বাঙালী নাকি ‘স্ত্রী লিঙ্গ’! তা হলে শব্দটির লিঙ্গান্তর করলে কী হবে? কেন ‘বাঙাল’! ‘জনপ্রিয়’ এই ব্যাখ্যাটি বঙ্গ জীবনে হাস্যরসের মোড়কে যিনি পেশ করেছিলেন তাঁর নাম সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায়। শুধু কী বাঙালি-বাঙাল! ‘মাসীমা মালপো খামু’, ‘টিনের বাক্সে বারো টাকা’, ‘নাগো মিনু আমাগো থার্মোমিটারও নাই, বার্নলও নাই’, ‘দ্রিমু য্রখন ত্রখন স্রব ত্রাইতেই দ্রিমু’… এমন হাজারো সংলাপ বাঙালির মুখে মুখে ফিরত তখন! ফিরত কেন, এখনও তো নানা হাস্য-আলোচনায় ঘুরে ফিরে আসে এই সব সংলাপ। ভাবছেন, এ সবের স্রষ্টা হিসেবে খ্যাত মানুষটির নাম তো ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়! ঠিকই, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের পোশাকি নাম ছিল সাম্যময়। মাতামহ যোগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের দেওয়া ‘সাম্যময়’ নাম নিয়ে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘রসিকতা’ ছিল— that I am communist, I bear it in my name.
তিনি ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তের সহচর এবং বিজ্ঞানী অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসুর প্রিয়পাত্র।
অধুনা বাংলাদেশের বিক্রমপুরের মুন্সীগঞ্জে ১৯২০ সালের ২৬শে অগস্ট ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম। তাঁর বাবা ছিলেন জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মা সুনীতি বন্দ্যোপাধ্যায়। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাথমিক শিক্ষা পোগোস বিদ্যালয়ে, পরের ধাপগুলিতে জর্জস হাইস্কুল, জগন্নাথ কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ছোটবেলা থেকেই কৌতুক ছিল তাঁর অত্যন্ত প্রিয় বিষয়। আর সে কারণেই বাংলা মঞ্চ-চলচ্চিত্র-শ্রুতিনাট্যে হাস্যকৌতুকের সংজ্ঞাটাই পাল্টে দিতে পেরেছিলেন তিনি। অভিনয় জীবনে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু কৌতুকশিল্পী ছিলেন এমন নয়, ‘সিরিয়াস’ অভিনয়েও তিনি ছিলেন অনবদ্য। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কলকাতায় কাটালেও নিজেকে ঢাকার ‘পোলা’ হিসেবে পরিচয় দিতে তিনি গর্ব বোধ করতেন।
বাবা জিতেন্দ্রনাথ ছিলেন ঢাকার নবাব এস্টেটের সদর মোক্তার ও মা সুনীতিদেবী ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষা দফতরে কাজ করতেন। বাবা-মা সরকারি কর্মচারী ছিলেন বলে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধাচরণ নিষেধ ছিল বাড়িতে। তা সত্ত্বেও ১২ বছরের ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় লুকিয়ে স্বদেশি আন্দোলনে যোগ দিলেন। ম্যাট্রিক পাশ করার পরে ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে আইএ পাশ করার পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ পড়তে এলেন তিনি। বুদ্ধিমান এই ছাত্রটিকে সব অধ্যাপকেরা ভালবাসতেন।
১৯৪০ সালে যখন বেশির ভাগ অনুশীলন সঙ্ঘের বিপ্লবীরা আরএসপি নামে বামপন্থী দল গঠন করলেন তখন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ও সেই দলের সঙ্গে যুক্ত হলেন। তিরিশের দশকের শেষের দিকে ছাত্রনেতা ভানু আন্দামান থেকে রাজনৈতিক বন্দিদের ফিরিয়ে আনা এবং তাঁদের মুক্তি আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করলেন। বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তের সহচর ও স্বদেশি আন্দোলনে যুক্ত থাকায় রাজরোষে পড়ে ঢাকা ছাড়তে বাধ্য হলেন ভানু। বিয়াল্লিশের ভারত ছাড়ো আন্দোলনেও তিনি ছিলেন সক্রিয়। দীনেশ গুপ্ত ছাড়াও তিনি বিনয় বসু, কেদারেশ্বর সেনগুপ্ত, রমেশ আচার্যের সংস্পর্শে আসেন। ১৯৪৬-এ বিপ্লবী অনন্ত সিংহের সান্নিধ্যে এসে তাঁর আদর্শ ও চিন্তাধারায় গভীর ভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।
দেশভাগের অনেক আগেই ঢাকা থেকে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় চলে এলেন। তখন ১৯৪১ সাল। এসেই কর্মজীবনে ঢুকে পড়লেন, অফিসের নাম— আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি। ঢাকা থেকে কলকাতায় এসে প্রথম দু’ বছর তিনি অশ্বিনী দত্ত রোডে দিদির বাড়ি থাকলেও, পরে টালিগঞ্জের ৪২ নম্বর চারু অ্যাভিনিউতে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পাকাপাকি ভাবে বসবাস।
১৯৪৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সঙ্গীতশিল্পী নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিয়ে হয়।
বিয়ের ঠিক ৩ দিন পর ২৬ ফেব্রুয়ারি চলচ্চিত্রের শ্যুটিং-এ প্রথম বার ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালেন ভানুবাবু। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৪৭-এ মুক্তি পাওয়া ‘জাগরণ’ চলচ্চিত্র দিয়ে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় জীবনের শুরু। এ ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেন সুধীরলাল চক্রবর্তী। আর ভানুবাবু অভিনয় করেছিলেন দুর্ভিক্ষপীড়িতের চরিত্রে। পরে অভিনয়ের কারণেই চাকরি জীবন থেকে নিজেকে ‘মুক্ত’ করেছিলেন ভানুবাবু। সেই বছরই ‘অভিযোগ’ নামে অন্য একটি ছবি মুক্তি পায়। এর পর ছবির সংখ্যা বাড়তে থাকে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘মন্ত্রমুগ্ধ’, ‘বরযাত্রী’, ‘পাশের বাড়ি’ ইত্যাদি।
শুধু সিনেমারই নয়, খেলার জগতের মানুষদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের। খেলা বলতে ফুটবল। তিনি ছিলেন ইস্টবেঙ্গল অন্তপ্রাণ। ক্লাইভ রো-তে যখন ‘আয়রন অ্যান্ড স্টিল’-এ চাকরি করত, ইস্টবেঙ্গলের খেলা মানেই অফিস ‘কাট’! মেম্বরশিপ গেটে দাঁড়িয়ে গেটও ম্যানেজ করেছে তিনি। মাঝে মাঝে শচীনদেব বর্মন আর হিমাংশু দত্ত আসতেন মাঠে। শচীনকর্তা তাঁর প্রাণ! হাফটাইমে তিনি নিয়ম করে ওঁর হাতে তুলে দিতেন একটা সিগারেট, এক খিলি পান আর এক প্যাকেট চিনে বাদাম।
একদিন হাতিবাগানে স্টারে ‘পরিণীতা’র শো করতে গিয়ে দেখেন অবাক কাণ্ড! একদল চ্যাংড়া ছেলে তুলসী চক্রবর্তীকে রাস্তায় ঘিরে ধরেছে। ধুতির কোঁচা ধরে, জামা ধরে টানছে। চাঁটিও মারছে। মাথায় রক্ত উঠে গেল ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের। গাড়ির দরজা খুলে সোজা গিয়ে এক-একজনকে রামধোলাই। কিল, ঘুষি, লাথি। নিমেষে সবাই হাওয়া। সে তো হল, এর পর তুলসী চক্রবর্তী কী বললেন শুনুন, ‘‘আহা, অত রাগিস কেন, একটু মজা করে যদি ওরা আনন্দ পায়, পাক না। খামোকা মারলি!’’
বিপ্লবী অনন্ত সিংহকে তিনি খুব ভক্তি করত। তার অবশ্য একটা অন্যতম কারণ বিক্রমপুরে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কিশোরবেলা। ওই সময় তিনি এক দিকে যেমন বিজ্ঞানী সত্যেন বসু, কবি জসীমউদ্দিনের প্রিয়পাত্র, অন্য দিকে তেমন স্বদেশিও করত। বুকের মধ্যে নিষিদ্ধ বই, রিভলভার নিয়ে পাচার করতেন। দীনেশ গুপ্তকে ‘গুরু’ মানতেন। এক সময় বাধ্য হয়েই বন্ধুর গাড়িতে ব্যাকসিটের পাদানিতে শুয়ে এ পার বাংলায় পালিয়ে আসেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।
১৯৫৩ সালে মুক্তি পেল ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে তাঁর অভিনয় গুণের কারণে চিনে ফেলল আপামর বাঙালি। এ ছবিরই সেই বিখ্যাত সংলাপ— ‘মাসীমা মালপো খামু।’ পরের বছর মুক্তি পায় ‘ওরা থাকে ওধারে’— ঘটি-বাঙালের চিরন্তন ‘ঠেস’ নিয়ে এই ছবি এবং সেখানে ভানুবাবুর অভিনয় চিরস্মরণীয়।
অভিনেতার নামে চলচ্চিত্র ও চরিত্রের নাম বাংলা চলচ্চিত্র-ইতিহাসে বোধহয় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঝুলিতেই রয়েছে— ‘ভানু পেল লটারি’ ও ‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিসট্যান্ট’।
১৯৪৩-এ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড-এ কৌতুক নকশা বের হয়। নাম ছিল ‘ঢাকার গাড়োয়ান’। শোনা যায়, এই শ্রুতিনাট্যের প্রেরণা তিনি ঢাকার গাড়োয়ানদের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন।
মঞ্চ নাটকেও তিনি ছিলেন সফল অভিনেতা। সহজ জীবনের স্বাভাবিক হাস্যরসটুকু নিখুঁত, নিপাট ভাবে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন আমজনতার মধ্যে। এই নিখাদ হাসির ক্যানভাসে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় অনন্য। তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটক— ‘মন্ত্রশক্তি’, ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’, ‘লালদিঘির দিনরাত্রি’, ‘শ্যামলী’ ইত্যাদি। ‘রণবীর’ নামের একটি নাটকে তিনি প্রথম অভিনয় করেন। তখন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র।
ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় অপেশাদার হিসেবে পাড়াতে অভিনয় করেছিলেন ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকে, ‘চাণক্য’ চরিত্রে। এ নাটকে ‘চন্দ্রগুপ্ত’ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সাহিত্যিক হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়। ১৯৪৮ সালে ‘উত্তরসাথী’ ব্যানারে ‘নতুন ইহুদি’ নাটক মঞ্চস্থ হয়। নাটকটি প্রথম অভিনয় হয়েছিল ‘কালিকা’ হলে। অভিনয়ে ছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, সুশীল মজুমদার, বাণী গঙ্গোপাধ্যায়, কানু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।
ষাটের দশকের শেষে ‘অভিনেতৃ সংঘ’-য় ফাটল। উত্তমকুমার, অনিল চট্টোপাধ্যায় নেতৃত্বে পাল্টা সংগঠন ‘শিল্পী সংসদ’ তৈরি হোলো। খুব কষ্ট পেয়েছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথম হার্ট অ্যাটাকটা তখনই। তবু মাথা নোয়ায়নি। ফলে ব্ল্যাক লিস্টেড। যে জন্য বহু দিন কাজ পেতেন না। এ দিকে সংসার চালাতে হবে যে! তখন যাত্রা একমাত্র সম্বল।
কোথায় না কোথায় গেছে তখন যাত্রার জন্য! যে লোকটা নরম বিছানা ছা়ড়া ঘুমোতে পারত না, সে কিনা মাটিতে চাটাই পেতে রাত কাটিয়েছে। ভাঙা বাড়িতে রাতে আশ্রয় নিয়েছে। বুকের ওপর পাখা ভেঙে পড়েছে। তবু শক্ত চোয়াল আলগা হতে দেয়নি। ’৭৯ থেকে বাবার শরীরটা খুব ভাঙছিল। বড্ড রোগা হয়ে যাচ্ছিল। সেই অবস্থাতেই ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ চলচ্চিত্রে অসাধারণ অভিনয় করলেন।
‘রঙ্গনা’য় ১৯৮০ সালে ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’-এ অভিনয় করেন। পরে রঙমহলেও নাটকটি হয়েছিল।
ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের শেষ চলচ্চিত্র ‘শোরগোল’। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৮৪ সালে। এর কিছু দিন আগেই, ৪ঠা মার্চ, ১৯৮৩— উনি প্রয়াত হয়েছিলেন। আজীবন আপামর বাঙালিকে হাসিয়ে নিজের শেষযাত্রায় উনি সবাইকে কাঁদিয়ে চিরবিদায় নিলেন। ব্যক্তি জীবনে খুবই গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ ছিলেন, যদিও রসবোধ ছিল ষোলআনা। সে জন্যই হয়তো মানুষকে আনন্দ দেওয়ার একটা সহজাত প্রতিভা তাঁর ছিল। তবে বাঙালি যত দিন থাকবে, বাংলা চলচ্চিত্রের গগনে এই ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় যে থাকবেন স্বমহিমায় তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা শ্রদ্ধেয় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় কে সশ্রদ্ধ প্রণাম।