জীবন মানুষকে কতকিছু শেখায়। আজ মাদার টেরিজার ১০৮তম জন্মদিনে তেমনই এক শিক্ষার কথা মনে পড়ে গেল। আমরা কথায় কথায় বলি মায়ের চোখ সবকিছু ধরে ফেলতে পারে। কথাটা যে কতটা সত্যি তা আমাকে তিনিই বুঝিয়েছিলেন। আজ থেকে ১৬বছর আগের কথা, আমার ছোটছেলে পিকু তখনও হয়নি। আমার স্ত্রী নিবেদিতা মানে নূপুর তখন গর্ভবতী, আটমাস চলছে। একদিন সে কথায় কথায় বললো, আমাকে একদিন মাদারের কাছে নিয়ে যাবে? একটু অবাক হলাম, নিশ্চয়ই মাদারের সঙ্গে কোন ছবি তোলার আবদার। এমনিতে নূপুরের চাকরির বাইরে বই পড়া, গান শোনা আর সিনেমা দেখা ছাড়া আর কোন নেশা নেই।
কথাটা শুনে একটু চিন্তায় পড়ে গেলাম। মাদারকে চিনিনা তা বলা যাবেনা, ছবি তোলার সূত্রে মিশনারিজ অফ চ্যারিটিজেও বহুবার গিয়েছি। কিন্তু মাদারের দিনভোর ব্যস্ততা। হয়তো কোন কারণে সেদিন তিনি আর নিচে নামলেনই না কিংবা ভোরে কোথাও বেরিয়ে গেলেন,তাহলে ব্যাপারটা খুব খারাপ হবে। ওর মনের ওপর চাপ পড়তে পারে। তখন আমি সামলাতে পারবো তো? এইসব সাতপাঁচ যখন ভাবছি তখনই নূপুর বললো, তোমায় অত ভাবতে হবেনা। আমি শুধু দূর থেকে দেখবো, সুযোগ পেলে প্রণাম করবো।
এক শনিবার মিশনারিজ অফ চ্যারিটিজে হাজির হলাম আমরা। সেখানে যারা গেছেন তারা সবাই জানেন, ঢুকেই ডানদিকের চাতালে সিমেন্টের বেঞ্চে বসার জায়গা। সাতসকালেই সেখানে বসে আছেন কিছু বিদেশী ও স্থানীয় অতিথি। আমি নূপুরকে ওদের পাশেই বসিয়ে দিলাম। ক্যামেরা নিয়ে এদিক ওদিক করছি, বেলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ভিড়, বাড়ছে আমার টেনশন। আজকে মাদার নামবেন তো? বাড়িতে তাঁকে নিয়ে এত গল্প করেছি যে সবাই ভেবে বসে আছে, অশোক ডাকা মানেই মাদার বেরিয়ে আসবেন। এইসব ভাবতে ভাবতেই দেখি ঘরের পর্দা ঠেলে মাদার বেরিয়ে এলেন। হাতজোড় করে প্রণাম করলেন সবাইকে। অতিথিদের কেউ কেউ ততক্ষণে তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে ফেলেছেন। নূপুর দূরেই দুহাত জোড় করে দাঁড়িয়ে, আমার ইশারাটাও সে দেখছে না। কোনদিকে না তাকিয়ে শুধুই দুচোখ ভরে মাদারকে দেখছে সে। সাত-আট মিনিট এভাবে কাটিয়ে তিনি আবার ঘরে ঢুকে গেলেন। ঢোকার ঠিক আগেই আমি তাঁর চোখে পড়ে গেলাম। হেসে জানতে চাইলেন, কী ছবি তুলবে তুমি? ভাবলাম একবার বলি, মাদার আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে আপনার একটা ছবি তুলবো। কিন্তু তেমন কিছুই বলে উঠতে পারলাম না। দূরে তাকিয়ে দেখি নূপুর সেই একদৃষ্টিতে হাতজোড় করে যেন জগৎ সংসার ভুলে মাদারের দিকে তাকিয়ে আছে। আমাকে সে দেখতেই পাচ্ছে না। এই দৃশ্যপট পিছনে রেখে মাদার ঘরে ঢুকে গেলেন।
আমি খানিকটা হতভম্ব, স্ত্রীকে কী বলবো তা বুঝতেও পারছি না। আমার অবাক হওয়ার তখনও অনেক বাকি ছিল! হঠাৎ দেখি ঘরের পর্দা ঠেলে মাদার আবার বেরিয়ে এলেন। ভিড় ঠেলে তিনি সোজা চলে গেলেন নূপুরের কাছে। এ আমি কী দেখছি! নূপুরের মাথায় হাত রেখে মাদার কথা বলছেন। অবাক হয়ে গেলাম! ভুলে গেলাম এসময় আমার ওদের কাছে চলে যাওয়া উচিৎ। মাদারের সঙ্গে আমার স্ত্রীর পরিচয় করিয়ে দেওয়া দরকার। এসব কিছুই না করে একটা স্ট্যাচুর মত দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। হঠাৎই যেন হুঁশ ফিরলো আমার। নূপুরের সঙ্গে মাদারের কথা বলা তখন শেষ হয়ে গেছে। কোনমতে ক্যামেরা তুলে শাটার টিপলাম, মাদার আবার পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকে গেলেন।
বাড়ি ফেরার সময় ট্যাক্সিতে নূপুরের কাছে জানতে চাইলাম, মাদার কী বললেন? সে বললো, মাদার আমার পেটে ও মাথায় হাত বুলিয়ে জানতে চাইলেন কতদিনের প্রেগন্যান্সি? কী কর? আমার নাম নিবেদিতা শুনে উনি সিস্টার নিবেদিতাকে স্মরণ করলেন। আমি ইন্ডিয়ান আর্মির মেডিক্যাল কোরের ক্যাপ্টেন শুনে মাদার খুব খুশি হলেন। বললেন, খুব সাবধানে থাকবে, এখন রেস্ট নাও। সন্তান হওয়ার পর একদিন এসো। আসলে ভিড়ের মধ্যে আমি তোমায় প্রথমে সেভাবে দেখতে পাইনি। কিন্তু লক্ষ্য করেছিলাম তুমি সন্তানসম্ভবা, তাই ফিরে এলাম।
এই হল মায়ের চোখ! সন্তানদের সব সুবিধা অসুবিধা, ইচ্ছা অনিচ্ছাকে যে চোখ এক নজরে চিনে নিতে পারে। এই চোখ ছিল বলেই আলবেনিয়ার এক কিশোরী মেয়ে একদিন মাদার হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। পরবর্তীকালে সারা পৃথিবী তাঁকে সন্ত টেরিজা নামে চিনেছে। এই চোখই তাঁকে পৃথিবীর নানা প্রান্তে আর্ত মানুষদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। জাতি, ধর্ম ভুলে চিনতে শিখিয়েছে সারা পৃথিবীর দুস্থ ও দুর্গতদের। তাঁকে করে তুলেছে সবার মাদার। যার ব্রত সবাইকে ভালোবাসা ও সেবা। ভেদবুদ্ধি ও সাম্প্রদায়িকতা তাঁর মানবধর্মে কোন পাঁচিল তুলতে পারেনি। আজ মাদারের জন্মদিনে তাঁর সঙ্গে আর এক মায়ের দেখা হওয়ার গল্প বলার লোভটা সামলাতে পারলাম না। সেদিন মায়ের চোখে ধরা পড়ে গিয়েছিল আরেক মা।
সাংবাদিক জীবনে মাদারের অসংখ্য ছবি তুলেছি। আমার তোলা মাদারের কিছু ছবি আনন্দবাজারে ছাপা হয়েছে। আবার বহু গুরুত্বপূর্ণ ছবি, যার নিউজ ভ্যালু অত্যন্ত বেশি তা ছাপা হয়নি। দিনের পর দিন এই ঘটনা ঘটেছে। এর কারণ আমি জানিনা। আমার প্রাক্তন সহকর্মীরা একথা জানেন। হয়তো সরকার বাড়ির তৎকালীন সম্পাদক মাদারের প্রতি খুব একটা প্রসন্ন ছিলেন না। কিন্তু আমি মাদারের ছবি তুলেই গিয়েছি। ছাপা হোক বা না হোক সেসব ছবি এখন ঢুকে গেছে ইতিহাসে। মনে পড়ছে, ইকনমিক টাইমসের বিশিষ্ট চিত্রসাংবাদিক আমার বন্ধু শুভজিৎ পালের সঙ্গে ক্রিসমাস ইভের রাতে একবার মাদারের বাড়িতে হাফ প্যান্ট পরে বিদেশী অতিথিদের সঙ্গে প্রেয়ার রুমে ঢুকে পড়েছিলাম। ছবিও তুলেছিলাম। দীর্ঘ অসুস্থতার পর মাদার সেবার প্রার্থনায় যোগ দিয়েছিলেন। স্বাভাবিক কারণেই সারা পৃথিবীর সংবাদ মাধ্যমের চোখ সেই প্রার্থনা সভার দিকে ছিল। দুর্লভ ছবি, কিন্তু তা ছাপা হয়নি। আরেকবার তুলেছিলাম মারাদোনার সঙ্গে মাদারের একটা ছবি। একটুও বাড়িয়ে বলছিনা, এটা ছিল ইন্টারন্যাশনাল এক্সক্লুসিভ। এটাও ছাপা হয়নি! ইচ্ছে আছে এসব ছবি নিয়ে একটা বই করার। আমার মনে পড়ছে, একজন জাদুকরের একটা গির্জায় গিয়ে যীশুকে জাগলিং দেখানোর গল্প। গির্জার পাদ্রির জিজ্ঞাসার জবাবে সে জানিয়েছিল সে এটাই ভাল পারে এবং তাই এই খেলা দেখিয়েই সে প্রভুকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। আমার মত একজন সামান্য ফটোগ্রাফার তো শুধু ছবি দিয়েই মাদারকে শ্রদ্ধা জানাতে পারে।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )