রবীন্দ্রনাথ সুকুমার রায় সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘সুকুমারের লেখনী থেকে যে অবিমিশ্র হাস্যরসের উৎসধারা বাংলা সাহিত্যকে অভিষিক্ত করেছে তা অতুলনীয়। তাঁর সুনিপুণ ছন্দের বিচিত্র ও স্বচ্ছল গতি, তাঁর ভাব সমাবেশের অভাবনীয় অসংলগ্নতা পদে পদে চমৎকৃতি আনে। তাঁর স্বভাবের মধ্যে বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতির গাম্ভীর্য ছিল, সেইজন্যই তিনি তাঁর বৈপরীত্য এমন খেলাচ্ছলে দেখাতে পেরেছিলেন। বঙ্গ সাহিত্যে রঙ্গ রসিকতার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত আরও কয়েকটি দেখা গেছে, কিন্তু সুকুমারের হাস্যোচ্ছাসের বিশেষত্ব তাঁর প্রতিভার স্বকীয়তার যে পরিচয় দিয়েছে, তার ঠিক সমশ্রেণীর রচনা দেখা যায় না। তাঁর এই বিশুদ্ধ হাসির সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর অকালমৃত্যুর সকরুণতা পাঠকের মনে চিরকালের জন্য জড়িত হয়ে রইল’।
এই বক্তব্যের শেষ বাক্যটিতে রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছেন ‘বিশুদ্ধ হাসি’-র কথা। তবে কি হাসির অশুদ্ধতা হয়? নাহ, রবীন্দ্রনাথ আসলে বলতে চেয়েছিলেন নির্মল হাসি। মালিন্যহীনতাই যে হাসির গুণ। ব্যঙ্গ নয়, স্যাটায়ার নয়, উইট নয়, এই হাসির ধরন ‘বিচিত্র’। তবে অন্যের ক্ষেত্রে ‘বিচিত্র’ হলেও, সুকুমারের বেলায় সেটাই ‘ননসেন্স’-এর শিল্প। যদিও এই ননসেন্স মোটেই সাধারণ ননসেন্স নয়, বাইরে আপাত ‘নির্বোধ’-এর মোড়ক, কিন্তু ভিতরে অন্য মোচড়। এই ননসেন্সের মধ্যে বৈজ্ঞানিক বুদ্ধির একটা সুনিপুণ ছক আছে, রীতিমত বৃত্তাকার ছক। সুকুমারের এই ননসেন্সের ভান্ডারই হল ‘আবোল-তাবোল’। আজ ‘আবোল-তাবোল’ পড়ল ৯৫-তে। ১৯২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, আজকের দিনেই প্রকাশিত হয়েছিল এই বই।
আবোল-তাবোল কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো যখন বইয়ের আকারে সাজানো হয়েছিল, তখন তার আপাত ‘মত্ত পাগল’-এর ছদ্মবেশের আড়ালে কাজ করছিল একটা প্যাটার্ন। যা আগে থেকেই কবির মাথায় ছিল, অর্থাৎ পূর্বপরিকল্পিত। তা না হলে একটা কবিতার বইয়ের প্রথম আর শেষ কবিতার নাম এক হত না। দুটোরই নাম আবোল-তাবোল! এটা মোটেই কবি আর অন্য নাম খুঁজে পান নি বলে এক নামে চালিয়ে দিলেন তা নয়। আসলে এ এক যাত্রা, যা চক্রাকারে আবর্তিত হয়। শুরুর আবোল-তাবোল কবিতাটির মূল সুর ছিল বাঁধনহারা ফুর্তির, প্রতিশ্রুতি ছিল ‘হিসাবহীন’, ‘সৃষ্টিছাড়া’ হবার মুক্ত উল্লাসের। আবার একই বইয়ের শেষ কবিতায় আশ্চর্যজনকভাবে জীবনের ফুর্তির উচ্ছাসের সঙ্গে কেমন অদ্ভুত অসংলগ্ন বৈপরীত্যে মিশে যায় বিদায়ের করুণ সুর। হালকা হাসি আর চোখের জল পরস্পরের সঙ্গে খুনসুটি করতে থাকে কেমন করে, সেটা না দেখতে পেলে দেখাটাই সম্পূর্ণ হয় না।
এছাড়াও সুকুমারের এই বইটি তাঁর লেখা সব আবোল তাবোল ছড়ায় ভরা। আজগুবি আর মজার মজার সব ছড়া। এই যেমন ‘কাঠবুড়ো’ ছড়াটা। শুধু কাঠ চেটেই ক্ষান্ত নয় বুড়ো, কাঠে কেন গর্ত হয়, তাই নিয়ে ভেবে ভেবে তাঁর ‘টেকো মাথা তেতে ওঠে গায়ে ছোটে ঘর্ম’। আবার ওই ‘গোঁফচুরি’ ছড়াটাও কম অদ্ভূত নয়। হেড অফিসের বড় শান্ত বড়-বাবুটির মাথায় হঠাৎ কী গোল চাপলো, একদম ক্ষেপে গেলেন তিনি। চিল্লিয়ে বলতে থাকেন, ‘ওরে আমার গোঁফ গিয়েছে চুরি’! যতই সবাই বোঝাতে যায় গোঁফ তাঁর ঠিকই আছে, একটুও কমেনি, ততোই বড় বাবু আরো ক্ষেপে যান। সামনে আয়না ধরলে নিজের গোঁফ দেখে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন। আরেক আজব ছড়া ‘শব্দ কল্প দ্রুম’। সে এক আজব দেশের ছড়া। সে দেশে নাকি ফুল ফোটার সময় পটকা ফোটার মতো শব্দ হয়! ‘বোম্বাগড়ের রাজা’ ছড়াটাও কম আজগুবি নয়। বোম্বাগড়ের রাজা করেন কী, সবসময় ছবির ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখেন আমসত্ত্ব ভাজা! মন্ত্রী তো আরো এককাঠি সরেস, সে রাজার কোলে বসে সারাদিন মহানন্দে কলসী বাজায়। আর ‘একুশে আইন’ ছড়াটি তো রীতিমতো বিখ্যাত। এই ছড়া শোনেননি, এমন ছড়া-রসিক কমই আছেন। যারা একটু-আধটুও আবৃত্তি করেন, তাদেরও ছড়াটি কম-বেশি মুখস্থ। এছাড়া ‘খিচুড়ি’ ছড়াটিতে আমাদের সাথে পরিচয় হয় হাঁসজারু, বকচ্ছপ, গিরগিটিয়া, হাতিমি, বিছাগল প্রভৃতি অদ্ভূতুড়ে শঙ্কর প্রাণীগুলোর সাথে। আবার এই বইটি পড়তে পড়তেই আমরা জানতে পারি, হুঁকোমুখো হ্যাংলার বাড়ি বাংলায়। আর সে সারাদিন ফূর্তিতে আয়েশ করে থপথপ করে নাচে। সারে গামা টিমটিম করে গায়। একেবারে আহ্লাদে গদগদ মূর্তি। কিন্তু একদিন তার কী যে হলো, তার থপথপ পায়ের নাচ থেমে গেল, গানও গেল থেমে। কী যে হলো, মামা মারা গেল, নাকি ঠ্যাং মচকে গেল, কে জানে! শেষমেশ জানা গেলো, সে এক ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেছে। ওদিকে রামগরুড়ের ছানার আবার রীতিমতো হাসতে মানা। হাসির কথা শুনলেই বলে- ‘হাসব না-না, না-না’। সারাদিন খালি ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকায়, যদি কেউ হেসে ওঠে! বনেও যায় না কখনো, যদি দখিন হাওয়ার সুড়সুড়িতে হেসে দেয় নিজেই। আবার যে ট্যাঁশ গরু, সে আসলে কোনো গরুই নয়। সে আসলে এক রকম পাখি। থাকে হারুদের আফিসে। ঢুলুঢুলু চোখ, মস্ত একখানা মুখ, টেরিকাটা ফিটফাট চুল, তিন-বাঁকা শিং, প্যাঁচানো লেজ। যদি একবার একটু খালি ছুঁয়ে দেওয়া যায়, সে যে কী একখানা চ্যাঁচানি জুড়ে দেয়! আবার ধমক দিলে, ল্যাগব্যাগ চমকিয়ে তক্ষুণি পড়ে যায়! আর খায় সাবানের সুপ আর মোমবাতি। এমনই আরও অনেক ‘ননসেন্স’ চরিত্রদের সাথে পাঠককে পরিচয় করায় সুকুমারের ‘আবোল-তাবোল’।
বইটাতে সুকুমার রায় কেবল ছড়া লিখেই ক্ষান্ত দেননি, প্রত্যেকটা ছড়ার সঙ্গে জুতসই ছবিও এঁকেছেন। এঁকেছেন হাঁসজারু আর গিরগিটিয়াদের ছবি, কাঠবুড়ো আর গোঁফ হারানো বড় বাবুর ছবি, হুঁকোমুখো হ্যাংলা এবং ট্যাঁশ গরুর ছবিও। ছবি আছে প্রত্যেকটা ছড়ার সাথেই। এই ছড়াগুলো সন্দেশে ছাপানোর সময় নিজের হাতেই ছবিগুলো এঁকেছিলেন সুকুমার রায়। ৯৫ বছর পরেও, এখনও ৮ থেকে ৮০ মত্ত ‘আবোল-তাবোল’ -এ। বাঙালির বইয়ের তাকে লাখো বই থাকুক, কিন্তু দেরাজে একটা আবোল তাবোল না থাকলে বুঝতে হবে, বইপ্রেমী মানুষটার সব থাকতে পারে, কিন্তু মনে রসিকতাটাই নেই।