ছবিটা দেখুন।
যে–কোনও মৃত্যুই দুঃখের। ইসলামপুরের দাড়িভিটে দুই যুবকের অপমৃত্যু শোকাহত করছে সবাইকেই। প্রাথমিক তদন্তে মনে হচ্ছে, পুলিসের গুলিতে নয়। কাদের গুলিতে? স্পষ্ট হবে। তার আগে স্পষ্ট হয়ে গেছে, কারা এবং কীভাবে সেদিন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। এক বাম নেতা ঘটনাস্থলে গিয়ে বলে এলেন, টেলিভিশনে শুনলাম, ‘স্কুল ড্রেস পরে এল, গুলি খেয়ে ফিরল!’ দুঃখজনক মৃত্যু হয়েছে যাঁদের, তাঁদের স্কুল ড্রেস ছিল না, একদা ওঁরা ওই স্কুলের ছাত্র ছিলেন।
আগুনে ইন্ধন দিয়ে বড় আগুন জ্বালাতে চাইছে বিজেপি, যাতে বাংলাকে ছারখার করা যায়। ২৬ সেপ্টেম্বর বন্ধ ডাকা হল। সরকারি অফিস, বেসরকারি অফিস, স্কুল, কলেজ, দোকানপাট সব খোলা। এবং হাজিরা স্বাভাবিক। তাহলে কী করা যায়? কিছু পকেটে গোলমাল পাকিয়ে উপস্থিতি ও শক্তি বোঝানোর চেষ্টা। এই সর্বনাশা বন্ধ দেখিয়ে দিল, বিজেপি–র শক্তি সীমাবদ্ধ। স্পষ্ট হল সংগঠনের দুর্বল চেহারা। বন্ধ ব্যর্থ, হওয়ারই কথা, সুতরাং চালাও গুন্ডামি, যেখানে যতটুকু পারা যায়।
দিলীপ ঘোষ আগের দিন বললেন, আজ যা দেখছেন (অল্প গুন্ডামি) তা হল ট্রেলর। আসল পিকচার কাল দেখবেন। দেখলাম। ইসলামপুরে ঘাঁটি গেড়ে থাকলেন দলের একাধিক রাজ্য নেতা। দুঃখজনক মৃত্যুকে পুঁজি করে এলাকায় সন্ত্রাস। সেদিনই শুভেন্দু অধিকারী গেলেন সভা করতে। বাগডোগরা থেকে ইসলামপুর আসার পথে বাধা। আটকানো যায়নি। শুভেন্দু সভা করলেন। স্থানীয় তৃণমূল কর্মীরা সকাল থেকেই সতর্ক ছিলেন, অনেক বেশি শক্তি থাকা সত্ত্বেও প্ররোচনার ফাঁদে পা দেননি।
বাস পোড়ানো হল ইসলামপুরে। সহজ কাজ। চাই কিছু গুন্ডা, সঙ্গে ভয়ঙ্কর প্ররোচনা। কলকাতায় ব্রেবোর্ন রোডে বাসে আগুন। দুটো ছবি প্রকাশিত হল পরদিন। রাজ্য বিজেপি দপ্তর থেকে মিছিল রাহুল সিনহার নেতৃত্বে, সামনের সারিতে হলুদ পাঞ্জাবি–পরা এক ব্যক্তি। দ্বিতীয় ছবি, বাসে আগুন দেওয়ায় যুক্ত ওই হলুদ পাঞ্জাবি। নিশ্চয় প্রোমোশন হবে!
এয়ারপোর্ট থানার গঙ্গানগরে দিল্লি পাবলিক স্কুলের বাসে অনেক ছাত্রছাত্রী, সঙ্গে কয়েকজন শিক্ষিকা। ভাঙচুর, বাসে উঠে হুমকি, জ্বালিয়ে দেব। বাচ্চাদের কান্না, শিক্ষিকাদের কাতর আবেদনে কাজ হচ্ছিল না। পুলিস এসে পড়ায় স্কুল বাস পোড়ানোর মহৎ কর্ম অসম্পূর্ণ থাকল। এবং হাওড়ায় ফাঁসিতলা। ছবিটা দেখুন।
এই বিশেষ সময়ে বিশেষ দলটির উপযুক্ত নেতা দিলীপ ঘোষ। প্রতিদিন কুৎসিত ভাষায় প্ররোচনা বাড়াচ্ছেন। উত্তর দিনাজপুর জেলার উপযুক্ত সভাপতি শঙ্কর চক্রবর্তী প্রকাশ্য সভায় বললেন, ‘পুলিসকে গাছে বেঁধে পেটান। পথে যদি দেখেন কোনও পুলিস পড়ে আছে, জল চাইছে, দেবেন না। কুকুরকে দেবেন, ওদের নয়। পুলিসকর্মীদের বাড়ির ছেলেমেয়েদেরাও যদি রাস্তায় পড়ে থাকে, জল দেবেন না।’ এবং, রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বললেন, শঙ্কর ভুল তো কিছু বলেননি!
নীতিনিষ্ঠ দল বটে বিজেপি। দিলীপবাবু বললেন, ‘বন্ধকে নৈতিকভাবে সমর্থন করি না। কিন্তু এবার ডাকা হল।’ অনৈতিক কাজ করছেন, এমন স্বীকৃতি কেউ কখনও শুনেছেন? কী করে শুনবেন, এমন দল, এমন নেতাও তো আগে কেউ দেখেননি। বন্ধ্যা, ব্যর্থ বন্ধের পর দিলীপবাবুর দাবি, সফল! বেশ করেছেন, বলতে হয় বলেছেন। কিন্তু সঙ্গে যে আরও কিছু বললেন। ‘যেখানে যা অশান্তি হয়েছে, সবই করেছে তৃণমূল!’ একই কথা বলেছেন কৈলাস বিজয়বর্গীয়। গঙ্গানগরে বাচ্চাদের স্কুলবাসে আগুন লাগাতে গেল কারা? শাসক দল তৃণমূল, যারা বন্ধের ডাক ব্যর্থ করে রাজ্যকে সচল রাখতে চেয়েছে।
ইসলামপুরে ও ব্রেবোর্ন রোডে বাসে আগুন লাগাল কারা? যারা রাজ্যকে শান্ত স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে স্থির ছিল নেত্রীর নির্দেশে, সেই তৃণমূল! কেশিয়াড়িতে পানের ব্যবসায়ী বিভুরঞ্জন দাসকে গুলি করে খুন করল কারা? যারা কোনও গোলমাল হতে না দেওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল, যারা অনেক প্ররোচনা সত্ত্বেও নিজেদের সংযত রেখেছে, সেই তৃণমূল! ফাঁসিতলায় মারাত্মক ছবিটা উপহার দিল কারা? যারা সকাল থেকে পরিস্থিতি শান্ত রাখার জন্য সজাগ ছিল, সেই তৃণমূল! ছবিটা দেখুন।
দাড়িভিটের ঘটনাস্থলে চলুন, বোঝার চেষ্টা করি। ঘটনা তো এই যে, দুদিন আগে স্কুল কর্মসমিতির বৈঠকে অন্যরকম সিদ্ধান্ত হওয়া সত্ত্বেও, স্কুল পরিদর্শক সংস্কৃত ও উর্দুর শিক্ষককে কাজে যোগ দিতে পাঠিয়েছিলেন। উচ্চমাধ্যমিক স্তরের পদ খালি ছিল না। তবু ‘কনভার্সন’ করে পাঠালেন। ছাত্রছাত্রীরা প্রতিবাদ জানাল। কিন্তু সেখানেই তো ব্যাপারটা শেষ হয়ে গেল না। স্কুল পরিদর্শক কেন গৃহীত সিদ্ধান্তের বাইরে গেলেন? তাঁকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। জানা দরকার, কোনওরকম চক্রান্তের সঙ্গে জড়িত কিনা, যাতে উত্তেজনা ছড়াতে পারে বিজেপি। কেউ বিশ্বাস করবে, স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা, কিশোর–কিশোরীরা, নিজেদেরই স্কুলের চেয়ার টেবিল কম্পিউটার ভেঙে চুরমার করে দিল? বোমা, অস্ত্র জড়ো করল ওই কিশোর–কিশোরীরা?
সংস্কৃতের শিক্ষকও যোগ দিয়েছেন, কিন্তু সেটা চেপে গিয়ে উর্দুকেই সামনে নিয়ে এল বিজেপি। কলকাতায় বিদ্যার্থী পরিষদের মিছিল। সামনে ‘বিদ্যার্থী’ নেতারা, পেছনেই বিজেপি নেতারা। এক ‘ছাত্রনেতা’ বললেন, ‘আমরা বাংলা ভাষার জন্য লড়ছি!’ তারপর এক নেতা বাংলা ভাষার হয়ে গলা ফাটালেন হিন্দি ভাষায়। ভাবুন, বাংলা ও বাঙালির হয়ে লড়ার কথা বলছে সেই দল, যারা অসমে ৩৮ লক্ষ বঙ্গভাষীকে ‘রাষ্ট্রহীন’করতে চাইছে। যারা বঙ্গ সংস্কৃতির শত্রু। আসলে, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের মারাত্মক চেষ্টা।
চক্রান্ত অস্পষ্ট নয়। পূর্বপরিকল্পিত ঘটনা দাড়িভিটে। হিন্দু পরিষদ চালায় একল বিদ্যালয়, যাদের কাজ শিশুদের মধ্যেই সাম্প্রদায়িক বিষ ঢুকিয়ে দেওয়া। দেশে একল বিদ্যালয় ৭৫ হাজার, বাংলায় সাড়ে তিন হাজার। ইসলামপুরে এই এলাকায় সংখ্যা পঞ্চাশের বেশি। দীর্ঘমেয়াদি চক্রান্ত, সঙ্গে সেদিনের জন্য নোংরা পরিকল্পনা। দিলীপ ঘোষ বললেন, বন্ধ নৈতিকভাবে সমর্থন করেন না। তবু করলেন, যাতে গন্ডগোল বাধানো যায়। আরএসএস বলে, ওরা রাজনৈতিক সংগঠন নয়। সব ভনিতা ছেড়ে, এই প্রথম বন্ধকে সমর্থন জানাল আরএসএস এবং সক্রিয় হল। বাংলাকে তছনছ করার জন্য মরিয়া সঙ্ঘ পরিবার। হতেই হবে, মমতা ব্যানার্জি তো শুধু বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নন, দেশের ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির প্রধান মুখ। ছবিটা দেখুন। হাওড়ার ফাঁসিতলায় এক অটোচালককে নামিয়ে, রাস্তায় ফেলে পেটাচ্ছেন একজন। মুখে লাথি। তৃণমূলের কেউ করছেন? মুশকিল, বলতে পারবেন না। নাম ওমপ্রকাশ শর্মা, বিজেপি–র যুব মোর্চার পরিচিত নেতা। নানাভাবে নিজেদের কদর্য ভয়ঙ্কর চেহারা দেখাচ্ছে বিজেপি। এই ছবিটা উদাহরণ। গরিব অটোচালকের মুখে লাথির পা–টা পা নয়, বিজেপি–র মুখ!
(সৌজন্য :- আজকাল)