খবরের কাগজে রাজনীতি, অর্থনীতির প্যাঁচপয়জার, খেলার পাতার হতাশা ও উত্তেজনার বেড়া টপকে মাঝে মাঝে এক অন্য হাওয়ার স্বাদ নিয়ে আসে হিউম্যান ইন্টারেস্ট স্টোরিগুলো। আমার এই স্টোরিগুলো ভালো লাগে। এরা যেন পাঠককে এক অচেনা জগতে পৌঁছে দেয়, তুলে ধরে অন্যরকম মানুষদের কথা। আজ সকালে এই সময় কাগজের ন-পাতাতে এমনই দুটো প্রতিবেদন পড়ে আমার সুচিত্রা দির মুখে শোনা রবীন্দ্রনাথের এই গানটির কথা মনে পরে গেল। সত্যিই তো, কান্না হাসি, আলো অন্ধকারের মধ্যে দিয়েই মানুষের পথ চলা।
দুটো স্টোরির একটিতে ছবিলা খাতুন নামে এক মহিলা কনস্টেবল আদিবাসী সিভিক ভলান্টিয়ার মেনকা মার্ডির গৃহহীন বোন প্রতিমা মার্ডিকে নিজের পরিবারের একজন হিসেবে শ্বশুর বাড়িতে ঠাঁই দিলেন। রাখি পরিয়ে কিশোরী প্রতিমাকে নিজের বোন করে নিয়েছেন তিনি। সন্তানের জন্ম দিতে না পারার জন্য শ্বশুর বাড়ির গঞ্জনা ছিল মেনকার রোজকার সঙ্গী। বারো বছরের কিশোরী বোন প্রতিমাকে দেখাশোনার কেউ নেই বলে তাকে তিনি নিজের কাছে এনে রেখেছিলেন। কিন্তু মেনকা মা না হতে পারার অপরাধে তার বোন প্রতিমাকে শ্বশুর বাড়ির লোকজন তাড়িয়ে দেয়। বারো বছরের কিশোরী প্রতিমা কোথায় যাবেন তা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন মেনকা। ছবিলা তার সেই সমস্যার সমাধান করেছেন। জাতি, ধর্ম, ভাষা কোনটাই ছবিলার মানবধর্ম পালন করার অন্তরায় হয়নি। বীরভূমের মহম্মদ বাজার থেকে এই মন ভালো করা প্রতিবেদনটি পাঠিয়েছেন হেমাভ সেনগুপ্ত।
ঐ পাতাতেই আরেকটা প্রতিবেদন আমার মন খারাপ করে দিল। কাটোয়া থেকে এই প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন অভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রতিবেদনের সঙ্গে দেওয়া ছবিতে আমি দেখলাম, একটা ঝুপড়ি ঘরে মৃত মায়ের শিয়রে চার বছরের দিদির কোলে বসে আছে দুবছরের ভাই। চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে মা যে মারা গেছে তা তারা এখনও বুঝতে পারেনি। কাটোয়া রেল স্টেশনের পাশে এই ঝুপড়িতে ছেলে বিশু আর মেয়ে মামনিকে নিয়ে থাকতো তাদের মা সরস্বতী। সরস্বতীর মদ্যপ স্বামী বহুদিন আগেই তাদের ছেড়ে চলে গেছে। কাগজ কুড়নো আর ভিক্ষা ছিল সরস্বতীর জীবিকা। মৃত্যুর খবর পেয়ে তার স্বামী এসে সৎকারের ব্যবস্থা করেছে, কিন্তু শিশু দুটির ভবিষ্যৎ এখনও অজানা। কারণ, তাদের বাবা কোনদিনই পরিবারের কোন দায়িত্ব নেয়নি।
আমরা সাংবাদিক কিংবা চিত্রসাংবাদিকরা এমনিতে শক্ত মানুষ, কিন্তু কখনো কখনো কোন ঘটনা আমাদেরও নড়িয়ে দেয়। সেই কথাটাই আজ আমাকে অভ্র বললো। সকালে খবরটা দেখার পরই আমি এই সময়ের চিফ ফটোগ্রাফার জয়ন্ত সাউয়ের মাধ্যমে অভ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করি। অভ্র বললো, খবরটা লিখতে তার সত্যিই খুব কষ্ট হচ্ছিল। বাচ্চা দুটোকে দেখে আমার মনে হল, ওরা ভাবছে, ওদের মা এখন ঘুমোচ্ছে, যে কোন সময় উঠে বসবে। অভ্র জানালো চার বছর আগে ছোট রেল চলার লাইনের পাশে একটা ঝুপড়িতে পরিবারটি থাকতো। সরস্বতীর স্বামী দেবীলাল মারান্ডিও তখন ওদের সঙ্গে ছিল। বিশু হওয়ার পর স্বামী চলে যায়। দুই শিশুকে নিয়ে ভিক্ষে করা শুরু করে সরস্বতী। ছেলে মেয়ে দুটি এমনিতে শান্ত।
সর্বশেষ সংবাদ হচ্ছে দেবীলাল ছেলে মেয়ে দুটোকে কাছাকাছি কোন একটা গ্রামে রেখে গেছে। গোটা ঘটনাতে স্টেশন সংলগ্ন দোকানদার, স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসন খুবই ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছেন। ছেলেমেয়ে দুটির ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা খুবই চিন্তিত। ওই এলাকায় কাজ করে এমন কিছু এনজিও খোঁজখবর রাখছে। আগে কেন খোঁজখবর নেননি এই প্রশ্নের জবাবে তারা জানিয়েছেন, স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় এমন মানুষ তো কম নয়, কত জনের খোঁজ রাখবো?
খবরের কাগজে সকালে হেমাভ আর অভ্রর স্টোরি দুটো পড়ার পর আমিও ভাবছি, সত্যিই কি আমার কিছু করার নেই? ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর মর্মস্পর্শী স্টোরি কিংবা ছবি করেই আমার সব দায়িত্ব শেষ? সকালে হাঁটার সময় ঝুপড়িবাসীর দুরাবস্থা কিংবা কোন পথশিশুর রাস্তা থেকে খাবার কুড়িয়ে খাওয়া দেখে সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু কমেন্টস আর ছবি দিয়েই কী আমার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? আমি কি শুধুই লাইক বা মানুষের প্রশংসার প্রত্যাশী? আমি কি শুধুই অবলোকিতেশ? শুধু দেখেই কি আমাদের কাজ শেষ হয়ে যায়? যদি তা না হয় তাহলে ঘটনা ঘটার আগে আমরা সক্রিয় হইনা কেন? পেশার বাইরে সামাজিক মানুষ হিসেবেও তো আমাদের একটা দায়িত্ব থেকে যায়। শুধুই অপরের দোষ ত্রুটি না ধরে সেই দায়িত্ব আমরা পালন করবো কবে? তাহলেই তো অবস্থা অনেকটা বদলাতে পারে।
এই লেখাটা আসলে আমার আত্ম সমালোচনা। আমি তো নিজেই একাজটা করি না। কাজ করা বলতে আমি কিন্তু কাউকে এককালীন কিছু টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করা বা নিজের ব্যাক্তিগত যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে পুলিশ বা প্রশাসনকে সহায়তা করতে বলার কথা বলছি না। আমি বলছি এই সহায়তা ও যোগাযোগের একটা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার কথা। যাতে কেউ সমস্যায় পড়ার আগেই ব্যবস্থা নেওয়া যায়। শুধুই কাটোয়া কিংবা মহম্মদ বাজারে নয়, আপনার আমার বাড়ির চারপাশে তো নানাভাবে সমস্যায় পড়া মানুষজন ও প্রতিবেশীরা রয়েছেন। তাদেরকে দিয়েই তো আমরা কাজটা শুরু করতে পারি। এই কাজের কোন নির্ভুল নকশা আমাদের হাতের কাছে নেই। ভুল ত্রুটির মধ্যে দিয়েই আমরা এগবো। স্থানীয় এনজিও, ক্লাব, উৎসাহী সমাজসেবী এবং উদ্যমী তরুণ তরুণী একাজের এক গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তি। এদের সহয়তা নিয়ে আমরা তৈরি করে ফেলতে পারি যাদের সহায়তা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তাদের চিহ্নিত করতে পারার মত একটা ওয়ার্ড বা পাড়াভিত্তিক ম্যাপ। এই ম্যাপ আর ইচ্ছে থাকলে দেখবেন ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর আমাদের আর আফসোস করতে হচ্ছে না। কিছু না কিছু ব্যবস্থা আমরা নিতে পারছি। আজকের সময়ে এও কী কম? আসুন সবাই মিলে একটু ভাবি, নাহলে অনেক দেরি হয়ে যাবে।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )