বিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত করার লক্ষ্যে, যে সকল মহান ব্যক্তি ও বিপ্লবী নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম শহীদ ভগৎ সিং। আজ এই মহান বিপ্লবীর ১১১তম জন্মবার্ষিকী। ১৯০৭ সালের আজকের দিনেই ভারত মাতার কোল আলো করে জন্ম নেন ‘শহীদ-ই-আজম্’।
১৯০৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ শাসিত ভারতের পশ্চিম পাঞ্জাবের লায়ালপুর জেলার বংগা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ভগৎ সিং। একসময় পাঞ্জাবের এই অঞ্চলে জলের অভাবে চাষ-আবাদ কিছুই হত না। উনিশ শতকের শেষদিকে মধ্য পাঞ্জাবের বেশ কিছু মানুষ উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে এসে প্রচুর পরিশ্রম করে চাষ-আবাদ শুরু করেন। ভগৎ সিং-এর পূর্বপুরুষ ছিলেন এদের দলে। এরা ছিলেন দুঃসাহসী, কঠোর পরিশ্রমী আর দেশপ্রেমিক। এদের বলা হত জাঠ। তাঁর পিতার নাম সর্দার কিসান সিংহ সান্ধু ও মায়ের নাম বিদ্যাবতী।
আর্যসমাজের বিদ্যালয় দয়ানন্দ অ্যাংলো-বৈদিক স্কুল থেকে মেট্রিক পাসের পর তিনি ন্যাশনাল কলেজে (স্বদেশী বিদ্যালয়) ভর্তি হন। কৈশোর থেকেই তিনি ইউরোপীয় বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে পড়াশোনা করেন এবং নৈরাজ্যবাদ ও কমিউনিজমের প্রতি আকৃষ্ট হন। এরপর একাধিক বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। মাত্র ১৩ বছর বয়সেই তিনি গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। এই সময় তিনি প্রকাশ্যে ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরোধিতা করেন এবং তাঁর সরকারি স্কুলবই ও বিলিতি স্কুল ইউনিফর্ম পুড়িয়ে ফেলেন। ১৯২২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারী হঠাৎ উত্তরপ্রদেশের গোরখপুর জেলার চৌরীচেরা গ্রামে কৃষকদের শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন হঠিয়ে দেয়ার জন্য পুলিশ জনতার উপর গুলি চালায়। এতে কয়েকজন কৃষক মারা যায়। ফলে বিক্ষুব্ধ জনতা থানা ঘেরাও করে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। থানার ভিতর ২২ জন পুলিশ পুড়ে মারা যায়। এই ঘটনার কারণে গান্ধীজী অসহযোগ আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ান। এতে হতাশ হয়ে তিনি যুব বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ দেন এবং সশস্ত্র বিপ্লবের পন্থায় ভারত থেকে ব্রিটিশ শাসন উৎখাত করার কথা প্রচার করতে থাকেন। ব্রিটিশ সরকার বিপ্লবীদেরকে দমনের জন্য পুলিশকে অধিক ক্ষমতা প্রদান করে ভারত প্রতিরক্ষা আইন পাশ করার সমস্ত প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করে। ১৯২৯ সালের ৮ এপ্রিল সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিতে আইনটির অধ্যাদেশ পাশ হবার সিদ্ধান্ত হয়। এই আইনকে রুখে দেওয়ার জন্য ভগৎ সিং এর ‘হিন্দুস্থান সোসালিস্ট রিপাবলিকান এসোসিয়েশন’ প্রস্তুতি গ্রহণ করে। দলের নেতা ভগৎ সিং-এর নেতৃত্বে সিদ্ধান্ত হয় ৮ এপ্রিল সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিতে এর প্রতিবাদে বোমা নিক্ষেপ করা হবে। উদ্দেশ্য রক্তপাত নয়; ভগৎ সিং-এর ভাষায় ‘বধিরের কানের কাছে আওয়াজ তুলতে’। সিদ্ধান্ত হয়, ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত বোমা নিক্ষেপ করবেন আর দলের অন্যরা তাঁদেরকে আড়াল করে ঘটনাস্থল থেকে পালাতে সাহায্য করবেন। ৮ এপ্রিল যথাসময়ে ‘বধিরের কানের কাছে আওয়াজ পৌঁছানোর’ জন্য ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর বোমা নিক্ষেপ করে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’, ‘সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’, ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ স্লোগান দেন, যে-আওয়াজ ওইভাবে এর আগে কখনো শোনা যায়নি। পলায়নের চেষ্টা না করে তাঁরা নির্ভয়ে ইস্তাহার বিলি করতে থাকেন।
জেলে বন্দী থাকাকালে ভগৎ সিং ব্রিটিশ ও ভারতীয় বন্দীদের সমানাধিকারের দাবিতে ৬৪ দিন অনশন করেন। সে সময় ভারতীয় বন্দীদের চেয়ে ব্রিটিশ চোর ও খুনিদের প্রতি অধিকতর ভাল আচরণ করা হত। ৬৪ দিন অনশনের ফলে ব্রিটিশ সরকার নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। ১৯৩০-৩১ সালে জেলের মধ্যে ফাঁসির অপেক্ষায় যখন ভগৎ সিং-এর দিন কাটছিল সে সময় তিনি ‘হোয়াই আই অ্যাম অ্যান এথিস্ট’ প্রবন্ধটি লিখেছিলেন। ফাঁসির কয়েক মাস পরে ‘দ্য পিপল’ নামক পত্রিকায় প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়। ১৯৩০ সালের ৭ অক্টোবর তিন ব্রিটিশ বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত এক বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ভগৎ সিং, সুখদেব ও রাজগুরুকে অপরাধী সাব্যস্ত করে এবং ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার রায় প্রদান করে। অবশেষে ১৯৩১ সালের ২৩ মার্চ সন্ধ্যা ৭ টায় অন্য দুই বিপ্লবীর সাথে ভগৎ সিং-ককে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। আপামর দেশবাসীর কাছে তিনি হয়ে ওঠেন ‘শহীদ-ই-আজম্’।