একের পর এক বাঙালির আত্মহত্যা, মৃত্যু-মিছিল! হাজার হাজার বাঙালি ডিটেনশন ক্যাম্পে পচে মরছে। মহিলারা শারীরিক ভাবে নিগৃহীত। এন আর সি র চুড়ান্ত খসড়ায় নাম নেই চল্লিশ লাখ মানুষের, অধিকাংশই বাঙালি। লাখ লাখ বাঙালির সামনে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার, সব আলো কেড়ে নিয়েছে অসমীয়া জাতিবাদীরা। শেষ হয়ে যাচ্ছে লাখ লাখ পরিবার, একই পরিবারের কারোর নাম আছে, কারোর নেই। হোজাইয়ের বিজেপি এম এল এ শিলাদিত্য দেবের কথায়, প্রায় ২২-২৫ লাখ হিন্দু বাঙালির নাম নেই তালিকায়, মানা হচ্ছে না নিয়ম, দাম নেই বৈধ নথিরও। কিন্তু এ নিয়ে বাংলার বড় বড় সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় খবর দেখেন? রাত ৮-৯ টার টক শো তে আলোচনা হয়? বাংলার সংবাদমাধ্যম দেখে বোঝার উপায় আছে আসামে বাঙালির গণ কবর খোঁড়া হচ্ছে?
সংবাদমাধ্যম গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ! সংবাদমাধ্যম জনমত গঠনে সাহায্য করে। কোনো ঘটনা মানুষের সামনে তুলে ধরাই কাজ। কিন্তু আমার এ কথা গুলো বর্তমান পরিস্থিতিতে পাগলের প্রলাপ মনে হওয়াই স্বাভাবিক। ভারতের মিডিয়া আজ ভারতের লজ্জা! বিক্রি হয়ে গেছে বড় বড় সংবাদ সংস্থা, নির্লজ্জ তাঁবেদারি। তাই তো আসামের মানুষের কান্না সংবাদমাধ্যম শুনতে পায় না। এন আর সির কথা এলেই, সংবাদ মাধ্যম খুঁজে পায় ফেজ টুপি পরা ও দাড়িওয়ালা কিছু মুখ। এন আর সির মাধ্যমে অবৈধ বাংলাদেশি মুসলমান তাড়ানো হচ্ছে, এ মিথ্যেকে যা সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে। বর্তমান ভারতের সমাজ ধর্মবিদ্বেষের জ্বরে ভুগছে। সৌজন্যে আরএসএস-বিজেপি। সেখানে মুসলমান আক্রান্ত হলে কিছু এসে যায় না, বড় অংশের হিন্দুর। তাই এন আর সির শিকার এমন মানুষের ছবি দেখাতে গিয়ে শুধুমাত্র মুসলিমের ছবি দিলে বিজেপির প্রোপাগান্ডাই মজবুত হয়। বাঙালি বাঙালি হিসাবে আক্রান্ত আসামে। লাখ লাখ হিন্দু বাঙালি আতঙ্কে ভুগছে, মুসলমান বাঙালিও শিকার একই ভাবে। অসমীয়া জাতিবাদীদের শিকার বাঙালি, যার ইতিহাস বহু পুরানো। দেশভাগের সময় আসামে গণভোট, “বঙ্গাল খেদাও” আন্দোলন, বরাকের বাংলা ভাষা আন্দোলন, আসুর বাঙালি বিরোধী আন্দোলন, শিলাপাথর ও নেলির ভয়ঙ্কর জাতিদাঙ্গা, বাঙালি নিধন, একতরফা আসাম চুক্তি, ২০০৩ এ সিটিজেনশিপ ক্লজ পরিবর্তন, বর্তমান এন আর সি– পরপর ডট গুলো যোগ করলেই স্পষ্ট বোঝা যায়, এন আর সি বাঙালিকে উদ্বাস্তু করার আইনি শিলমোহর মাত্র। সামনে রাখা হয়েছে অবৈধ বাংলাদেশি মুসলমান তাড়ানোর মুখোশকে। কিন্তু বাংলার সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব নেই? কদাচিৎ খবর করে, কিন্তু খবর করলেই সামনে রাখা থাকে মুসলিম কটা মুখ! সবটাই পরিকল্পিত? এদিকে বিজেপি তাদের কুখ্যাত আইটি সেলের মাধ্যমে সামাজিক মাধ্যমকে হাতিয়ার করে মিথ্যে গল্পগুলোকে মুখোরোচক সত্য করে তুলেছে। এর থেকে মুক্তির উপায় কি? বাংলার অধিকাংশ মানুষ হয় অবগত নয়, নয়ত বিজেপির ধর্ম বিদ্বেষের ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত। মানুষকে সত্য জানাবে কে? আসামের বাঙালির এই বিপদে বাংলার সংবাদমাধ্যম উদাসীন কেন?
যমজ ভাই।এক জনের নাম এন আর সি তে, অন্যজন বিদেশি সন্দেহে ডিটেনশন ক্যাম্পে!! কল্পনাতীত! এ কিভাবে সম্ভব? আর একটা ঘটনার কথা বলি।গেছিলেন এন আর সি র নথি জমা করতে। দিলেন ১৯৫১ সালের নথি। নিলেন না এন আর সি অফিসার। বললেন, নাম উঠে যাবে সমস্যা নেই। কিন্তু তালিকায় নেই নাম। পথ: আত্মহত্যা। এর দায় কার? এগুলো কি চক্রান্ত করে খুন করা না? এন আর সির কাট অফ ডেট ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ, কিন্তু ১৯৬১ সালের বাংলা ভাষা আন্দোলনকারীর তিন মেয়ের ও স্ত্রীর নাম নেই। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু! দোষী কে? এন আর সির তালিকায় নাম আসেনি, খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারছেন নাম না ওঠার কারণ, “নো রিজন”, “টেকনিক্যাল রিজন”, “সফটওয়ার প্রবলেম” ইত্যাদি। এত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু, যেখানে জীবন মরণের প্রশ্ন, সেখানে এই ছেলেখেলা কি কাকতালীয়? মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতীয় সেনায় কাজ করা, বীর সেনানীর পদক পাওয়া সেনার নাম নেই! এই সত্যি গুলো মানুষের জানানোর প্রয়োজন নেই? জানাবে কে?
দেশভাগ জনিত সমস্যা বাংলাতেও আছে। বিজেপি ক্ষমতায় এলে বাংলাতেও এন আর সি হবে। বিপদে পড়বে কোটি কোটি বাঙালি। কারণ যে সব নথি চাওয়া হচ্ছে, তা বড় অংশের মানুষের কাছে নেই। কয়েক পুরুষ ধরে বাস করা কয়েক কোটি মানুষের এসব নথি নেই, চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি। উদ্বাস্তু হিন্দুদের একাংশ ভাবছে তারা সুরক্ষিত! পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের উপর রাগ থেকে এন আর সির মাধ্যমে মুসলমান তাড়ানোর গল্পে তারা বুঁদ হয়ে আছে। কিন্তু, আসামের বাস্তবতার কথা তাদের জানা প্রয়োজন। জানাবে কে? সংবাদমাধ্যম কাদের? মানুষের? কোনো ভাবেই মনে হয় না। শিল্পপতি ও কিছু রাজনৈতিক দলের। কেন বাংলার সংবাদমাধ্যম পাশের রাজ্য আসামের বিপন্ন বাঙালির কষ্টের কথা তুলে ধরবে না? কেন সত্যটা নির্মোহ ভাবে জনগণের সামনে পরিবেশন করা হবে না? কাদের স্বার্থে সংবাদ মাধ্যম চুপ? টিভি খুললে, “ফেসবুক খুলে লগ ইন করতেই অসুস্থ কিশোর”- এধরনের খবর দেখা যায়, আরও কত অপ্রয়োজনীয় খবরের ভিড়। কিন্তু আসামের এন আর সি নিয়ে কেন তারা উদাসীন? কেন ঘন্টাখানেক তর্ক হয় না আসাম নিয়ে? কেন নিউজ আওয়ার এ উপেক্ষিত আসামের বাস্তবতা?
প্রশ্ন করুন। উত্তর খুঁজুন! সত্য না দেখালে কার লাভ? কার ক্ষতি? এটা তো বাঙালির অস্তিত্বের প্রশ্ন! নাগরিকত্বের প্রশ্ন! নাহলে বাঙালি নিজভূমে পরবাসী হবে। উদ্বাস্তু হওয়াই ভবিতব্য!!
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )