জলপাইগুড়ি থেকে জাকার্তা। যাত্রাপথটা মসৃন ছিল না। অদম্য জেদ, প্রতিকূলতার সাথে দাঁতে দাঁত চাপা লড়াইয়ে লেখা হলো এক বাঙালিনীর বিজয়গাথা।
জলপাইগুড়ির মেয়ে স্বপ্না বর্মন গলায় পরে ফেললেন এশিয়াডের সোনার পদক। এ যেন এক স্বপ্নের দিন ভারতের, রাজ্যেরও। ধন্যি মেয়ের হাতে লড়াইটা প্রথমটায় শুরু ঠিক হয়নি। দিনের শেষে একটু পিছিয়ে পড়েছিলেন। এগিয়ে গিয়েছিলেন চীনের ওয়াং কুইনলিং। বুধবার নতুন করে আবার শুরু করলেন। তাতেই ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল ‘চীনের প্রাচীর’। ৬০২৬ পয়েন্ট করে জিতলেন সোনার পদক। প্রথম দিনের শেষে যিনি শীর্ষে ছিলেন চীনের সেই ওয়াং কুইনলিং পেলেন দ্বিতীয় স্থান, ৫৯৫৪ পয়েন্টে।
হেপ্টাথলনের মতো কঠিন ইভেন্টে বাঙালির এই প্রথম এশিয়ান গেমসের সোনা জয়। শুধু তাই নয়, এশিয়ান গেমস থেকে ভারতেও হেপ্টাথলনের সোনা এল এই প্রথম। হেপ্টাথলনে এশিয়াডে বাঙালির পদক জয় অবশ্য নতুন নয়। এর আগে পরপর দু’বার রুপো জিতেছেন সোমা বিশ্বাস। ২০০২ ও ২০০৬ সালে। স্বপ্না হলেন চতুর্থ বাঙালি, যিনি এশিয়ান গেমসে ব্যক্তিগত সোনার পদক জিতলেন। এর আগের তিনজন শচীন নাগ (১৯৫১ সালে ১০০ মিটার ফ্রি স্টাইল সাঁতার), জ্যোতির্ময়ী শিকদার (জোড়া সোনা, ১৯৯৮ সাল ৮০০ ও ১৫০০ মিটার দৌড়), সরস্বতী সাহা (২০০২ সালে ২০০ মিটার দৌড়)।
বাবা পঞ্চানন বর্মন ভ্যান রিকশা চালাতেন। মা বাসনা ছিলেন চা বাগানের শ্রমিক। এরকম এক দরিদ্র পরিবারে স্বপ্নার জন্ম। এখানেই শেষ নয়। জন্মছিলেন দু’পায়ে ৬ টি করে আঙুল নিয়ে। যা নানাভাবে শারীরিক সমস্যায় ফেলে। ফলে নিয়মিত চিকিৎসা চালাতে হয়। যা দরিদ্র মা–বাবাকে আরও আর্থিক সঙ্কটের দিকে ঠেলে দেয়। এরকম দরিদ্র পরিবারে সাধারণত যা হয়ে থাকে, প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল পায়ের ওই সমস্যা কাটিয়ে মেয়েকে চা শ্রমিকের কাজ করার উপযুক্ত করে তোলা। কিন্তু তা হয়নি। ছোট্টবেলা থেকেই খেলাধুলোয় আগ্রহ দেখে বাবা–মা হাজার অসুবিধার মধ্যেও মেয়ের খেলাধুলো চালিয়ে যেতে সাহায্য করে যান। ২০১৩ সালে সংসারে আরও আর্থিক সঙ্কট দেখা দেয়। বাবার স্ট্রোক হয়। ফলে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। বলা যায়, সেই থেকেই ‘বেকার’।
এশিয়ান গেমসে প্রথম সোনার পদক হলেও এশিয়ান অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে আগে সোনা জিতেছেন চারুচন্দ্র কলেজের ছাত্রী স্বপ্না। সেটা গত বছরই ভুবনেশ্বরে। তারপরই অংশ নিয়েছেন লন্ডনে বিশ্ব অ্যাথলেটিক্সে। ওই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের পর থেকে টান প্রায় একবছর চোটের কারণে প্রতিযোগিতায় নামতে পারেননি। কিন্তু কখনও ভেঙেও পড়েননি। এবার জুন মাসে গুয়াহাটিতে আন্তঃ রাজ্য অ্যাথলেটিক্সে আবার প্রতিযোগিতায় ফেরেন। এশিয়াডের যোগ্যতামানও পার হয় ওখানেই। একই সঙ্গে পিঠের ব্যথার চিকিৎসা ও এশিয়াডের প্রস্তুতি চলতে থাকে। জাকার্তায় পৌঁছেও সমস্যা থেকে মুক্তি পাননি ২২ ছুঁই ছুঁই বয়সের লড়াকু মেয়েটি। দাঁতের ব্যথায় কাহিল। ব্যথা কমার ওষুধ নিয়ে গালে প্ল্যাস্টার লাগিয়ে দৌড়তে, লাফাতে হল। এটাও ওঁর একধরনের লড়াই। শেষ পর্যন্ত জয় হল ওঁর লড়াইয়েরই।
জিতলেন স্বপ্না। স্বপ্নার স্বপ্নের এই উড়ান আরো স্বপ্নাদের স্বপ্ন দেখাক।