তখন সবে সংসদে গিয়েছি সাংসদ হিসাবে। নতুন সাংসদের জন্য ‘ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রাম’। দুদিন ধরে একাধিক সেশন। বাঘা বাঘা বর্তমান ও প্রাক্তন সাংসদরা শিক্ষকের ভূমিকায়। সেরকমই একটি সেশনে শিক্ষক হিসেবে ছিলেন মণিশঙ্কর আয়ার। মণিশঙ্কর আয়ারের মন্ত্র মুগ্ধ ক্লাসে অনেক ঘটনার সাথে সাথে ষাটের দশকে সংসদের এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা জানার সুযোগ হয়েছিল।
সীমান্তকে কেন্দ্র করে আমাদের সাথে চীনের সম্পর্ক তখন তলানিতে। অরুণাচলে ঢুকে পড়েছে চীনা সেনা। শুরু হল যুদ্ধ। ১৯৬২ সাল। যুদ্ধ তখন চলছে। যুদ্ধ চলাকালীন এক তরুণ সাংসদ দেশের প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে দেখা করলেন। পন্ডিত নেহরুর কাছে দাবি করলেন অবিলম্বে সংসদের অধিবেশন ডাকার। পন্ডিত নেহরু সেই তরুণ সাংসদকে বললেন – চীনের সাথে যুদ্ধ চলছে। এই অবস্থায় কি ভাবে ডাকা যাবে সংসদ? নাছোড়বান্দা সেই তরুণ একটুও না দমে পন্ডিত নেহরুকে বললেন লোকসভা যদি না ডাকা যায় তাহলে রাজ্যসভার বিশেষ অধিবেশন ডাকা হোক। পন্ডিত নেহরু সেই তরুণকে বললেন- ‘ তুমি রাজ্যসভায় সবে জিতে এসেছ বলেই রাজ্যসভার অধিবেশন ডাকতে বলছো? রাজ্যসভার অধিবেশন ডাকলে যাতে তুমি আমাকে রাজনৈতিক ভাবে আক্রমণ শানাতে পারো।’
উদারমনা, আধুনিক মানুষ পন্ডিত নেহরু কিন্তু সেই তরুণের কথা ফেলে দেননি। সেই তরুণ তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ জেনেও। সেই তরুণের দাবিকে মান্যতা দিয়ে চীন-ভারত যুদ্ধের মধ্যেও রাজ্যসভার বিশেষ অধিবেশন ডাকা হয়েছিল। দু দিনের জন্য।
সেই অধিবেশনে বিরোধীদের প্রবল আক্রমণের মুখে পড়েন পন্ডিত নেহরু। চীনের সাথে যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিরোধীরা নেহরুকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করেন। দেশের পররাষ্ট্র নীতি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কড়া সমালোচনা করেন বিরোধীরা। প্রতিরক্ষা ও জাতীয় সুরক্ষার প্রশ্নে উত্তাল হয় সংসদের উচ্চকক্ষ। এবং সংসদের উচ্চকক্ষে অত্যন্ত উচ্চমানের সেই বিতর্কে নিজের জাত চেনান সেই তরুণ। ক্ষুরধার শব্দচয়নে, যুক্তির ঠাসবুনোটে পন্ডিত নেহরুর দিকে আক্রমণের শব্দভেদী বাণ গুলো আছড়ে পড়তে থাকে। একের পর এক। ট্রেজারি বেঞ্চে বসে স্মিতমুখে পন্ডিত নেহরু শুনতে থাকেন সেই তরুণকে। এমনকি দু একবার রাজনৈতিক বিরোধী সেই তরুণের বক্তব্যের বাহবাস্বরূপ আলতো করে টেবিলও চাপড়ে দেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। পন্ডিত নেহরুর সেই সৌজন্যবোধ আজ অবশ্য বিরল হয়ে গিয়েছে।
বিতর্কের শেষে জবাবী ভাষণ দিতে উঠেছেন পন্ডিত নেহরু। একে একে উত্তর দিচ্ছেন সব অভিযোগের। দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী এবার সেই তরুণকে জবাব দিতে শুরু করলেন। জবাবী ভাষণের শেষে অভিভাবকের মতন পন্ডিত নেহরুকে বলতে শোনা গেল সেই তরুনকে উদ্দেশ্য করে- নেহেরু বললেন যে তিনি জানেন না যে সেই তরুণের রাজনৈতিক দল কোনোদিন দেশে সরকার গড়বে কিনা। তিনি বললেন তার এটাও জানা নেই যে সেই তরুণ সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী হবেন কিনা। কিন্তু নেহরু তারপর বললেন যে তিনি এটা বুঝতে পারছেন যে সেই তরুন সাংসদের মধ্যে দেশ চালাবার সমস্ত উপাদান রয়েছে।
৭৩ বছরের নেহরু ৩৮ বছরের অটলবিহারীকে বলেছিলেন– ” I can realise that you are a Prime Minister material” । গোটা উচ্চকক্ষ টেবিল চাপড়ে অভিভাবক নেহরুর দূরদৃষ্টি সম্পন্ন সস্নেহ উচ্চারণের তারিফ করেছিল। আর সেই দূরদৃষ্টির অমোঘ উচ্চারণের মর্যাদা দিয়ে নেহরুর চেয়ারেই একদিন বসে ছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়েছিল।
অটলবিহারী বাজপেয়ীর শেষযাত্রার দিনে মণিশঙ্কর আয়ারের ক্লাসে শোনা ভারতীয় গণতন্ত্রের সেই মুক্তমনা যাত্রাপথের কথা শিরায় শিরায় মাতন জাগাল। যে গণতন্ত্র এটা শিখিয়েছিল যে মতান্তরকে স্বাগত জানাতে হয় কিন্তু মনান্তর কে জায়গা দিতে নেই। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের জন্য প্রাপ্য মর্যাদা, সম্মান যে গণতন্ত্র বারে বারে নিশ্চিত করে এসেছে। যদিও নেহেরু বাজপেয়ীর এই আখ্যান-এর কথা মনে করার মুখস্মৃতি ধাক্কা খেয়ে যায় সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায়।
কদিন আগেই প্রয়াত হয়েছেন দেশের প্রথম লোকসভার বাঙালি অধ্যক্ষ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। রাজনীতিতে প্রতিপক্ষ সোমনাথদার প্রতি প্রবল সৌজন্য দেখিয়ে সাথে সাথেই পূর্ণরাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষ যাত্রার ঘোষণা ও ব্যবস্থা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অথচ যে দলের প্রতীকে দশ দশবার সোমনাথদা লোকসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন সেই সিপিআই(এম) শোকবার্তার বিবৃতি দিতেই পাঁচ ঘণ্টা নিয়ে ফেলেছিল। এমনকি সেই বিবৃতিতে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় কোন দলের সাংসদ ছিলেন তার উল্লেখ করবার সৌজন্যও দেখিয়ে উঠতে পারেননি সিপিএম নেতারা।
আমাদের দেশে গণতন্ত্রের শিকড় গভীরে প্রোথিত। সেই ষোড়শ মহাজনপদের আমলেও গণরাজ্যের উজ্জ্বল উপস্থিতিতেই আসুমদ্র হিমাচলের গণতন্ত্রর অবিরাম জয়যাত্রার সূচনা। সেই গণতন্ত্রের কাঠামোয় অশ্রদ্ধা, অবজ্ঞা, অসম্মান কখনোই চিরস্থায়ী হতে পারে না। দলের আগে দেশ- এই বীজমন্ত্রকে সন্মান জানিয়েই সিপিএমের কাছে অসম্মানিত সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়রা। নিকারাগুয়ার বিপ্লবী পরিস্থিতি নিয়েও যে সিপিএম তিন পাতার প্রেসবিবৃতি দেয় তারাই অটলবিহারীর জন্য বরাদ্দ করে তিন লাইন। এই অসৌজন্যের বিরুদ্ধেই আবার থাকেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রা। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে যথাযোগ্য সন্মান ও মর্যাদা দিতে যার নেই কোনো কুণ্ঠা।
‘দলের আগে দেশ’এর অবিনাশী মিছিল তাই সব বাঁধা পেরিয়েই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে। নেহরু থেকে বাজপেয়ীরা সেই মুক্তমনা মিছিলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সেই মিছিলের ব্যাটন এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )