গল্প থেকে জীবনে আর জীবন থেকে গল্পে যাতায়াত চলতেই থাকে। এই তো পরকীয়া নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের কদিন আগেই অন্য পুরুষের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক রাখার অভিযোগে বাড়ি থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে এই মুহূর্তে সম্ভবত জনপ্রিয়তম বাংলা টিভি সিরিয়ালের নায়িকা। রায় বেরনোর পরেও তার লাঞ্ছনা শেষ হয়নি। খবরের কাগজে দেখলাম রায় বেরনোর আগে পরকীয়ার জেরে ত্রিপুরায় মৃত্যু হয়েছে এক মহিলার। তবুও আমার মনে হয়, সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের ৪৯৭ধারা বাতিল করার যে আদেশ দিয়েছে তা আমাদের চারপাশে আকছার ঘটে চলা নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে একটা বর্ম হিসেবে কাজ করবে।
তিন তালাক নিষিদ্ধ করার রায় আমাদের বুকের ওপর থেকে একটা ভারি পাথর নামিয়ে দিয়েছিল। তারপর থেকে পরপর চারটে ওভার বাউন্ডারি মারল সুপ্রিম কোর্ট। সমকামিতা অপরাধ নয়, পরকীয়া অপরাধ নয়, আধার কার্ড বাধ্যতামূলক নয়, শবরীমালা মন্দিরে ঋতুমতীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ নয়। এই চারটে রায় মহিলাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে, সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে ভারতকে অনেক দূর এগিয়ে দিল। আমার মনে হয়, এই রায় ভারতকে ইউরোপ, ব্রাজিল, চিন, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার আইনি সুরক্ষার সঙ্গে এক সারিতে তুলে দিল। ভালো খেলোয়াড়দের কাছ থেকে দর্শক যেমন প্রতিটি ওভারেই চার, ছয়ের ফুলঝুরি দেখতে চান ঠিক তেমনি আমরা অযোধ্যা রাম জন্মভূমি মামলা, বিচারক লোয়ার মৃত্যু রহস্য মামলা, পাঁচ বুদ্ধিজীবীকে গ্রেপ্তার নিয়ে মামলার রায়ের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি আমরা।
আইন মানুষকে একটা প্রতিরোধ ক্ষমতা দেয়, কিন্তু তা মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টায় না। মেয়েদের প্রতি আমাদের বৈষম্যের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয় পরিবার থেকেই। আমার মনে পড়ছে ছোটবেলার কথা। গ্রামের বাড়িতে দেখতাম বাবা বাড়িতে ঢুকেই ‘শুনছো’ বলে মাকে হাঁক পারতো। তারপরেই ফাটা রেকর্ডের মত শুরু হয়ে যেত একের পর এক অর্ডার – জল দাও, চা দাও, লুঙ্গি কই? এক সেকেন্ড দেরি হলেই বাবার চিৎকার শুরু হয়ে যেত। মা হয়তো সেসময় ধান সেদ্ধ বা কাপড় কাচার মত অন্য কোন কাজ করছে তবুও তার নিস্তার নেই। অথচ বাবার সামনেই জলের কুঁজো, পাশেই গ্লাস তবুও বাবা জলটি গড়িয়ে খাবেনা।
আমাদের সংসারে মেয়েদের ভূমিকাটা এমনই। সেখানে তারা যেন স্রেফ পুরুষের সম্পত্তি, তাদের অভিধানে অধিকার, স্বাধীনতা এসব কথার কোন অস্তিত্বই নেই। পরকীয়া সংক্রান্ত আইনটিকে দেখতে হবে এই পটভূমিতেই। বিচারপতিরা ৪৯৭ধারা বাতিল করেছেন, কারণ, তা স্ত্রীকে স্বামীর সম্পত্তি বলে ধরে নিয়েছিল। তাদের মতে স্বামী কখনই তার স্ত্রীর মালিক নন, স্বামীর অনুমতি ছাড়া স্ত্রী পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করলে তা অবৈধ বলা যাবে না। তারা বলেছেন, স্বামী, স্ত্রী দুজনেরই অধিকার সমান। কেউ কারোর ওপর কোন বক্তব্য চাপিয়ে দিতে পারেন না। ১৮৬০সালের এই আইনি ধারণা আজকের দিনে সত্যিই অচল।
স্যোশাল মিডিয়া ও গণমাধ্যমে ইদানিং এক শ্রেণির মূর্খ লুম্পেনের আমদানি হয়েছে। নারী কথাটা শুনলেই তারা মনে যা আসে তা বলতে শুরু করেন। এরা পরকীয়া অবৈধ নয় কথাটাকে অবাধ যৌনতার ছাড়পত্র বলে ধরে নিচ্ছেন। ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। বস্তুত এটাই একটা মেল গেজ, পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারটাকে দেখা। আমাদের অনেকের মনের গভীরে এই ভাবনা ফেসবুক আর ইন্সটাগ্রামের স্টেটাসে অবাধ যৌনতা নিয়ে আপাত স্মার্ট মন্তব্যের আড়ালে ছবি ও কার্টুনসহ স্রেফ ছ্যাবলামি করছেন। অথচ বিষয়টার সঙ্গে রগরগে গালগল্প, যৌন কেচ্ছার কোন সম্পর্ক নেই। আদতে চলতি আইনে ‘স্বামীর অনুমতি’ বলে যে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিটি ছিল সেটাকেই সংশোধন করেছেন সুপ্রিম কোর্ট।
এই অনুমতি ব্যাপারটাকে ঘিরেই তৈরি হত যাবতীয় জটিলতা। বাড়ির বউ রাস্তায় বেরলে স্বামীর অনুমতি নিতে হবে, পরপুরুষের সঙ্গে কথা বললে খেতে হবে স্বামীর ধমক, এমনকি বাড়ির ছাদে বা বারান্দায় তার ইচ্ছেমত যাওয়া বারণ। গেলে তার পরপুরুষের প্রতি ‘ছোঁকছোকানি’ আছে বলে ধরে নেওয়া হয়। দৈহিক মিলনের ব্যাপারেও তার নিজের কোন ইচ্ছে বা অনিচ্ছা নেই। স্বামীর আজ্ঞা মত তাকে বিছানায় ডিউটি দিতে হবে। উল্টোটা কিন্তু কখনই ঘটে না। পাড়ার কোন মানুষের সঙ্গে হেসে কথা বলার অপরাধে যে স্বামী তার বউকে ধমক দিচ্ছেন তিনিই কিন্তু মনের আনন্দে বাড়ির পরিচারিকা থেকে শুরু করে পিসতুতো, মাসতুতো, মামাতো বোন অবধি সবার সঙ্গে দৈহিক সম্পর্কে লিপ্ত হচ্ছেন। তবু তাকে কিছু বলা যাবে না, তার যেন এসব কিছু করার একটা হক রয়েছে। আমাদেরই অনেক বন্ধুর বাড়িতে বিবাহবার্ষিকীর নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে দেখেছি সেই অনুষ্ঠানে তার স্ত্রীর কোন বয়ফ্রেন্ড আসেনি। তার যেন কোন পুরুষ বন্ধু থাকতে পারেনা। নতুন আইন মান্ধাতা আমলের নারীপুরুষের মেলামেশার একপেশে ভাবনাটাকে বাতিল করে মানুষের সুস্থ স্বাভাবিক প্রবণতাকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
নিজের মাকে দেখেই বুঝেছি সংসারে নারীর ভুমিকা ও দায়িত্ব দুটোই অনেক বেশি। কিন্তু স্বীকৃতি বস্তুত শূন্য। তিনি স্বামী থেকে শাশুড়ি সবারই ইচ্ছায় চলেন, কিন্তু তার ইচ্ছায় কিছুই হয়না। আমরা যারা স্ত্রীর পরকীয়া নিয়ে মাথা ঘামাই তারা কী কেউ জোর দিয়ে বলতে পারবো আমাদের নিজেদের কোন তেমন সম্পর্ক নেই বা ছিল না? আজকের প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এসব ব্যাপারে অনেক উদার ও খোলামেলা। ছেলেদের বাড়িতে মেয়েবন্ধুরা আসে, মেয়েদের বাড়িতে ছেলেবন্ধুরা যায়। বিয়ের আগে ও পরে মেলামেশায় কোন হেরফের হয়না। অনেকে বলবেন, এই চাপানওতরে পারিবারিক শান্তি নষ্ট হবে তাই এ প্রসঙ্গ না তোলাই ভাল। কিন্তু শান্তি বজায় রাখতে গিয়ে যদি চিরকাল একটা অন্যায় মেনে নেওয়া হয় তার চেয়ে খারাপ আর কিছু হয়না। মোদ্দা কথা হল কোন বিয়ে বা সম্পর্কের বিশ্বস্ততা টিঁকিয়ে রাখার দায়িত্ব কারোর একার নয়। ৪৯৭ধারা বাতিলের এই রায়ে সুপ্রিম কোর্টের একটা গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য রয়েছে। তা হল, যে আইন ব্যক্তি মর্যাদা ও নারীর সমানাধিকারের বিরোধী সংবিধান কখনোই তাকে অনুমোদন দেয় না। বারবার নিজেদের ইচ্ছা, চেষ্টা বাধা পাওয়ার ফলে নানারকম ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলার ঘটনা তো আমরা রোজকার জীবনে বারবার দেখছি।
আইন কোন সম্পর্ককে টিঁকিয়ে রাখতে পারে না। সম্পর্ক টেঁকে বিশ্বাস আর বোঝাপড়ায়। নতুন আইন অনেক অবিচার ও বৈষম্য আটকাবে ঠিকই কিন্তু তা কখনই কোন সংসার টিঁকিয়ে রাখার গ্যারান্টি হতে পারে না। পরকীয়া অবৈধ নয় এই রায়কে আমরা যদি যথেচ্ছাচারের ছাড়পত্র ভেবে নিই তবে সংসার আর সম্পর্ক কোনটাই থাকবে না। রায়দানের সময় বিচারপতিরা একথাটাও বিবেচনা করেছেন। তারা বলেছেন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অসুখী বিবাহ থেকেই তৈরি হচ্ছে পরকীয়ার প্রবণতা। মনে পড়ে গেল, যুক্তি তক্কো আর গপ্পো ছবিতে ঋত্বিকের লিপে কেন চেয়ে আছো গো মা গানটা। সুবিচারের আশায়, যোগ্য মর্যাদা পাওয়ার আকাঙ্খায় সমাজের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা মুখগুলিতে এই রায় হাসি ফোটাবে। তাদের নিজেদের যুক্তি বুদ্ধি ও বিবেচনা অনুযায়ী চলার সাহস যোগাবে।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )