বছর তিনেক আগে পাকিস্তানের পরিচালক সারমাদ খুসাত, সাদাত হাসান মান্টোর জীবন নিয়ে একটি ছবি বানিয়েছিলেন। সেই ছবির পুরোটা জুড়েই ছিল ‘পাকিস্তানি’ মান্টোর নিঃসঙ্গতা, অভাব-অনটন, রাইটার্স ব্লক আর দোটানা। তবে সেখানে ছিল না মান্টোর জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় চল্লিশের বম্বে। ছিল না অন্ধকার কোঠাবাড়ির বারবণিতার গন্ধ থেকে ‘ইন্টেলেকচুয়াল মেহেফিল’-এ ইসমাত চুঘতাই, অশোক কুমার, শ্যাম চাড্ডার মত বন্ধুদের ‘হিপতাল্লা’। নন্দিতা দাসের ‘মান্টো’ সে পথে হাঁটেনি। নন্দিতার মান্টো বরং বড় বেশি জীবন্ত। যাঁর পিঠে দগদগে কাঁটাতারের দাগ, চোখের সামনে ক্রমশ ভাঙনের পথে এগিয়ে যাওয়া অখন্ড ‘হিন্দুস্তান’।
নিজের কবরে লিপিবদ্ধ করে রাখার জন্য একটি এপিটাফ লিখে গিয়েছিলেন মান্টো। যার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়, ‘এখানে শুয়ে আছে সাদাত হাসান মান্টো। তার সঙ্গে সমাধিস্থ হয়েছে গল্প লেখার সমস্ত শিল্প এবং রহস্য। তাল তাল মাটির নীচে শুয়ে এখনও সে কেবল এটাই ভাবছে, মহান গল্প লেখকটি আসলে কে? সে নিজেই, নাকি ঈশ্বর?’ এই বয়ানটি পড়লেই বোঝা যায় নিজের লেখকসত্ত্বা নিয়ে কতটা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন তিনি। এই আত্মবিশ্বাসী লেখক কিন্তু দেশভাগের ভয়াবহতায় ক্রমশ ক্ষতবিক্ষত হতে থাকা, অশ্লীলতার অভিযোগে বিদ্ধ হওয়া মান্টোকেই বড় যত্নের সাথে সেলুলয়েডে এঁকেছেন নন্দিতা। যেখানে বন্ধু ইসমাত চুঘতাই, শ্যাম চাড্ডা, স্ত্রী সোফিয়ার মত বাস্তব চরিত্রদের সঙ্গেই পর্দায় ঢুকে পড়ে মান্টোর গল্পের চরিত্ররা। মান্টোর ‘জার্নি’-র অংশ হয়ে যায় তারা। সেই কালি সালোয়ার পরা মেয়েটি বা ‘খোল দো’ শুনে কামিজ খুলতে থাকা তরুণীটি। ‘টোবা টেক সিং’-এর খোঁজ করতে থাকা সেই উন্মাদ শিখ কিংবা দাঙ্গার রাতে মৃত এক মেয়েকে ধর্ষণ করেছিল যেই ঈশ্বর সিং। ছবির গল্প যত এগিয়ে যেতে থাকে, একে একে মান্টোর সাথে মুলাকাত হয় এইসকল চরিত্রের। লেখকের জীবনের সঙ্গে তাঁর লেখা গল্প এ ভাবে মিশিয়ে দেওয়ায় যে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন নন্দিতা, তা যথেষ্ট তারিফযোগ্য। মান্টোর জীবনের দোটানা, দোলাচাল, অনিশ্চয়তাকে সুনিপুণভাবে পর্দায় তুলে ধরেছেন তিনি। মান্টোর অতি সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলোও ভাষা পেয়েছে ছবিতে। দেশভাগের যন্ত্রণা, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, দাঙ্গার ভয়াবহতা, বম্বের প্রতি ভালোবাসা সব মিলেমিশে যায় ছবির পরতে পরতে। সেদিক থেকে সফল পরিচালক নন্দিতা। তবে এই এতকিছুর জন্যেই তাল কাটে ছবির। প্রায় ঘন্টা দুয়েকের ছবিতে টুকরো টুকরো অনেক ঘটনা, গল্প আর ছোট ছোট বহু চরিত্রের আবির্ভাবে কোথাও যেন ব্যাহত হয় ছবির চলন। পরিচালক নন্দিতার মুন্সিয়ানা, চিত্রনাট্যকার নন্দিতাকে খানিকটা রক্ষা করলেও, একটা সময় পর আলগা হয়ে পড়ে প্রতিটা দৃশ্যের বাঁধন। ধরা পড়ে চিত্রনাট্যের দুর্বলতা। ইসমত চুঘতাই, ফৈজ আহমেদ ফৈজের মত বহু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলি ছবিতে গুরুত্ব হারায়। বহু গুরু ঘটনাও সময়ে কুলাতে লঘু রূপে ধরা দেয়।
তবে এ ছবির পুরোটা জুড়েই রয়েছেন নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি। তাঁর লার্জার দ্যান লাইফ অভিনয়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছে নন্দিতার ‘মান্টো’। আসলে নওয়াজউদ্দিনই মান্টো নাকি মান্টোই নওয়াজউদ্দিন, সেই ব্যাপারটিই গুলিয়ে যায় ছবি দেখতে বসে। ‘হলিউড রিপোর্টার’ যে তাঁকে বিখ্যাত অভিনেতা মার্সেল্লো মাস্ত্রোইয়ানি-র সঙ্গে তুলনা করে কোনও ভুল করেনি, তা আবারও প্রমাণ করে দিলেন তিনি। চোখের পাতায় ঠিক যেভাবে কাজল মিশে থাকে, তেমনভাবেই মান্টোর সঙ্গে মিশে থাকেন তাঁর স্ত্রী সোফিয়া। সোফিয়ার চরিত্রে অসামান্য অভিনয় করেছেন রসিকা দুগল। এ যেন তাঁর কেরিয়ার জীবনের সেরা অভিনয়। এছাড়া ছোট ছোট চরিত্রেও নজর কাড়লেন জাভেদ আখতার, দিব্যা দত্ত, রণবীর শোরে, শশাঙ্ক অরোরা, তিলোত্তমা সোম, পরেশ রাওয়াল প্রমুখেরা। শ্যাম চাড্ডার ভূমিকায় তাহির রাজ বাসিন ও ইসমত চুঘতাই- এর ভূমিকায় রাজেশ্বরী দেশপান্ডের অভিনয়ও যথাযথ।
মান্টো ছবিটির সম্পদ এর সিনেম্যাটোগ্রাফি এবং প্রোডাকশন ডিজাইন। রীতা ঘোষের সুনিপুণ দক্ষতার সঙ্গে গড়ে তোলা দেশভাগের পরের লাহোর কিংবা চল্লিশের দশকের বম্বের সেটে, কার্তিক বিজয়ের ক্যামেরা ঘুরে বেরায় বড় সাবলীল ভঙ্গীতে। তাঁদের যোগ্য সঙ্গত দিয়েছে রেসুল পুকুট্টির সাউন্ড ডিজাইন। স্নেহা খানওয়ালকার- এর সঙ্গীত এবং জাকির হুসেনের আবহ ছবির সঙ্গে মানানসই। তবে এ শ্রীকর প্রসাদ-এর এডিটিং আরও নিখুঁত হতে পারত। কয়েকটি দৃশ্য নির্দ্বিধায় বাদ দিয়ে দেওয়া যেত। যে দৃশ্যগুলি অযথাই ছবির চলনকে ব্যাহত করছে। তবে চিত্রনাট্যকার নন্দিতার ত্রুটিগুলো অনেকাংশেই ঢেকে দিয়েছে পরিচালক নন্দিতার মুন্সিয়ানা। ‘ফিরাক’-এর পর পরিচালক হিসাবে নন্দিতা এখন আগের চেয়ে অনেক পরিণত। এই ভরা বায়োপিকের বাজারেও এর আগে লেখকদের জীবন নিয়ে ছবি করার কথা কেউ তেমন ভাবেননি। সেদিক থেকে নন্দিতার এই উদ্যোগ যথেষ্ট প্রশংসার দাবি রাখে। ছবি মুক্তির আগে নন্দিতা জানিয়েওছিলেন, প্রায় ৫-৬ বছর ধরে তিনি মান্টোকে নিয়ে গবেষণা করেছেন। এইটুকু ক্যানভাসে দেশভাগ এবং মান্টোর ঘটনাবহুল জীবনে তার রেশ তুলে ধরা যে খুব সহজ ছিলনা, সে কথা বলাই বাহুল্য। শেষে এটাই বলার, ভাল ভাবে মান্টো পড়া না থাকলে, দর্শকের কাছে নন্দিতার ‘মান্টো’ খানিকটা অধরা মাধুরীর মতই।