর সমর্থন ছিল। বিচারে তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন এবং বলেন তিনি হিটলারের আদেশ পালন করে গেছেন মাত্র। সর্বপ্রথম ফাঁসি হয় রিবেনট্রপের।
ফিল্ড মার্শাল উইলহেম কেইটেল
তিনিই প্রথম সামরিক কর্মকর্তা যার ফাঁসি কার্যকর হয় নতুন আন্তর্জাতিক আইনে। ‘রাজনীতিবিদরা যুদ্ধ বাঁধাতে বলেছে, পেশাদার সৈনিক হুমুক পালন করেছে’ এই যুক্তি যেন ভবিষ্যতে না খাটে, তাই এই আইন তৈরী হয় নুরেমবার্গের বিচারের প্রাক্কালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর দিকের সব অপারেশনের প্রাথমিক পরিকল্পনা তিনি করেছিলেন। ফ্রান্স দখলের পর হিটলার তাঁকে ফিল্ড মার্শালের পদে উন্নীত করেন। জার্মান জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে যেকোন ব্যক্তিকে গ্রেফতারের জন্য তিনি একটি আইন প্রণয়ন করেন। নামমাত্র কোর্ট মার্শালে তাদের ফাঁসি দেওয়া হত।
আর্নেস্ট কালটেন ব্রুনার
ড. ব্রুনার ছিলেন রাইখের কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা কার্যালয়ের প্রধান। হিটলারের গোপন বাহিনী ‘এসএস’ এর যেসব কর্মকর্তাদের আদালতে হাজির করা হয়েছিল তাঁদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবচাইতে উর্ধতন। কনসেনস্ট্রেশন ক্যাম্পে ইহুদীদের পোড়ানো, শ্রমিক হিসেবে বন্দিদের কাজে লাগানো এবং দুর্বলদের হত্যা করার অভিযোগ ছিল তাঁর বিরুদ্ধে। কর্তব্য পালনের দোহাই দিয়ে তিনিও নিজেকে নির্দোষ বলার চেষ্টা করেন ফাঁসির মঞ্চে।
আলফ্রেড রোজেনবার্গ
পূর্ব ইউরোপে দখল করা অঞ্চলের মন্ত্রী হিসেবে তাঁকে নিযুক্ত করা হয়। দখল করা এলাকায় আগের সকল আইন বাতিল করে জোর-জবরদস্তিমূলক নতুন আইনের প্রণেতা ছিলেন তিনি। ৪০ হাজার আটক যুবককে শ্রমিক হিসেবে থাকতে বাধ্য করেছিলেন। ইহুদীদের সম্পত্তি দখল করাও তাঁর নির্দেশে হয়েছিল।