গণেশের চাহিদা বাড়তে থাকায় মার খাচ্ছে বিশ্বকর্মা! গণেশ গড়ার যে পরিমাণ অর্ডার আসছে পটুয়াপাড়ায়, বিশ্বকর্মার ক্ষেত্রে তা অনেকটাই কম। গত কয়েকবছর ধরেই এই ‘ট্রেন্ড’-টি ধীরে ধীরে প্রকট হচ্ছে রাজ্যে। এবার প্রাক-শারদোৎসবের এই সময়ে কুমোরটুলিতে ঢুঁ মারলে চিত্রটা আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে। দিন সাতেক পরেই বিশ্বকর্মা পুজো। আর তার আগেই রয়েছে সিদ্ধিদাতার আরাধনার পঞ্জিকা নির্ধারিত দিনক্ষণ। বিগত বছরগুলিতে দেখা গিয়েছে, বিশ্বকর্মা পুজোর সপ্তাহখানেক আগে থেকে শিল্পীরা ওই মূর্তি গড়তেই ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। কয়েকদিনের জন্য দুর্গাপ্রতিমা তৈরির কাজ চলে যেত কিছুটা ব্যাকফুটে। ছোটখাটো কারখানা, শহরের অলিগলিতে ছড়িয়ে থাকা লেদ, ওয়ার্কশপের জন্য বিশ্বকর্মা মূর্তি তৈরি করতেন শিল্পীরা। পুজো আসার আগে বিশ্বকর্মার হাত ধরেই শিল্পীদের হাতে আসত কিছু উপার্জন। এবার কুমোরটুলি ঘুরে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বকর্মার সেই জায়গা ‘দখল’ করে নিয়েছে সিদ্ধিদাতা গণেশ। বিশ্বকর্মা যে একেবারে তৈরি হচ্ছে না, তাও নয় অবশ্য। তবে গণেশের দাপটের কাছে শিল্পী ও নির্মাতাদের দেবতার মহিমা কিছুটা নিষ্প্রভ তো বটেই।
তাই আপাতত কুমোরটুলি ব্যস্ত পার্বতীর জ্যেষ্ঠ পুত্রকে নিয়ে! মৃৎশিল্পীরা এখন গণেশের মূর্তির চূড়ান্ত সাজগোজ সারতে ব্যস্ত। আজ, সোমবার থেকে বেরতে শুরু করবে গণেশ মূর্তি। রবিবার সারাদিনে শেষ মুহূর্তের ‘টাচ’ দিতে মগ্ন থাকলেন শিল্পীরা। একাধিক শিল্পীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ক্রমবর্ধমান গণেশ পুজোর কথা। কেন বিশ্বকর্মা মূর্তি তাঁরা আগের চেয়ে কম তৈরি করছেন, মিলল তার ব্যাখ্যাও। ভক্তি, বিশ্বাস ইত্যাদি বিমূর্ত ধারণার নির্মাণে অর্থনীতিই যে আসল সূচক— পাওয়া গেল সেই ব্যাখ্যাও। প্রতিমা শিল্পী সুভাষ পাল বলেন, আমি অন্যান্য বছর প্রায় ৫০টি বিশ্বকর্মা তৈরি করতাম। পাঁচ-ছ’ফুট উচ্চতার মূর্তিগুলি বিক্রিও হয়ে যেত প্রায় সবক’টাই। এই বছর একটাও করিনি। আর গণেশঠাকুর তৈরি করতাম ৫-৭টি। সেই জায়গায় এবার ১৫টি গণেশঠাকুর তৈরি করছি। কিন্তু কেন এমন সিদ্ধান্ত নিলেন? প্রবীণ শিল্পীর সাফ জবাব, অতগুলি বিশ্বকর্মা তৈরি করে যে টাকা পেতাম, মাত্র ১৫টি গণেশ তৈরি করে একই বা তার চেয়েও বেশি লাভ পাব। আর গণেশের চাহিদা দিন কে দিন বাড়ছে। আরেক শিল্পী চিন্ময় পাল বলেন, গণেশপুজো কারা করছেন, লক্ষ্য করুন। তাহলেই বুঝতে পারবেন, কেন বিশ্বকর্মাকে টেক্কা দিচ্ছে গণেশ! কীভাবে তা বোঝা সম্ভব? উত্তরে চিন্ময়বাবু বলেন, বড়বাজারের বড় ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে শহর কাঁপানো প্রোমোটাররা করছেন গণেশ পুজো। এলাকার হোমরাচোমরা রাজনৈতিক নেতার পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজন হচ্ছে গণেশের আরাধনা।এই পুজোগুলোর বাজেটও অনেক বেশি।মূর্তির দাম কিছুটা বেশি হলে তাঁরা তাতে অতটা পাত্তা দিচ্ছেন না। ফলে শিল্পীদের ঘরে একটু বেশি টাকা ঢুকছে। এটাই আসল কারণ। কুমোরটুলি মৃৎশিল্প সংস্কৃতি সমিতির সম্পাদক রঞ্জিত সরকার বলেন, গণেশের মূর্তি তৈরিতে শিল্পীদের উৎসাহিত হওয়ার আরেকটি ‘টেকনিক্যাল’ কারণ আছে বলে মনে হয়। গণেশ মূর্তি তৈরির জন্য বেশি খরচ করতে হয় না। অন্য মূর্তির ক্ষেত্রে অলঙ্কার, জরির কাজ ইত্যাদি নানা বিষয় থাকে। সেসব এই মূর্তির ক্ষেত্রে কম দরকার পড়ে। এটাও একটা কারণ হতে পারে। বছর বছর ‘গণপতি বাপ্পা মোরিয়া’ ধ্বনির ভিড়ে ক্রমশই হারিয়ে যাচ্ছে বিশ্বকর্মার উদ্দেশ্যে বলা, ‘আসছে বছর আবার হবে’ ধ্বনি।