এ যেন এর বোঝা ওর ঘাড়ে। আগুন লাগল বাগরি মার্কেটে, আর কপাল পুড়ল ক্যানিং স্ট্রিটের চীনাবাজারের ব্যবসায়ীদের। বাগরি মার্কেটের যতটা নামডাক ইমিটেশন গয়না বিক্রিবাটার জন্য, তার চেয়ে কোনও অংশেই কম নয় সেখান থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে চীনাবাজারের। গোটা রাজ্য থেকে এই দু’টি বাজারে নকল গয়না কিনতে আসেন মণিহারি দোকানদাররা। এখান থেকেই পাইকারি দরে তাঁরা গয়না কিনে নিয়ে যান। বিক্রি করেন খুচরো বাজারে। বাগরি মার্কেট আগুনে পুড়ে যাওয়ার খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়তেই গয়না কেনার সেই খরিদ্দারের সংখ্যা হু হু করে কমে গিয়েছে চীনাবাজারেও। পুজোর মুখে তাই লোকসানের ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করছে ব্যবসায়ীদের। কবে খরা কাটবে, বা উৎসবের মরশুমে আদৌ কাটবে কি না, তা নিয়েই চীনাবাজারের ব্যবসায়ীরা দুশ্চিন্তায়।
বাগরি মার্কেটের পরিচিতি ওষুধ কেনাবেচার জন্য। কিন্তু ইমিটেশন গয়না ও অন্যান্য মণিহারি সামগ্রীর জন্যও একই রকম জনপ্রিয় এই মার্কেট। তফাৎ শুধু দামে। মঙ্গলবার দুপুরে চীনাবাজারের এক দোকানি বলছিলেন, বাগরি মার্কেটে যাঁরা পাইকারি মাল কেনাকাটার জন্য আসেন, তাঁরা এই চীনাবাজারেও আসেন। দু’টি বাজারের গয়নাগাটি বা সাজগোজের অন্যান্য জিনিসের প্রধান তফাৎ দামে। বাগরিতে পাওয়া যায় হাল ফ্যাশনের দামি গয়না। চীনাবাজারে পাওয়া যায় তার থেকে কিছুটা কম দামের জিনিস। যাঁরা দোকানদারি করেন, তাঁরা যেমন বাগরি থেকে দামি মাল নেন, তেমনই চীনাবাজার থেকেও কেনেন তুলনামূলক কম দামের জিনিস। ক্রেতারা যেহেতু সব রকমের দামের গয়না পছন্দ করেন, তাই চীনাবাজারকে এড়াতে পারেন না কোনও খুচরো ব্যবসায়ী, জানান প্রবীর সামন্ত নামের এক দোকানি। কতটা মার খেল বাজার? আরও এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে পাওয়া গেল সেই প্রশ্নের উত্তর। তিনি বলেন, বিশ্বকর্মা পুজো হয়ে গিয়েছে। পুজোর আর এক মাসও নেই। অন্যান্যবার এই সময় এখানে ভিড়ের চাপে দাঁড়ানোই যায় না। গিজগিজ করে লোক। এখন একটাও খরিদ্দার নেই।
কোনও খরিদ্দার না থাকার মতো খারাপ পরিস্থিতি অবশ্য বাজারের সর্বত্র নেই। কিন্তু চীনাবাজারের অবস্থা অন্যবারের মত একেবারেই চাঙ্গা নয়। এই বাজারে রকমারি চুড়ি বিক্রি করেন মুন্না মনিয়ান। তিনি বলেন, পুজোর বাজার শুরু হয়ে গিয়েছিল জোর কদমে। হঠাৎ ধাক্কা খেল। গোটা দেশ জেনে গিয়েছে বাগরি মার্কেটে আগুন লেগেছে। তাই এই ডামাডোলে কে আর ঝামেলা পোহাতে আসে। তাই খরিদ্দারে টান আছে। দেখা যাক, কবে বাজারে স্বস্তি ফেরে। মহম্মদ তাহের খান নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, সত্যি বলতে কী, এবার পুজোর বাজার এমনিতেই ভালো নয়। অন্তত আমার কাছে গত কয়েক বছর ধরে বাজার ভালো যাচ্ছে না। জিএসটি আসার পর জিনিসের দাম বেড়েছে। অনেক মহিলা আছেন, যাঁরা বাড়িতে বসে সাজগোজের রকমারি জিনিস বিক্রি করেন। তাঁরা আমাদের থেকে মাল নেন। জিএসটি চালু হওয়ায় তাঁদের লাভের টাকায় টান পড়েছে। তাই তাঁরা ব্যবসায় মূলধন কমাচ্ছেন। আমরা বাজারে বসে তা দিব্যি বুঝতে পারি। বাগরিকাণ্ড সেই আগুনে যে আরও খানিকটা ঘি দিল, তা একবাক্যে মেনে নিয়েছেন তাহের।
তবে হাল এখনই ছাড়তে রাজি নন অনেকেই। বাহারি কানের দুলের হোলসেলার মহম্মদ হাবিবুল্লা জানান, এখনও তো একমাস সময় বাকি আছে পুজো আসতে। আশা করি এর মধ্যে বাগরি আতঙ্ক কাটিয়ে ওঠা যাবে। বিক্রিবাটাও যে টুকটাক হচ্ছে না, তা নয়। পরের সপ্তাহে ফের রমরমিয়ে ব্যবসা চলবে বলেই আশা করছেন তিনি। তাঁর মতো আশায় রয়েছেন এই চীনাবাজারের আরও শ’য়ে শ’য়ে বিক্রেতা। কারণ, ঝলসে যাওয়া বাগরি বিগড়ে দিয়েছে বিক্রিবাটার চালচিত্র। নিকেল করা হার-দুল-লকেটের বাজার থেকে যত তাড়াতাড়ি সরবে এই কালো ধোঁয়া, ততই মঙ্গল। ব্যবসা থেকে লাভের টাকা ঘরে তোলার এটাই তো মাহেন্দ্রক্ষণ। তাই বাগরির আকাশে কালো মেঘ কেটে গিয়ে, বেজে উঠবে দেবীর আলোর বেণু, এই আশাতেই বুক বেঁধে বসে গোটা চীনাবাজার।