আনন্দবাজারে চিত্র সাংবাদিকতার সূত্রে আমি বহুবার তাঁর ছবি তুলেছি, কিন্তু অটল বিহারী বাজপেয়ীকে আমার কখনোই রাজনীতির মানুষ বলে মনে হয়নি। বরং তাঁকে আমার সবসময় মনে হয়েছে ভারতবর্ষ নামে এক বিশাল পরিবারের এক সহনশীল অভিভাবক। যিনি সব মত ও পথের মানুষদের নিয়ে অনায়াসেই পথ চলতে পারেন। তাঁর কথায় আমি শুনেছি রামকৃষ্ণদেবের ‘যত মত তত পথ’ কথার প্রতিধ্বনি। এই মোদ্দা কথাটাকেই আজকে সাজিয়ে গুজিয়ে ‘বহুত্ব’ বলা হচ্ছে। অটলজী ছিলেন এই বহুত্বকে বরণ করে নেওয়ার মন্ত্রে দীক্ষা দেওয়ার এক সাধক। এত সার্থকনামা মানুষ দেশের রাজনীতিতে আমি খুব কম দেখেছি। ভারতবর্ষে এমন একজন রাজনৈতিক সন্ন্যাসী আর জন্মাবেন কিনা আমি জানিনা। বিশ্বাস, কর্ম, রাজধর্ম, ধর্ম নিরপেক্ষতা সবকিছুতেই তিনি তাঁর আদর্শে অটল ছিলেন। দিল্লিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে জানাতে গিয়ে বলেছিলেন, এত বড় সেকুলার নেতা দেশে আর আসেনি। যে পার্টিটাকে কথায় কথায় সাম্প্রদায়িক বলে চিহ্নিত করা হয়, সেই দলের শ্রেষ্ঠ মুখটিকে কিন্তু কেউ সাম্প্রদায়িক বলতে পারেননি। এখানেই তিনি দলের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেছেন। এরজন্য তাঁকে মুল্য দিতে হয়েছে। এমনকি নিজের দলেও সমালোচনার শিকার হতে হয়েছে। তবুও তিনি এই বিশ্বাস থেকে সরেননি।
শরীর খারাপ অটলজীকে শেষ দেখা দেখবো বলে দিল্লি রওনা দিয়েছিলাম দিদির সঙ্গে। সহযাত্রী, ডেরেক ও ইন্দ্রনীল। কথা ছিল এয়ারপোর্ট থেকে সোজা এইমসে যাওয়া হবে। মাঝপথে দিদি খবর পেলেন, এই রাজনৈতিক সন্ন্যাসীকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হবে। তাই সোজা নতুন বঙ্গ ভবনে উঠে রাতেই আমরা রওনা দিলাম অটলজীর বাড়ির দিকে। রতনদার গাড়িতে দিদি, পিছনের সিটে ইন্দ্রনীল, ডেরেক ও স্বরূপ। আমি চললাম পিছনে নিরাপত্তা অধিকর্তা নন্দা সাহেবের গাড়িতে। আগেই বলেছি কোন ছবি তোলা আমার উদ্দেশ্য ছিলনা। দিদিও চাননি তার সঙ্গে গিয়ে আমি এই ধরণের ছবি তুলি। অটলজীর বাড়িতে গিয়ে দেখি প্রধান ফটকের দুধারে দেশ বিদেশের সাংবাদিক ও আলোকচিত্রীদের ভিড়। আরেক গেটে থিক থিক করছে সাধারণ মানুষ। থেকে থেকে শ্লোগান উঠছে, অটলজী অমর রহে, ভারত কা মহা সন্তান যুগ যুগ জিও। না, কোন জয় শ্রীরাম ধ্বনি শুনিনি।
অটলজীর বাড়িতে ঢুকে দিদি যে ঘরে গেলেন, তার এক কোণে দুহাত চিবুকে লাগিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর দীর্ঘদিনের সহযোদ্ধা ও সঙ্গী লালকৃষ্ণ আদবানি। ফ্যাল ফ্যাল করে সবাইকে দেখছেন। পাশে চেয়ার থাকলেও কেউ বসেননি। সেই ঘরেই ছিলেন সুষমা স্বরাজ, বেঙ্কাইয়া নাইডু, নিতীশ কুমার, নবীন পট্টনায়েক, অটলজীর মেয়ে নমিতা, নাতনি নীহারিকা, আদবানির মেয়ে প্রতিভা, মুরলী মনোহর যোশী, শিবরাজ চৌহান, রামদেব ও আরও অনেকে। সাদা ফুলের তোড়া নিয়ে দিদি ঢুকতেই নমিতা ছুটে এলেন। আদবানি দিদিকে পাশের চেয়ারে বসালেন। অটলজীর নাতনী নীহারিকা দিদির কোলে মাথা রাখলেন। প্রথমবার অটলজীর বাড়িতে গিয়ে এই নীহারিকাকেই দিদি একটা গোলাপি ফ্রক উপহার দিয়েছিলেন। তখন তিনি খুব ছোট। সে কথা তিনি মনে রেখেছেন ভেবে আমার ভাল লাগলো। নমিতা আর তার মেয়ে নীহারিকার সঙ্গে বরাবরই দিদির খুব ভাব।
খবর এল,নরেন্দ্র মোদী আসছেন। সেই খবর পেয়ে আদবানি দিদিকে নিয়ে যে ঘরটিতে প্রয়াত অটলজীর দেহ রাখা আছে সেখানে শ্রদ্ধা জানাতে ঢুকলেন। মোদী আসার আগেই দিদি অটলজীকে শেষ প্রণাম জানিয়ে বিদায় নিলেন। পরে শুনেছিলাম বাড়িতে অন্য একটি ঘরে তখন অমিত শাহও ছিলেন। কিন্তু দিদি ও অমিত শাহ কেউই কারো মুখোমুখি হননি। বাইরে বেরোনো মাত্রই সাংবাদিকদের দিদি, দিদি বলে চিৎকার। তিনি তাদের অটলজী সম্পর্কে তার মুল্যায়ন ও শ্রদ্ধার কথা জানালেন।
এই মহান কবি, বাগ্মী, রাজনৈতিক সন্ন্যাসীর বাড়িতে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে যা দেখেছি তা নিয়ে দু-চারটে কথা বলতে চাই। যদিও একথা বলার উপযুক্ত পরিসর এটা নয়। টুকরো টুকরো যেসব কথা কানে আসছিল তার সব কথা বলা যাবেনা। কিন্তু যা বুঝলাম তা হল, দেশের মানুষদের নিয়ে মোদী-শাহ জুটির সার্কাস দলের বহু নেতারই আর ভাল লাগছে না। আরেকটা জিনিস আমার মনে হল যে তাদের অনেকেই দিদিকে স্নেহ করেন এবং ভালবাসেন। হাওয়াই চটি আর আটপৌরে শাড়ি পরা দিদিকে বাড়ির ভিতরে দেখেই সবাই যেভাবে উৎসাহিত হয়ে উঠলেন তাতে আমার এটাই মনে হল। অটলজী নিজের থেকেই দিদির বাড়িতে আসতে চেয়ে অনেকবার অনুরোধ করেছিলেন। দিদিকে তিনি খুব স্নেহ করতেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী দিদির বাড়িতে ঢুকেই মাথা নিচু করে মাসিমা, মানে দিদির মাকে প্রণাম করেছিলেন। সেসব আমরা জানি। তাঁর কথা বলতে গিয়ে দিদির চোখের কোন চিকচিক করে উঠছিল। মনে পড়ছে কালীঘাটের এই বাড়িতে আরেক প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখরও এসেছিলেন।
তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন নেহেরু, ইন্দিরা ও অটল। অটলজী একবার তেরোদিন আরেকবার তেরোমাস আর শেষে টানা চার বছর ছ-মাস। ওঁর প্রধানমন্ত্রীত্বের কোন মূল্যায়ন করার ক্ষমতা আমার নেই। ছোট করে এটুকুই বলতে পারি ১৯৯৮এ পোখরানে পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা, ১৯৯৯এ ভারত-পাকিস্তান বাস যাত্রা, কার্গিল যুদ্ধজয়, ২০০২এ গুজরাট দাঙ্গার পর মোদীকে রাজধর্ম পালনের পরামর্শ, ২০০৩এ সিকিমকে অঙ্গরাজ্যের স্বীকৃতি, সারা দেশজুড়ে সড়ক যোগাযোগ গড়ে তোলার জন্য সোনালি চতুর্ভুজ প্রকল্প, তাঁকে এক সফল প্রধানমন্ত্রী, প্রশাসক, চিন্তাবিদ ও দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আর বাগ্মীতা, কবিত্বশক্তি, রসবোধ কোনকিছুতেই ভেঙে না পড়ার মনোভাব, সবাইকে নিয়ে চলার ক্ষমতা, দলের ঊর্ধ্বে দেশকে দেখার সহজাত ক্ষমতা তাঁকে করে তুলেছিল এক অসাধারণ ব্যাক্তিত্ব। এত গুণের সমন্বয় আমরা দেশের খুব কম রাজনীতিবিদদের মধ্যেই দেখেছি।
আজকে বিজেপি যে জায়গায় এসে পৌঁছেছে তার পিছনেও কিন্তু এই অটলজীই রয়েছেন। তাঁর পাশে বিজেপির আজকের নেতাদের দাঁড় করালে মনে হবে লিলিপুটদের দেশে গালিভার। এই রাজনৈতিক সন্ন্যাসীর মৃত্যুর পর মোদী-অমিতরা নিজেকে তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি প্রমাণ করার যে হাস্যকর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তা সফল হবেনা। কারণ, তারা অটলজীর মাপের মানুষ নন। এই হীনমন্যতা থেকে অটলজীর পরামর্শ, শিক্ষা, সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে চলার মনোভাবের আদর্শ থেকে দূরে সরে গিয়ে গোটা দেশের মানুষের সঙ্গে বেইমানি করেছেন। অটলজীর মৃত্যু আমাদের আরেকবার বিজেপি নামক দলটির দৈন্যদশা মনে করিয়ে দিল।
বিজেপিতে অটলজীর শূন্যস্থান পূরণ করার মত এখন আর কেউ নেই। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক মানচিত্র থেকে এই দলটির মুছে যাওয়া এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )