বিজয় মালিয়া সম্প্রতি যে বয়ান দিয়েছেন তাতে তিনি বলেছেন যে তিনি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তার ঋণ সেটেলমেন্টের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বললেন যে যেহেতু তিনি আগে থেকেই জানতেন যে বিজয় বাবু তার কাছে একটি ব্লাফ প্রস্তাব নিয়ে আসবেন তাই তিনি তাকে মানে বিজয় মালিয়াকে বিশেষ পাত্তা দেননি ও তাকে ব্যাঙ্কের সঙ্গে কথা বলার জন্যে বলেন। এবং তিনি আরো বলেন যে তিনি বিজয় মালিয়ার স্বভাবও জানেন, বিজয় মালিয়া যে টাকা ফেরত দেবার লোক নন সেটাও জানতেন।
বিজেপির ভক্ত বৃন্দও বলার চেষ্টা করছেন যে কংগ্রেস এই বিজয় মালিয়াকে ঋণ দিয়েছিল ও যেহেতু বিজয় মালিয়াকে বিজেপি সরকার চাপে ফেলেছেন তাই বিজয় মালিয়া উল্টোপাল্টা বকছেন। আরো অনেক কিছুই বলছেন। যেমন বিজয় মালিয়ার সঙ্গে কংগ্রেসের সম্পর্কের জেরেই নাকি বিজয় মালিয়া এতো টাকা ঋণ পেয়েছেন। কিন্তু আমাদের কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী বিজয় মালিয়ার স্বভাব চরিত্র বেশ ভালোই জানতেন। কি রকম ভাবে? চলুন আমরা সেটাই দেখি।
প্রথম কথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ঠিকই বলেছেন। তিনি বিজয় মালিয়ার স্বভাব জানতেনই। নিচের তথ্যাবলী তা প্রমাণ করে দেবে। ভারতের ইনফোর্সমেন্ট ডায়রেক্টরেট এই বিজয় মালিয়ার বিরুদ্ধে গত ৮ই মার্চ ২০০০ দিল্লী চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিষ্ট্রেটের এজলাসে দ্যা ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন এ্যাক্ট ১৯৭৩ এর ৫৬ ধারায় একটি অভিযোগ আনেন। অভিযোগকারী চীফ এনফোর্সমেন্ট অফিসার। এই অভিযোগে বলা হয় যে এই বিজয় মালিয়া বেনেটন ফর্মূলা লিমিটেড, লন্ডন এর সঙ্গে ১/১২/১৯৯৫ এ একটি চুক্তি করেন ইউনাইটেড বেভরেজের চেয়ারম্যান হিসেবে। চুক্তি ছিল যে তাদের রেসিং কারে “কিংফিসারের” এর ব্র্যান্ড নেমের বিঞ্জাপন থাকবে। এই চুক্তি ১৯৯৮ পর্যন্ত বলবৎ থাকবে তা বলা হয়। এই চুক্তিনুসারে যে বিপুল পরিমানের অর্থ আয় করেন বিজয় মালিয়া তার কোনো হদিশ ভারত সরকারের কাছে ছিলই না। এমনকি এই ধরনের চুক্তির ক্ষেত্রে যা আবশ্যক ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নিকট থেকে অনুমতি তা বিজয় মালিয়া গ্রহণ করেননি। অর্থাৎ ভারতীর অর্থনৈতিক সংক্রান্ত বিধিনিষেধ কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে উনি এই চুক্তি করেছেন। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ও ই ডি এর মতে যা “ফেরা” আইনের ৪৭(১) এবং (২) ও ৯(১)(সি) সহ ৮(১) ধারার বরখেলাপ। এর পরিপ্রেক্ষিতে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টর বিজয় মালিয়া কে নোটিশ করেন। চার চারবার নোটিশ করলেও বিজয় মালিয়া বিভিন্ন অজুহাতে এড়িয়ে গেলে পরিশেষে ইডি তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির জন্যে আদালতের দ্বারস্থ হয়। বলাই বাহুল্য ভারত সরকারকে উপযুক্ত কর দেওয়ার বদলে ও ইডির তদন্তে উপযুক্ত সাহায্য করার বদলে বিজয় বাবু দিল্লী হাইকোর্টে এই গ্রেপ্তারী পরোয়ানার বিরুদ্ধে আপিল করেন। ২১শে মে ২০০৭ এ হাইকোর্টের রায় তার বিপক্ষে গেলে তিনি সেই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে আবেদন করেন। সুপ্রীম কোর্টে দীর্ঘদিন এই মামলা চলতে থাকে। মামলার গতি প্রকৃতি যা ছিল তাতে বিজয় মালিয়ার হাজতবাস নিশ্চিত ছিলই। ২০১৪ সালে কেন্দ্রে সরকার পরিবর্তন হয়ে যায়। কিন্তু এই মামলার অন্যতম বাদী ডিপার্টমেন্ট অফ ফাইনান্স। ২০১৪ সালের পর থেকে সরকার এই মামলার প্রতি রহস্যময় কারণে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। কিন্তু আইনের পথে চলার থেকে আদালত বিরত হন নি। পরিশেষে ১৩ জুলাই ২০১৫ সুপ্রীম কোর্ট বিজয় মালিয়ার বিরুদ্ধে জারি হওয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বজায় রাখে। ফলে বিজয় মালিয়ার গ্রেপ্তার হওয়া ছাড়া আর পথ থাকে না। কিন্তু তা হয় না। কারণ অতি পরিষ্কার, ডিপার্টমেন্ট অফ ফাইনান্স তার প্রতি সহৃদয় হয়ে ওঠে। কারন অজানা হলেও আন্দাজ করা কঠিন নয়। ২০১৫ থেকে ২০১৬ অবধি এই কেসে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকলেও ইডি অথবা কেন্দ্রীয় সরকার তাকে গ্রেপ্তারের কোনো উদ্যোগই নেয়নি। উল্টে তার বিরুদ্ধে চলা বিভাগীয় তদন্তই বন্ধ করে দেয়। অনুরুপভাবে তার বিরুদ্ধে সি বি আই আর্থিক তছরূপ সংক্রান্ত মামলায় লুকআউট নোটিস আনলেও এই কেন্দ্রীয় সরকারের বদান্যতায় তা তুলনামূলক ভাবে শিথিল হয়ে যায়। অর্থাৎ বিজয় মালিয়াকে সুপ্রীম কোর্টে রায় অনুযায়ী যেখানে হাজতে নেওয়ার কথা সেখানে তিনি জেনিভা, ইউ এস, লন্ডন করতে থাকেন। পরিশেষে যখন পরিস্থিতি যখন ক্রমে ঘোরালো হয়ে উঠে তখন তিনি আমাদের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন যে তিনি জানেন যে ব্যাঙ্কের টাকা শোধ দেবার লোক বিজয় মালিয়া নয়। কারন তাঁর অধীনেরই দপ্তর অর্থাৎ কেন্দ্রীয় অর্থ দপ্তরের বদান্যতায় বিজয় মালিয়াকে ২০১৫ সালে গ্রেফতার করেন নি। সর্ষের মধ্যেই ভুত যখন বাসা করে নেয় তখন ভূতের ক্ষতির সম্ভাবনা থাকেই না।
তাই যারা বলছেন যে বিজয় মালিয়াকে দেশে ফেরানোর জন্যে বিজেপি উদ্যোগী তারা ভাবের ঘরে চুরি করছেন। বিজেপিও নিজের সততা প্রমাণে বিজয় মালিয়াকে নিয়ে এই নাটক করে যাচ্ছে।
(মতামত লেখিকার ব্যক্তিগত)
প্রিয়া দত্ত
(লেখিকা সমাজকর্মী ও সাংবাদিক)