তিনি জীবনমুখী। তিনি কেয়ার অফ ফুটপাথ। তিনি নীলাঞ্জনার স্রষ্টা। তিনি আনখশির সৎ মানুষও। তিনি নচিকেতা চক্রবর্তী।
প্রশ্ন: আপনি এবং কবীর সুমন প্রায় সমসাময়িক। কিন্তু দু’জনের প্রেক্ষাপটে বিস্তর ফারাক। তাঁর শিক্ষা, বিদেশি হালচাল, গানের তালিম সব থেকেই আপনার মধ্যবিত্ত প্রেক্ষাপট কয়েক যোজন দূরে। সুমন–ঝড়ে দাঁড়িয়েও নিজেকে ব্র্যান্ড বানালেন কীভাবে?
নচিকেতা চক্রবর্তী: কবীর সুমন কি ডাইনোসর নাকি যে তিনি পাশে থাকলে আর কেউ মাথা তুলতে পারবে না! সে তো নাজিয়া হাসান বলেও একটা ঝড় উঠেছিল। তাই বলে কি লতা মঙ্গেশকর নিভে গেলেন? সোজা কথা হল, যে ব্র্যান্ড হওয়ার সে ব্র্যান্ড হয়ই। আমি ব্র্যান্ড হওয়ার জন্যই মার্কেটে এসেছিলাম।
প্রশ্ন: একদা কট্টর বামপন্থী। সুভাষ চক্রবর্তীর কাছের মানুষ। ক্রমে অনেক শিল্পী বামপন্থা থেকে সরে এলেও আপনি থেকে গেলেন। এসএফআইয়ের অনুষ্ঠান পেতে লাগলেন। নিজের জমি দখলেই কি বামপন্থাকে ব্যবহার করেছিলেন তখন?
নচিকেতা: আমি তো এখনও বামপন্থী। তবে সিপিএম নই। একটা কথা বুঝে নিতে হবে— যে লোকটা ব্যবসা দিতে পারে, প্রচার দিতে পারে, তার হাত সকলে ধরতে চায়। আমি সেটা পারতাম। তাই সিপিএম আমার হাত ধরেছিল।
প্রশ্ন: কিন্তু রাজ্যে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের আগে থেকেই আপনি রং পরিবর্তন করে মমতা ব্যানার্জির কাছাকাছি এলেন। তিনি রেলমন্ত্রী থাকাকালীন রেলের একচেটিয়া অনুষ্ঠানও পেলেন। কেরিয়ার বাঁচাতেই কি দিদির কাছাকাছি যাওয়া?
নচিকেতা: দিদির কাছাকাছি যাইনি। সিপিএম–এর বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিলাম। মমতা ব্যানার্জির রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে আমার মতাদর্শের ছিটেফোঁটাও মিল নেই। কিন্তু আমার সঙ্গে দিদির ব্যক্তিগত সম্পর্ক যথেষ্ট ভাল। উনি রাজ্যের জন্য, রাজ্যের মানুষের জন্য যা করছেন, তাতে আমার মনে হচ্ছে, এই কাজ ৩৪ বছর বামফ্রন্ট জমানায় হয়নি। দিদিকে আমি স্যালুট করি। একসময় লেনিনকে গুলে খেয়েছি। লেনিনের ভাবাদর্শ আমাকে এই পন্থায় বিশ্বাসী করে তুলেছে। কিন্তু লেনিনকে চোখে দেখিনি। মমতা ব্যানার্জিকে দেখেছি। আমার মনে হয়েছে, ওঁর কাজকর্মে লেনিনিজম খুঁজে পাচ্ছি। ওঁর মধ্যে আমি লেনিনকে দেখতে পাই। হ্যাটস্ অফ। উনি একজন যথার্থ মুখ্যমন্ত্রী। কখনও বিপ্লব হলে কী হবে, সেটা পরের ব্যাপার। কিন্তু দিদির সঙ্গে রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে কথা বলতে বসলে ওঁর সঙ্গে আমার বিরোধ অবশ্যম্ভাবী।
প্রশ্ন: সেই বিরোধের ফলেই কি এমপি–মন্ত্রীর শিকে ছিঁড়ল না?
নচিকেতা: মন্ত্রী হওয়া আমার কাজ নয়। আমি যে কাজটা পারি সেটাই করি। নিজের গানের যোগ্যতায় বিশ্বাস আছে। তাই অন্য কিছুর হাত ধরতে যাইনি। সেজন্যই ২৫ বছর পরেও আমি ব্র্যান্ড।
প্রশ্ন: সিনেমার গানে সেভাবে হালে পানি পেলেন না কেন?
নচিকেতা: আমি যতগুলো সিনেমায় গান গেয়েছি সবক’টা হিট। তবু কেন ডাক পাইনি সেটা তো সিনেমার পরিচালক বা প্রযোজকরা বলতে পারবেন।
প্রশ্ন: অনেকে বলেন, আপনার গান শিক্ষিত–বুদ্ধিজীবীদের জন্য নয়। অহেতুক চেঁচামেচি, হল্লা আর কথার চমক। সত্যি?
নচিকেতা: বুদ্ধিজীবী আবার কী? বুদ্ধিজীবী বলে কিছু হয় না। সব ঢপবাজ। মিথ্যেবাদী। গানবাজনাই বোঝে না, তায় আবার বুদ্ধিজীবী আর সমালোচক! গানের কতগুলো কথা আওড়ালেই গান হয়ে যায় না। গান হল সুর–তাল। যাঁরা সো–কল্ড বুদ্ধিজীবী, তাঁরা কবিতাকে সুরে বললেই ভাবেন দারুণ গান হয়ে গেল। কীসের বুদ্ধিজীবী? সাদা পাঞ্জাবি গায়ে, কাঁধে ঝোলা নিয়ে ঠাণ্ডা ঘরে বসে থাকলেই বুদ্ধিজীবী হয়ে গেল? আমার কাছে যে রিক্সা চালায়, সে–ও বুদ্ধিজীবী। যে জুটমিলে কাজ করে, সে–ও বুদ্ধিজীবী। পৃথিবীতে দু–ধরনের শ্রমিক আছে। একদল মস্তিষ্ক খাটায় আর একদল পেশিশক্তি খাটায়। তাই ওসব বুদ্ধিজীবী–টিবি কিস্যু নয়। সব এক একটা বরাহনন্দন।
প্রশ্ন: আপনার ‘নীলাঞ্জনা’ ২৫ বছরে পা রাখল। এই হাইটেক প্রেমের সময়ে নীলাঞ্জনার লাল ফিতে সাদা মোজা খুব পুরনো কনসেপ্ট নয়? তাকে পুনর্নির্মাণের প্রয়োজন নেই?
নচিকেতা: এখনও কিন্তু সবথেকে বেশি টাকা নিয়ে আমি শো করি। আমার প্রত্যেকটা শো হাউসফুল। এটা থেকেই তো বোঝা যাচ্ছে— নীলাঞ্জনা চিরন্তন।
প্রশ্ন: আপনি নিজের গানের বিশেষণ দিয়েছিলেন ‘জীবনমুখী’। তা নিয়ে বিতর্কও হয়েছিল। কিন্তু সব শিল্পই তো জীবনমুখী। তাহলে নামটা কি মানুষকে বাড়তি চটক দিতে চেয়ে?
নচিকেতা: আমি আমার সৃষ্টির কী নাম দেব, সেটা আমার ব্যাপার। কারও পিতৃদেবের তা নিয়ে কিছু বলার অধিকার নেই।
প্রশ্ন: কিছুদিন আগে নাকি পল্লব কীর্তনীয়ার একটা গান আপনি স্যোশাল মিডিয়ায় নিজের বলে পোস্ট করেছিলেন। সত্যি?
নচিকেতা: আমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি? পল্লব আর আমার কণ্ঠ এবং কলম— দুটোই আলাদা। ওটা অন্য কেউ নিজের স্বার্থে করে থাকতে পারে। আমি কেন করতে যাব!
প্রশ্ন: এবছর দুর্গাপুজোর থিম সং গেয়েছেন। নচিকেতার কেরিয়ার কি তবে পড়ন্তবেলায় পৌঁছে গেল?
নচিকেতা: কেরিয়ারের সঙ্গে তো কোনও সম্পর্ক নেই। ‘পানিহাটি উদয়ন সঙ্ঘ’ আমাকে ওদের থিম সং গাওয়ার জন্য টাকা দিয়েছে। গেয়েছি। মিটে গেল। ইতিমধ্যেই ৬ লক্ষ ভিউয়ার হয়ে গেছে।
প্রশ্ন: তাহলে আপনার কাছে টাকাটাই সব?
নচিকেতা: ও মা! আমি তো টাকার জন্যই গান গাই! টাকাটাই সব বস্। যদি কোনওদিন নীরব মোদি হয়ে যাই, সেদিন আমি আর গান গাইব নাকি! আমি তো বু্দ্ধিজীবী নই। আমি শ্রমিক। ঘাম ঝরিয়ে গান গাই শুধুই বেঁচে থাকার জন্য। সমাজ বাঁচল কি বাঁচল না, সেটা সমাজের ভাবনা। আমার নয়। আমি যা করার করেছি। এখনও করছি। মূল্যায়ন হবে কি হবে না তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই।
(সৌজন্য:- আজকাল)