গতকাল থেকে দেখছি এক শ্রেণীর মানুষের মাথার ঘুম উড়ে গেছে সুপ্রিম কোর্টের পরকীয়া সংক্রান্ত রায়ের পর থেকে। লোকেদের এমন হাবভাব যেন রায়ে বলা হয়েছে সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে পরকীয়া করতেই হবে। না জেনে, না শুনে, পড়াশোনা না করে, শুধু সোশ্যাল মিডিয়াতে মিম দেখে কিংবা সেনসেশনালিস্ট নিউজ চ্যানেল দেখে মন্তব্য করলে যা হয় আর কি।
সুপ্রিম কোর্টের পরকীয়া সংক্রান্ত রায়টি আসলে কি? কোর্ট বলেছে যে পরকীয়া এখন থেকে আর ফৌজদারি অপরাধ নয়। আইপিসির ৪৯৭ ধারায় (যেটাকে এডাল্টারী ল বলা হয়ে থাকে) বলা হয়েছিল, একজন পুরুষ যদি কোনও বিবাহিত মহিলার সঙ্গে, তার স্বামীর অনুমতি ছাড়াই যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেন তাহলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অর্থাৎ, এই ক্ষেত্রে পরকীয়ার ফলে পুরুষেরই শুধু সাজা হবে। অন্যদিকে, একজন বিবাহিত পুরুষ যদি অবিবাহিত নারীর সাথে পরকীয়া করেন, সেটি অপরাধ নয়। এবং স্বামীর অনুমিত মিললে তার স্ত্রীর সাথে অন্য পুরুষ যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে।
মোদ্দা কথা, আইনের চোখে, নারী হল পুরুষের সম্পত্তি মাত্র। তার অনুমতি ছাড়া সম্পর্ক স্থাপন অপরাধ। কিন্তু এক বিবাহিত পুরুষ এক অবিবাহিত নারীর সাথে যথেচ্ছাচার করতে পারেন, সে ক্ষেত্রে স্ত্রীর অনুমতির দরকার নেই। ২০১৮ সালে দাঁড়িয়ে এই মধ্যযুগীয় মানসিকতা মেনে নেওয়া যায়? শুধু তাই নয়, আইনের এই ধারা তো সংববিধানের আর্টিকেল ১৪-র ও পরিপন্থী। তাই, সুপ্রিম কোর্টের এই রায় খুবই সময়োপযোগী। বিয়ে-বহির্ভূত সম্পর্ক আর যাই হোক, ফৌজদারি অপরাধ হতে পারে না।
নৈতিকতার প্রশ্নে আসা যাক। অনেকেই পরকীয়া আর ব্যভিচার গুলিয়ে ফেললেন। ব্যভিচার পুরোটাই শরীরী। অন্যদিকে, পরকীয়ায় মনের জায়গাটা শরীরের অনেক ওপরে। অনেকের ক্ষেত্রে যৌনতা অনুপস্থিতও। বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক স্থাপনের অনেক কারণ হতে পারে। আর সেটা যে যৌনতার ভিত্তিতেই দাঁড়িয়ে, সেটা অতিসরলীকরণ করা হবে।
মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই পরকীয়ায় লিপ্ত হন। প্রকৃতির নিয়মই তাই। বৈবাহিক জীবনে বিভিন্ন দ্বন্দ্ব, অশান্তি, কিংবা শুধুমাত্র একঘেয়েমির জন্য অনেক সময় মন চায় একটু স্বাধীনতা। দমবন্ধ সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে এসে সৃষ্টি সুখের উল্লাস অনুভব করার তাগিদেও অনেকে খোঁজেন অন্য এক আশ্রয়। এটা কোনোদিনও দোষের নয়, হতে পারে না। অসুখী দাম্পত্য জীবনের বোঝা সারাজীবন বয়ে না বেরিয়ে যদি কেউ এমন এক সঙ্গী খোঁজেন যে তাকে শুধুই এক মানুষ হিসেবে ভালোবাসবে, এতে অপরাধ কোথায়?
লিখতে লিখতে মনে পড়ে যাচ্ছে অনুপম রায়ের কবিতার লাইন – আমাকে আমার মত থাকতে দাও। সত্যিই তো, আমরা যদি যে যার নিজের জীবনটা নিজের মত কাটাই, অন্য কে কি করল সেটার বিচার না করে, তাহলে কি সুন্দরই না হয়ে উঠবে আমাদের পৃথিবীটা।
ভুলে গেলে চলবে না, আজ আমরা পরকীয়া নিয়ে তর্ক করছি, দুশো বছর আগে কিন্তু বিধবা বিবাহও অপরাধ (অন্যায় বলাটাই ঠিক) হিসেবে গণ্য হত। স্বামীর মৃত্যুর পর সহমরণে না গেলে সেই নারীর কি হাল হত, মনে করিয়ে দিতে হবে? অনেকে তো বিদ্যাসাগর মশাইকে বলেছিলেন মেয়েরা পড়াশোনা করলে ধরণী দ্বিধা হবে। তাই বলে কি নারীশিক্ষার প্রসার ঘটে নি? আর যারা ধর্মের জিগির তোলেন, তাদের বলি, রাধা-কৃষ্ণের সম্পর্ক কোন পর্যায়ে পড়ে? হজরত মহম্মদেরও তো একাধিক বিবাহ ছিল। যীশু খ্রিষ্ট আর মেরি ম্যাগডালিন, মনে পড়ে?
তাই বলি, আধুনিক হন। মনের পরিধিটা বাড়ান। আপনার ইচ্ছে না করলে করবেন না। কিন্তু কেউ যদি দাম্পত্যে অসুখী হয়ে পরকীয়া করেন, তাতে নাক গলাবেন না। বরং ২০১৯-এ মোদী সরকার ক্ষমতায় ফিরলে দেশের কি অপূরণীয় ক্ষতি হবে, সে বিষয়ে মনোনিবেশ করুন।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )