‘বিজ্ঞানীদের গবেষণাকে মানুষের কাজে লাগাতে বেসরকারি সংস্থা থেকে শুরু করে শিল্পপতি—সবাইকে আরও এগিয়ে আসতে হবে।’ চলতি বছরের ভাটনাগর পুরস্কার জিতেছেন ১৩ জন। যাঁদের মধ্যে পাঁচজন বাঙালি। আর ইতিহাস সৃষ্টিকারী বঙ্গসন্তানদের অধিকাংশের গলাতেই কিন্তু এই একই সুর।
এঁদের মধ্যে অন্যতম ডঃ স্বাধীন মণ্ডল। আইআইএসইআরের এই বিজ্ঞানী বলছিলেন, ‘একজন বিজ্ঞানী গবেষণার কাজ করার জন্য যে অর্থ পান, তা কাজে লাগিয়ে একটা গবেষণাকে ল্যাবে সফলভাবে সম্পূর্ণ করা যায়। কিন্তু বৃহৎ আকারে মানুষের জন্য তা ব্যবহার করতে গেলে বেসরকারি সংস্থাকে আরও এগিয়ে আসতে হবে। তবেই বিজ্ঞানীদের কাজ যথাযথভাবে মানুষের কাছে পৌঁছবে, উপকারে লাগবে।’ একই কথা ভাটনাগর পুরস্কার জয়ী আর এক বাঙালি বিজ্ঞানী ডঃ অম্বরীশ ঘোষের। বলেন, ‘যে বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করছি, গোটা পৃথিবীতে হাতেগোনা কয়েকটি জায়গায় এরকম গবেষণা চলছে। বিদেশের একটি সংস্থা এই গবেষণায় আগ্রহ প্রকাশ করলেও, এদেশের কোনও সংস্থা এবিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেনি।’
ভাটনাগর পুরস্কারকে গত ১০ বছর নিরলস পরিশ্রমের ফল হিসেবেই দেখছেন এলাহাবাদের হরিশচন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বাঙালি বিজ্ঞানী ডঃ অদিতি সেন দে। তাঁর মতে, ‘নিজেদের মতো করে আরও অনেক ছাত্র-ছাত্রী, খুদে বিজ্ঞানী গড়ে তুলতে পারছি, এটা যথেষ্ট আনন্দের বিষয়। এই পুরস্কার সেই কাজকেই আরও উদ্বুদ্ধ করবে।’ আর উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাশ করে বর্তমানে সমুদ্র নিয়ে গবেষণায় যুক্ত বিজ্ঞানী ডঃ পার্থসারথি চক্রবর্তীর মত, ‘এই প্রাপ্তি সাধারণ মানুষের প্রতি কাজ করার দায়িত্ব আরও বাড়িয়ে দিল।’ একইভাবে আইআইএসইআর থেকে দ্বিতীয় ভাটনাগর পুরস্কারপ্রাপ্ত ডঃ রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘এই পুরস্কার প্রমাণ করে গবেষণাক্ষেত্রে বাঙালি এখনও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছেন।’
জল পরিশোধন করতে যেরকম ফিল্টার মেশিন বসানো হয়, সেরকমই বিভিন্ন জায়গা থেকে নির্গত পরিবেশ দূষণকারী কার্বন ডাই-অক্সাইড নিয়ন্ত্রণে ফিল্টার বানানোর চেষ্টা করছে আইআইএসইআর। খড়দহের বাসিন্দা রাহুলবাবু বলেন, ‘গত সাত-আট বছর ধরে এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত রয়েছি। গোটা বিশ্বেই এনিয়ে প্রচুর কাজ হচ্ছে।’ এখনও চূড়ান্ত সাফল্য না এলেও, শীঘ্রই সাফল্য মিলবে বলে আশাবাদী তিনি। হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন যৌগের মিশ্রণে যখন জল তৈরি হয়, তখন তার সঙ্গে শক্তিও তৈরি হয়। সেই শক্তিকে কীভাবে সঞ্চয় করে অন্য কাজে ব্যবহার করা যায়, তা নিয়ে কাজ করতেই এই পুরস্কার প্রাপ্তি। বিজ্ঞান গবেষণায় দেশের সর্বোচ্চ সম্মান ‘ভাটনাগর’প্রাপ্তি এই কাজকেই আরও উদ্বুদ্ধ করবে বলে তিনি আশাবাদী। একই বছরে একই প্রতিষ্ঠানের একই বিভাগ থেকে আরও এক বিজ্ঞানীর গবেষণা ভাটনাগর পুরস্কারে নির্বাচিত হওয়ায় খুশি সকলেই। বিজ্ঞানী ডঃ স্বাধীন মণ্ডলের কথায়, ‘আমাদের আশপাশে যা কিছু ব্যবহার করা হচ্ছে সবেতেই বিভিন্ন বিষাক্ত ধাতুর ব্যবহার হয়ে থাকে। জৈব উপাদান ব্যবহার করে কীভাবে সেই বিষাক্ত ধাতুর ব্যবহার বন্ধ করে কাজ করা যায়, তা নিয়েই এই গবেষণা।’ সেই সঙ্গে কার্বন-ডাই-অক্সাইড থেকে কীভাবে বিকল্প জ্বালানি পাওয়া যেতে পারে, তা নিয়েও তাঁদের দীর্ঘ গবেষণা চলছে। এই পুরস্কার সেই গবেষণাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা জোগাবে বলেই তাঁর দাবি। কেন্দ্রীয় সংস্থা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ওশেনোগ্রাফির (এনআইও) গবেষক পার্থসারথিবাবুর কথায়, ‘সামুদ্রিক পরিবেশ বিজ্ঞান গবেষণায় এই পুরস্কার ভাবী বিজ্ঞানীদের আরও অনুপ্ররণা জোগাবে।’ তাঁর গবেষণার এখন পুরোটাই আমাদের দেশের চারপাশের সমুদ্রকে ঘিরে। সমুদ্রে ঘুরে বেড়ানো বিভিন্ন বিষাক্ত এবং ক্ষতিকারক ধাতব উপাদান বা অন্যান্য রাসায়নিক কীভাবে থাকছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং তা কীভাবে বিভিন্ন মাছ সহ সমুদ্রের অন্যান্য প্রাণীর (যা মানুষের খাদ্য) মধ্যে ঢুকছে, তা পর্যবেক্ষণ করা। ভবিষ্যতে ‘সী-ফুড’ বিষাক্ত ও ক্ষতিকারক উপাদানমুক্ত কীভাবে করা যায় এবং সমুদ্রের পরিবেশকে কীভাবে আরও দূষণমুক্ত রাখা যায়, তা জানতেই এই গবেষণা। তাঁর দাবি, ‘আবহাওয়ার পরিবর্তনে সমুদ্র তথা উপকূলবর্তী এলাকাকে কীভাবে দূষণের কবল থেকে বাঁচানো যায়, তার অনুসন্ধান করতেও সাহায্য করবে এই গবেষণা।’
আবার ন্যানো মোটরের মডেল তৈরি করে ‘ভাটনাগর’ জয়ী ডঃ অম্বরীশ ঘোষ বলেন, ‘প্রত্যেকটি জিনিসের কোনও না কোনওরকম একটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। কিন্তু এমন একটা জিনিস তৈরি করতে চাইছি, যা ইঞ্জেকশন বা অন্য কোনও মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করিয়ে দিলে শুধুমাত্র সেই অঙ্গটিরই চিকিৎসা করবে। অন্য কোনও অঙ্গে প্রভাব ফেলবে না।’ উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ক্যান্সার চিকিৎসার সময়ে যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়, তা যাতে আর না হয়—সেই কারণেই এই গবেষণা। তবে এই নিয়ে আরও গবেষণা করা হবে বলেই জানিয়েছেন বালিগঞ্জের বাসিন্দা এই বাঙালি বিজ্ঞানী।
এঁদের পাশপাশি এই পুরস্কার প্রাপকের তালিকায় রয়েছেন আর এক বাঙালি বিজ্ঞানী নিউ আলিপুরের অদিতি সেন দে। তিনি বলেন, ‘কোয়ান্টাম মেকানিজমকে ব্যবহার করে কীভাবে বেতারবিহীন যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করা যায়, তা নিয়েই গবেষণা। সেই সঙ্গে গোটা বিশ্বেই বিজ্ঞানীরা এমন একটা কম্পিউটার বানানোর চেষ্টা করছে, যেখানে এমন কাজ অনায়াসে করে ফেলা যাবে, যা এখনকার কম্পিউটার বা সুপার কম্পিউটারেও করা যায় না।’ তবে গবেষকদলের প্রত্যেকের সঙ্গেই এই পুরস্কার ভাগ করে নিতে চান অদিতিদেবী।