জগৎখ্যাত শিক্ষাসত্র প্রেসিডেন্সির সমাবর্তন হচ্ছে বিনোদন কেন্দ্র নন্দনে! অনুষ্ঠানে আচার্য রাজ্যপাল অনুপস্থিত। শিক্ষাবিদ বুদ্ধিজীবী গণ্যমান্যদের ভিড়ও নগণ্য। ছাত্রছাত্রীরা নেই। প্রাক্তন কিছু ছাত্রছাত্রী দূর-দূরান্ত থেকে সমাবর্তনে যোগ দিতে এলেও অনুষ্ঠান মঞ্চে যথাযোগ্য সমাদর বঞ্চিত। এবং সঙ্গত কারণেই খানিকটা হতাশ, বিমর্ষ। তার মধ্যেই মঞ্চে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অনুরাধা লোহিয়া ভারতরত্ন বিজ্ঞানসাধক সি এন আর রাও এবং প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো দুই মহাপ্রতিভাকে সাম্মানিক ডি-এসসি, ডি-লিটে সংবর্ধিত করলেন। আর তাঁদের উজ্জ্বল উপস্থিতি প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই নিতান্ত অনাড়ম্বর সাদামাটা সমাবর্তন মঞ্চে কয়েক ঝলক দীপ্তি ছড়িয়ে গেল। তাতে গোটা অনুষ্ঠানের ম্লানতা কতটা ঘুচল বলা মুশকিল।
তবে রাজ্যে ও রাজ্যের বাইরে প্রেসিডেন্সির খানিকটা মুখরক্ষা হয়তো হল। হোক বা না হোক, মঙ্গলবার ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রেসিডেন্সির এমনই এক সমাবর্তনের সাক্ষী থাকল বাংলার শিক্ষাসমাজ। অবশ্য এমনটা এই শিক্ষাসত্রের ক্ষেত্রে এই প্রথম এমনটা বলা যাবে না। কারণ, এর আগে একাধিকবার প্রেসিডেন্সির গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান পরিস্থিতিগত কারণে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। দু’বছর আগের সমাবর্তন হয়েছিল রবীন্দ্রসদন প্রেক্ষাগৃহে। গত বছর প্রেসিডেন্সির দুশো বছরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানও ক্যাম্পাসে হয়নি, হয়েছিল প্রিন্সেপঘাটে! আর এবার সমাবর্তন হল নন্দন তিন প্রেক্ষাগৃহে। প্রতিবারই কোনও না কোনও বিষয় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে গোলমেলে পরিস্থিতি ঘনিয়েছে আর তার প্রভাব পড়েছে অনুষ্ঠান আয়োজনে। এবার ইস্যু হিন্দু হস্টেল! হস্টেল সংস্কারে কেন এত সময় লাগছে, জবাব চাই, জবাব দাও! জবাব না পাওয়া অব্দি অবস্থান আন্দোলন—চলছে, চলবে! প্রেসিডেন্সির ঐতিহ্য মর্যাদা সমাবর্তন সব চুলোয় যাক!
অনেকেই জানেন, প্রেসিডেন্সি দূরাগত পড়ুয়াদের সুবিধার জন্যই সিন্দু হস্টেল। সমাজ-রাজনৈতিক অনেক ইতিহাসেরও সাক্ষী এই হস্টেল। কিন্তু, উপযুক্ত সংস্কারের অভাবে বহু বছর যাবৎই হস্টেলটির দশা বেশ করুণ হয়ে উঠেছিল। আশির দশকে আমাদের ছাত্র জীবনে হস্টেলের দশা তবু খানিকটা পঠনপাঠন ও বসবাসের যোগ্য ছিল। তারপর দিন কে দিন খারাপ হয়েছে। বছর কয়েক আগে বিশেষ প্রয়োজনে হস্টেলে ঢুকে কটু গন্ধে আর আবর্জনার দাপটে তিষ্ঠোতে পারিনি। পালিয়ে এসেছিলাম। ভাবছিলাম, এই হস্টেলে পড়ুয়ারা থাকে কী করে! এমন প্রায়-নরক পরিবেশে পড়াশুনো হয়। হতে পারে! তো, যখন শুনলাম রাজ্য সরকার সেটি সংস্কারের উদ্যোগ নিচ্ছেন তখন আর পাঁচজন প্রাক্তনীর মতো আমারও একটা স্বস্তি বোধ হয়েছিল।
কিন্তু, সেই সংস্কার নিয়েও যে একদিন পড়ুয়াদের আন্দোলন দেখতে হবে, গেট আটকে উপাচার্য, অধ্যাপক-অধ্যাপিকাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে বাধা দেওয়া হবে, সমার্তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান অমন নমো নমো করে মহানগরীর একটি বিনোদন কেন্দ্রে সারতে বাধ্য করা হবে—সত্যিই বলছি ভাবতে পারিনি। আমাদের সময়কার প্রেসিডেন্সি কলেজে আন্দোলন হয়েছে, তার আগেও হয়েছে অঢেল। কিন্তু, আন্দোলনের নামে এমন ছেলেমানুষী ও উচ্ছৃঙ্খল উচ্ছ্বাস কখনও দেখিনি।
সত্যি বলতে কী, বেশ কিছু বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পরিসরে কিছু একটা হলেই প্রেসিডেন্সি ও যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীদের একাংশ (খুবই ক্ষুদ্র একটা অংশ) তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গৌরব গরিমা ভুলে একটা হৈদাঙ্গামার্কা আন্দোলনে নেমে পড়ে। তখন তাদের কারও কারও আচরণ দেখলে ভাবা কষ্টকর হয় যে, এরা ওই দুই ঐতিহ্যমণ্ডিত শিক্ষা কেন্দ্রের ছাত্রছাত্রী। তাদের এই আচরণ কতটা ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ আর কতটা উস্কানিমূলক রাজনীতির বিদ্বেষ বিষ প্রসূত—তা সকলেই আজ জানেন, বোঝেন। তা নিয়ে বিশদ আলোচনার প্রয়োজন আছে বলে মনে করছি না। সেই যেদিন কলকাতার এক বৃষ্টিভেজা দিনে যাদবপুরের ‘ছাত্রছাত্রীদের প্রতিবাদ’ মিছিলে প্রাক্তনী হিসেবে সিনেমা নায়িকার আবির্ভাব এবং সিক্ত পদচারণা ঘটেছিল সেদিন থেকে সাম্প্রতিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের লোহার গেটে হাড় ভাঙার বিপদ তুচ্ছ করে ক্রোধদীপ্ত পদাঘাত—ঠিক কীসের প্রেরণায় কোন উচ্চতর রাজনৈতিক আদর্শের প্রণোদনায় আজও বুঝে উঠতে পারিনি। আসলে ব্রিটিশ কলোনিকাল থেকেই আন্দোলনের কতকগুলো রূপরেখা আমাদের মধ্যে বদ্ধমূল হয়ে গেঁথে গেছে। তার মধ্যে অন্যতম হল—অসহযোগ। মানব না শুনব না, বুঝব না। যা বলা হচ্ছে সেটা মানতে হবে নইলে…! যুক্তি বুদ্ধি বোধ সেখানে যেন কিছুই কিছু না!
হিন্দু হস্টেল নিয়ে আন্দোলন দেখতে দেখতে এমন মনে হওয়া কি অস্বাভাবিক? এমন একটা বড় হস্টেলের সর্বাঙ্গীণ সংস্কার কি রাতারাতি হতে পারে? পারে না। তার ওপর সরকারি দপ্তরের ব্যাপার। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কড়া নজরদারিতে এ আমলে সরকারি কাজকর্মের গতি কত বেড়েছে সেটা একটু পক্ষপাতহীন তুলনার দৃষ্টিতে দেখলেই মালুম হবে। তো, হিন্দু হস্টেলের বেলাতেও নিশ্চয়ই তার অন্যথা হচ্ছে না। এবার শুনছি দাবি হল, যেটুকু অংশ সারানো হয়েছে সেটুকু পড়ুয়াদের হাতে তুলে দিতে হবে—মানে তাদের থাকতে দিতে হবে। এটা পড়ুয়াদের দাবি। মানলাম। কিন্তু, হস্টেলটা তো বিশ্ববিদ্যালয়ের। প্রেসিডেন্সি কর্তৃপক্ষ যদি ঠিক করেন পুরোটা সংস্কার করে সাজিয়ে-গুছিয়ে তারপর পড়ুয়াদের দেবেন এবং সরকার যদি তাতে সহমত হন—তবে দাবি করার জায়গাটাই কি থাকে? হস্টেলটা তো প্রেসিডেন্সি পড়ুয়াদের অধিকার অর্থাৎ রাইট নয়, প্রিভিলেজ। দূরাগত ছাত্রদের প্রতিষ্ঠানের কাছাকাছি থেকে পঠনপাঠনের সুবিধার্থে প্রতিষ্ঠানের সহৃদয়তায় থাকার একটি ব্যবস্থা। সেই ব্যবস্থার সুবিধা পেতে অনুরোধ-উপরোধ চলতে পারে—আন্দোলন হয়! আর এমন আন্দোলন যা কিনা প্রকারান্তরে রাজ্যে, রাজ্যের বাইরে দেশ-বিশ্বে প্রেসিডেন্সির মতো এমন একটা ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রতিষ্ঠানের মান-মর্যাদায় আঘাত করে, তার গরিমা-গৌরবের হানি ঘটায়!
মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, শিক্ষামন্ত্রী বলছেন—শিক্ষাপ্রাঙ্গণে অশান্তি বন্ধ করতে কতরকম নিদান দিচ্ছেন। কিছুতেই কিছু না! দলের ছাত্র সংগঠনের সমাবেশে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে বললেন, ছাত্র রাজনীতিতে নিষ্ঠা কমে যাচ্ছে। নিষ্ঠাবান হও, আয়নায় আপন মুখ দেখ, উপযুক্ত হও, চরিত্রবান হও—এমনি বললেন? শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও তো ক’দিন আগে অন্তত দুটি নিদান দিলেন— এক, ছাত্র সংগঠনে কেবল ছাত্ররাই থাকবে। দুই, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ঘেরাও করা যাবে না। অসম্মান, অমর্যাদা করা চলবে না। এসব কি শিক্ষামন্ত্রী কেবল বলার জন্যই বলেছেন? হতে পারে? কিন্তু, তথাকথিত আন্দোলনকারী পড়ুয়াদের দেখলে তো তাই মনে হয়। না হলে নিজেদের যুক্তি দাবি খতিয়ে না দেখে কথায় কথায় আন্দোলন আর অশান্তি খাড়া করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অচল করে কেউ? কিছুদিন আগে প্রবেশিকা নিয়ে যাদবপুরে একপ্রস্থ হল। তখন একবারও কি ভাবা হল—বিশ্ববিদ্যালয়ে অতগুলো বিভাগ থাকতে মাত্র ছ-সাতটাতেই প্রবেশিকা কেন? শিক্ষামন্ত্রীর সময়োচিত হস্তক্ষেপ এবং সক্রিয়তায় শেষ অব্দি অবশ্য ‘আন্দোলন’ দিশা হারিয়ে ভূগর্ভস্থ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত পড়ুয়ারা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। তারপর এই হিন্দু হস্টেল!
এরপর যদি কেউ সন্দেহের চোখ তুলে প্রশ্ন করেন, কারণে অকারণে গোল বাধিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অশান্তি জিইয়ে রাখতে চাইছে কারা—অন্যায় হবে কি? ছাত্রদের রাজনীতি করায় যাঁরা কিছুমাত্র আপত্তি তোলেন না, তাঁদের অনেকেও কিন্তু সাম্প্রতিকের ‘ছাত্র-রাজনীতি’র ভাবগতিকে সন্দিহান, বিরক্ত। তার কারণ, অনেকেই বুঝতে পারছেন—যেন তেন প্রকারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলতে যে রাজনীতি দিনরাত এক করে বসে আছে আর ফন্দিফিকির খুঁজছে, সেই রাজনীতিই ছাত্রদের একাংশকে হাতিয়ার করেছে। এবং মেধাবী প্রেসিডেন্সি ও যাদবপুরে সেই রাজনীতির প্রকোপই ক্রমশ লাগামছাড়া হতে চাইছে। অন্য প্রতিষ্ঠানেও প্রভাব পড়ছে তার। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক নিদান এই ছাত্র রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের একটি প্রয়াস হিসেবে চিহ্নিত হতেই পারে।
তবে, এই নতুন ধরনের উস্কানিমূলক ছাত্র রাজনীতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তাঁর সরকার যে কণামাত্র উদ্বিগ্ন হবেন না তা বলাই বাহুল্য। সত্যি বলতে কী, ওই খুচখাচ হুজ্জোতে মমতা সরকারের কিসসু যায় আসে না। যাঁরা ভাবছেন, ছাত্র খেপিয়ে রাজনৈতিক অভিসন্ধি সিদ্ধ করবেন—তাঁরা মূর্খের স্বর্গ ছাড়া কোথাও জায়গা পাবেন না। কিন্তু, এইসব উৎকট আন্দোলনের জেরে বাংলার এক কালের গর্ব প্রেসিডেন্সি বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠান যদি বিশ্বের দরবারে মান হারায়, যদি তাদের শিক্ষাগত উৎকর্ষ ও শৃঙ্খলা নিয়ে দেশ-বিশ্বের শিক্ষামহলে সংশয়ের সৃষ্টি হয় তবে আখেরে তা যে বাংলার শিক্ষা-সংস্কৃতির ভবিষ্যতের পক্ষে যথেষ্ট কল্যাণকর হবে না—তাতে সন্দেহ কী? এখন আন্দোলনমুখী ‘মেধাবী’রা এই সত্যটি যত তাড়াতাড়ি বোঝেন ততই মঙ্গল। নান্য পন্থাঃ।
(সৌজন্য:- বর্তমান)