জাতীয় পঞ্জি সংশোধনের কাজ শুরু হওয়ার আগে থেকেই অশান্তির আঁচ পাওয়া গিয়েছিল আসামের সর্বত্র। ক্রমে অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে আরও। সেই ধারা এখনও অব্যাহত। ‘লাভ জিহাদ’-এ প্ররোচনা থেকে শুরু করে, আরও নানারকম তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে অশান্তি বাধানোর চেষ্টা চলছে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায়। একইসাথে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ানোর চেষ্টাও অব্যাহত। যার পরিপ্রেক্ষিতে শাসক দল বিজেপিরই দুই বিধায়কের নামে পুলিশে এফআইআরও দায়ের করা হয়েছে। একটি এফআইআর অবশ্য প্রত্যাহার করা হয় রহস্যজনকভাবে। পুলিশে বিজেপি বিধায়কদের নামে এফআইআর হলেও তাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না জনপ্রতিনিধিরা।
শিলচর শহরে লাভ জিহাদের প্ররোচনার অভিযোগে এক যুবককে গণপিটুনিতে উস্কানির অভিযোগ ওঠে বিধায়ক দিলীপ পালের বিরুদ্ধে। একই সঙ্গে এফআইআরে শিলচরের এই বিধায়কের দুই দেহরক্ষীর নামও উঠে আসে। কিন্তু পরে সেই এফআইআর প্রত্যাহৃত হয়। কারণ জানা যায়নি। বিজেপি সূত্রের খবর, ছেলেটি বিভিন্ন জায়গায় লাভ জিহাদের প্ররোচনা দিচ্ছিল। মানুষ উত্তেজিত হয়ে গণপ্রহার করে। বিধায়ক মোটেই এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। এমনকি, এফআইআর প্রত্যাহারেও নাকি বিধায়কের কোনও হাত নেই।
এনআরসি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে একের পর এক ‘বোমা’ ফাটিয়ে চলেছেন অসম বিজেপির আরেক বাঙালি বিধায়ক শিলাদিত্য দেব। ইতিমধ্যে তাঁর নামেও এফআইআর হয়েছে। ‘বেফাঁস’ মন্তব্যের অভিযোগ। কিন্তু থামবার কোনও লক্ষণ নেই। এদিন তাঁর অভিযোগ, মুসলিমরা নাগরিকত্ব পেলেও হিন্দুরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তাঁর মতে এনআরসি-র কোনও মূল্য নেই। ঘুষ দিয়ে তোলা হচ্ছে নাম। শুধু সরকারের ১২ হাজার কোটি টাকা জলে যাচ্ছে বলে মনে করেন এই বিজেপি বিধায়ক। তাঁর আরও অভিযোগ, এনআরসির কারণেই রাজ্যে উন্নয়নের কাজ থমকে আছে। কারণ সকলেই ব্যস্ত এনআরসি শুদ্ধিকরণের কাজে। তিনি অবশ্য প্রথম থেকেই এনআরসি-র পাশাপাশি অসম চুক্তিরও বিরোধী। তাঁর মন্তব্য, ‘আসামচুক্তি রাজ্যের অভিশাপ। ৭১ নয়, ৫১-র পরে আসা মুসলিমদের বার করে দিতে হবে। নাহলে অসম হয়ে উঠবে আরও একটি পাকিস্তান!’ তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলি নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে গোটা রাজ্যে ৪০টিরও বেশি মামলা রয়েছে। কী হবে! বড়জোর আগামী নির্বাচনে আমাকে সবচেয়ে বড় সমাজবিরোধী বলা হবে! কী আর করা যাবে।’ বিষয়টিকে তিনি আমলই দিচ্ছেন না, উল্টে মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই আরও আক্রমণাত্মক কথাবার্তা চালিয়ে যান।
প্ররোচনামূলক মন্তব্যের পাশাপাশি বরাক উপত্যকার করিমগঞ্জের একটি জুনিয়র প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভেন্টিলেটরে ‘৭৮৬’ লেখা থাকায় সেখানেও অশান্তির চেষ্টা চলছে পুরোদমে। স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সম্পাদক আবদুল সুক্কুরের বিরুদ্ধে সোচ্চার গ্রামের কিছু মানুষ। স্কুলের বিল্ডিংয়ে সরস্বতী থেকে শুরু করে বিভিন্ন হিন্দু দেব- দেবীর ছবি থাকলে দোষ নেই। কিন্তু ‘বিশমিল্লাহ আল-রহমান আল-রহিম’ শব্দগুলির অর্থবহনকারী ৭৮৬ লেখায় দোষ খুঁজে পাচ্ছেন স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র অমল নাথ। তিনি জানান, ‘আমার বাবা ১৯৬১ সালে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। আমিও এই স্কুলেরই ছাত্র। মুসলিম ধর্মের প্রচারে এধরনের সংখ্যা লেখার আমরা বিরোধী।’ এ বিষয়ে স্থানীয় বিধায়ক কমলাক্ষ দে পুরকায়স্থ অভিযোগ করেন, আরএসএসের মদতেই এসব হচ্ছে। বিভিন্নভাবে অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। তিনি বলেন, ‘স্কুলে বাচ্চারা মিড ডে মিল পাচ্ছে কিনা বা গ্রামের গরিব হিন্দুদের ঘরে চাল আছে কিনা, সেসব বিষয়ে আরএসএসের কোনও মাথা ব্যথা নেই। শুধু ওঁ আর ৭৮৬ নিয়ে ওদের মাথাব্যাথা।’ একইসঙ্গে শিলাদিত্যেরও সমালোচনা করেন কংগ্রেসের এই বিধায়ক। তাঁর অভিযোগ, বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা বলে মানুষকে অশান্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছেন এই বিধায়ক। প্ররোচনামূলক কথাবার্তা বললেও শিলাদিত্যের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা না নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য এবং আসামের রাজ্য নাগরিক অধিকার সুরক্ষা সমন্বয় সমিতির চেয়ারম্যান তপোধীর ভট্টাচার্যও এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তাঁর মতে, বিজেপি এখন উন্মাদ হয়ে উঠেছে। ধর্মের নাম উন্মাদনা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে দিকে দিকে। মানুষের মনে প্রতিহিংসার জন্ম দিতে চাইছে বিজেপি। ভারতের সংবিধানকেও মানতে নারাজ এই অসহিষ্ণু দলটি।
দিনে দিনে অবস্থার অবনতি ঘটছে আসামে। জাতীয় পঞ্জি নিয়ে বিজেপি ও বিরোধীদের মধ্যে রাজনৈতিক তর্জায় রাজ্যের আবহাওয়া এমনিতেই উত্তপ্ত। তার উপর বিজেপি বিধায়কের প্ররোচনামূলক মন্তব্য ধর্মীয় অস্থিরতার পালেই হাওয়া জোগাচ্ছে আরও।