লালমোহন বাবু হুমকি চিঠি পেয়েছে। কে বা কারা একটা আনাড়ি হাতে লেখা চিঠি তার সবুজ অ্যাম্বাস্যাডারে ফেলে দিয়ে চলে গেছে। লেখা ছিল “রাজার বুকের ছাতি, বিদেশভ্রমন, ৫০০০ কোটির মূর্তি মাহাত্ম্য, দেশে ভালোদিন ইত্যাদি নিয়ে লিখুন নয়তো ঠাঁই, ঠাঁই, ঠাঁই”৷ চিঠিটা লাল আর হলুদের মাঝামাঝি কোন এক রঙের। আর চিঠির গা থেকে কড়া মূত্রের গন্ধ। ফেলুদা শুঁকে বললো কোন চারপেয়ে জন্তুর।
রজনী সেন রোডের ড্রইং রুমে আমরা তিনজন বসে। নিউজ চ্যানেলে আজও কি খাবার খেলে কোন ক্যান্সার হয় তা নিয়ে ডিবেট। ফেলুদা টিভিটা বন্ধ করে, দুটো ধোঁয়ার রিং ছেড়ে হঠাৎ বলে উঠলো,
“দাভোলকর, পানসারে, কালবুর্গিকে যে বন্দুক দিয়ে মারা হয়েছিল সেই ৭.৬৫ বোর পিস্তল দিয়ে একই ভাবে, একই দুরত্ব থেকে গৌরী লঙ্কেশকে মারা হয়৷ এরা কিন্তু সব সরকার বিরোধী লেখালেখির সাথে ছিল।”
লালমোহন বাবু সবে এক মুঠো ডালমুট মুখে দিয়েছিল। বিষম টিষম খেয়ে একশেষ। “মানে?”
ফেলুদা সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে সোফায় টান হয়ে বসল। এইবার ওর স্কুলমাস্টারের রূপটা ফুটে উঠবে।
একটা রুলটানা খাতার উপর লালমোহনবাবুর কলম ধার করে আঁকিবুঁকি কাটতে লাগলো।
“তোপসে লক্ষ্য কর৷ গৌরী লঙ্কেশের অভিযুক্তদের জেরা করতে গিয়ে বেরিয়ে পড়ে তারা দাভোলকর, পানসারে, কালবুর্গিকে ও মারার নির্দেশ পেয়েছিল৷ দাভোলকরকে মারা হয় যে বন্দুক দিয়ে সেই মার্ডার ওয়েপেন উদ্ধার হয় লঙ্কেশের খুনীদের বাড়ি থেকে। অপর এক অভিযুক্তকে জেরা করে এক ডায়েরি মেলে। সেখানে শুধু এই চারজন না, আরো অনেক যুক্তিবাদী, মগনলাল মেঘরাজদের ভাষায় তথাকথিত ‘urban naxal’ কে মারার ছকের হদিশ মেলে। যারা গ্রেফতার হয়েছে তারা চুনো পুঁটি। রাঘব বোয়ালরা এখনো বহাল তবিয়তে আছে রে।”
লালমোহন বাবু সেই থেকে হাঁ করে শুনছিল ফেলুদার কথা। এবার মুখটা বন্ধ করলো। একটা ঢোক গিলেই বলে, “হাইলি সাসপিশিয়স কেস মশাই৷ ওদিকে গড়পাড় রোডের চায়ের দোকানে আলোচনা চলছিল যে ডিমনেটাইজেশন…..”
মাঝপথে ফেলুদা থামিয়ে দিয়ে বলে, “কতোবার বলেছি, বাংলা ভাষায় লেখালেখি করেন, বাংলা ভাষার ব্যবহার বেশি করুন নয়তো ওই আপনার ফ্রেন্ড মেঘরাজজী কিন্তু আপনার পাতে শুক্তোর জায়গায় রাজমা আর দুর্গার জায়গায় শেরাওয়ালী ঢুকিয়ে দেবে৷ আপনি কিচ্ছু করতে পারবেন না।”
“মিসটেক মিসটেক। আর হবে না মশাই। উটের পাকস্থলীর মতো এটাও শুধরে নেবো” জটায়ু শুরু করলো।
“ইয়ে তো শুনলাম যে কালো টাকা উদ্ধারের জন্য যে পাঁচশো এবং হাজার টাকার নোট বাতিল করার পদক্ষেপ নিয়েছিল সরকার, যে জন্য জীবন হেল হয়ে গেছিল এটিএম আর ব্যাংক এ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, বুধবার রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তার রিপোর্টে জানিয়েছে, মোট ১৫,৩১,০৭৩ কোটি টাকা মূল্যের বাতিল নোট রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে ফিরে এসেছে ৷ যেটি বাতিল মোট টাকার ৯৯.৩ শতাংশ ৷ মানে ১% এর ও কম টাকা আসেনি। রিডিকিউলাস! তবে কালো টাকা গেল কই মশাই? আমাদের পণ্ডশ্রম”৷
“ওদিকে পেট্রল ডিজেলের দাম ৮০ ছোঁবে এবার দেখবেন। পাগল পাগল অবস্থা মশাই। সব জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া। ডলারও। ওদিন এক সাহিত্য সভায় এ সব নিয়ে বলতে গেলাম, রাতে ফোন এলো অচেনা নম্বর থেকে।”
“ফোন ওঠাতেই বলে, বলুন দেশমাতৃকার জয়। আমি বললাম, জয় বাবা ফেলুনাথ। কি গালাগালি,কি গালাগালি। বলে, কোথায় ছিলেন যখন শিয়াচেনে জওয়ান মরছিল, আমি মুখ ফসকে বলে ফেলেছি, গড়পাড় রোডে ছিলাম। ওমনি বলে আমি নাকি অ্যান্টি ন্যাশনাল। আমার সাথে নাকি মাওবাদীদের যোগ আছে। আমার ঘরে নিষিদ্ধ সাহিত্য আছে। আমাকে নাকি জেলে পোরা হবে।”
“ভাবুন একবার। আমি র্যাআক্সিট, গনডারিয়া আর প্রখর রুদ্রের বাইরে ৪০বছরে ও বেরোতে পারলাম না আর মাওবাদী। বাড়িতে তল্লাশি করলে হয়তো আমার পুরনো কিছু সাহারায় শিহরণের কপি আর গড়পাড়ের এথেনিয়াম ইন্সটিটিউটের স্কুল ম্যাগাজিন পাওয়া যাবে। “
এক নিশ্বাসে অনেকটা কথা বলে জটায়ু চায়ে চুমুক দিলেন। ঠক ঠক করে কাঁপছে হাত। ঘামছেন।
চুপ মেরে গেছে সবাই। আমি নিস্তব্ধতা ভেঙে বলতে শুরু করলাম। “এই যুদ্ধবিমান নিয়ে ব্যাপারটাও কিরকম গোলমেলে লাগছে তাই না ফেলুদা? এতো বড় একটা দেশের টেন্ডার পাইয়ে দেওয়া হল এমন একটা কোম্পানিকে যাদের কোম্পানিটাই তৈরি হয়েছিল দশ দিন আগে৷ যার মালিক করে ডুবে আছে আর যাদের যুদ্ধ বিমান বানানোর বা লাইসেন্স নেওয়ার কোন অভিজ্ঞতাই নেই৷ স্ট্রেঞ্জ না?”
ফেলুদা চারমিনার ধরালো একটা। সোফা ছেড়ে উঠে জানালার কাছে দাঁড়ালো৷ পড়ন্ত রোদে ছ’ফুটের মানুষটা বলতে শুরু করলো। পুরোটাই মনোলগ।
“লালমোহন বাবু আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন, হুমকি চিঠিটা আপনাকে আলাদা করে দেওয়া হয়নি৷ ওটা এদের প্রোপাগান্ডার অংশ। যে যেখানে সরকার বিরোধী কথা বলছে, লেখালেখি করছে, বক্তৃতা দিচ্ছে তাদের ভয় পাইয়ে দাও৷ দেশদ্রোহী বানিয়ে বাজারে লিঞ্চ হবার জন্য ছেড়ে দাও। লিঞ্চ না হলে গুলি করে ফেলে রাখো৷ বাকিরা আপসে রাজার বুকের ছাতি, বিদেশভ্রমন, ৫০০০ কোটির মূর্তি মাহাত্ম্য, দেশে ভালোদিন ইত্যাদি নিয়ে বন্দনা শুরু করবে। এর পর ও যদি উদয়ন মাস্টারের মতো বেয়াদবী করে তবে তাদের জন্য মাওবাদী তকমা তো আছেই৷ ইউএপি লাগিয়ে দিলেই হলো। নির্বাচন বৈতরণী পার করতে একটা এধরনের দুর্ধর্ষ দুশমন দরকারি৷”
জটায়ু: এতো ডেঞ্জারাস প্লট মশাই। নেটফ্লিক্স এর সেক্রেড গেমস, ঘৌলকেও ঘোল খাইয়ে দেবে। এরা এসব করে চার বছর টেনে দিলো কিরকম দেখলেন? এতো দেশ ঘুরলো ওই গ্লোবট্রটার মন্দার বোসের মত, একটা ও বিনিয়োগের কথা শুনলেন? উফ উফ ভাবা যায় না। কি ভয়ানক জুমলাবাজি!
ফেলুদা: আরো বাকি আছে লালমোহন বাবু৷ তৈরি থাকুন। এবার পোড়া মাংসের গন্ধ পাবেন। ঈদের সময় একটা সন্দেহের চোখ তৈরি হবে আর ভাতের বদলে যুদ্ধ উপহার পাবেন। প্রশ্ন করলেই মাও বা সন্ত্রাস বাদী।
জটায়ু: সত্যি মশাই, এই মগনলাল মেঘরাজ বেওসা টা বড্ড ভালো বোঝে। আর ভায়া তপেশ, ধর্ম থেকে বড় ব্যাবসা আর কি হতে পারে বলো এ দেশে?
ফেলুদা : তবে দাঁড়ালো কি? মৃত প্রতিবাদীদের ‘দে’ আর ইমারজেন্সির ‘শ’, মানে দেশ। দেশ বিপদে, এই সময় আরো বেশি করে লিখে যান লালমোহন বাবু। নাইফ থ্রোইং, হুমকি চিঠি, ইউএপিএ দিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা হবে। মানুষ দেখছে। আপনি লিখে যান। মাথায় রাখবেন, আপনি, তোপসে, ফেলু মিত্তির, মগনলাল মেঘরাজ না, মানুষই শেষ কথা বলবে।
(বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ এটি সত্যজিৎ রায়ের তিন চরিত্র অবলম্বনে একটি কাল্পনিক লেখা। এর সাথে বাস্তবের কোন তুলনা টানা অহেতুক৷ মিল থাকলে ও তার দায় লেখকের নয়। সেটি কাকতালীয়)