লাহোরের বিশাল মাঠটায় পরমাণু বিস্ফোরণই হল বুঝি!
এমনিতে মিনার–ই–পাকিস্তান অনেকটা কলকাতার শহিদ মিনারের মতো। বিশাল মাঠের মধ্যে অতিকায় স্তম্ভ। শীতের অলস দুপুরে বেকার, আড্ডাবাজ, রোদ–পোয়ানো জনতা আর ইতিউতি ছাগলের ভিড়। ভানুমতীর খেল্টাই যা নেই।
ফেব্রুয়ারির সেই শীতের বিকেলে অবশ্য রেলিং–ঘেরা ময়দান সরগরম। চারদিকে উজি সাব–মেশিনগান হাতে নিরাপত্তাবাহিনী। শার্প শ্যুটার, জ্যামার, ম্যানপ্যাক ওয়াকিটকি থেকে ছিটকে–আসা ধাতব শব্দ আর ঘাসের ওপর বুলেট–নিরোধক রোল্স রয়েসের চাকার মসৃণ সরণ। যার পিছনের দরজাটা খুলে ধীরপায়ে নেমে এলেন ধুতি–পাঞ্জাবি–জহরকোট–কালো পাম্প শ্যুয়ের প্রৌঢ়। অন্য গাড়িটা থেকে নামলেন টাকমাথা (অনেক পরে চুল গজানোর ট্রিটমেন্ট শুরু করবেন), পরনে ঘিয়ে শেরওয়ানি, পায়ে জুত্তি আর একগাল হাসির রাজনীতিক।
মিনারের পাদদেশে গিয়ে দু’জনে হাত মেলালেন। খানিক পরে শহরের অন্য এক বিশাল ইমারতে সাক্ষরিত হবে ঐতিহাসিক লাহোর ঘোষণাপত্র। তার জন্যই দেশবিদেশের সংবাদমাধ্যম দম ধরে দাঁড়িয়ে। তার অব্যবহিত আগে শেষ বিকেলের এই ‘ভিজিট’ তো নেহাতই ঔপচারিক। মেন কোর্সের আগে স্টার্টারের মতো। বিদেশ সফরে যেমন হয়ে থাকে আর কী। কোনওমতে বুড়ি ছুঁয়ে দিনের সবচেয়ে বড় ঘটনাটার মঞ্চে চলে যাওয়া।
কিন্তু ওই যে বললাম, লাহোরের মাঠে পরমাণু বিস্ফোরণই হল সম্ভবত!
যখন নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিতে গিয়ে কেটে কেটে (ফিচেল সাংবাদিকদের বর্ণনায় ‘ফুটেজ খেয়ে’) অননুকরণীয় ভঙ্গিমায় তিনি বললেন, ‘আমাকে অনেকে এই স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে আসতে বারণ করেছিল। আমি কান দিইনি।’
বলে কী! দ্রুত চোখ চাওয়া–চাওয়ি হল সীমান্তের ওপার থেকে লাহোর বাসযাত্রা এবং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর পাকিস্তান সফর কভার করতে–যাওয়া সাংবাদিকদের মধ্যে। দ্রুত একটা হিল্লোল উঠল। তারপর দে ছুট! চুলোয় যাক লাহোর ঘোষণাপত্র। ওসব তো প্রোটোকল। একমাস ধরে মুসাবিদা হয়েছে দু–দেশের বিদেশমন্ত্রকের মধ্যে। দু–পক্ষ ঐকমত্যে পৌঁছেছে। এবার আনুষ্ঠানিক সই, ফ্ল্যাশবাল্বের ঝলকানি আর মুক্তকচ্ছ হাসি। নিয়মমাফিক যেমন হয়। কিন্তু আসল খবর তো পাকিস্তানের মাটিতে দাঁড়িয়ে সঙ্ঘের নিষেধাজ্ঞার সরাসরি বিরোধিতা করলেন বিজেপি–র প্রধানমন্ত্রী তথা একদা আরএসএসের নিষ্ঠাবান প্রচারক অটলবিহারী বাজপেয়ী। নিজের আঁতুড়ঘর সঙ্ঘের নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করে মিনার–ই–পাকিস্তানে এলেন তো বটেই, সীমান্তের দু–পারকে বন্ধুত্বের সুতোয় বাঁধতে তিনি যে কোনও বাধাই মানবেন না (এবং তাঁকে যে বারণ করা হয়েছিল), আমজনতাকে খোলাখুলি জানিয়ে দিলেন সেটাও।
অমৃতসর–লাহোর বাসযাত্রা নিয়ে ততদিনে দলের কট্টরপন্থী অংশের রোষানলে বাজপেয়ী। দেবানন্দ, কপিলদেব, জাভেদ আখতার, শত্রুঘ্ন সিন্হা, কুলদীপ নায়ার, মল্লিকা সারাভাইদের নিয়ে ওয়াগা সীমান্তে হইহই উচ্ছ্বাসের মধ্যে বাস থেকে নেমেছেন বটে (যতদূর মনে পড়ছে, সেটা ছিল দীর্ঘ ২৮ বছর পর কোনও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর পাকিস্তান সফর। পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ তো বলেই বসলেন, ‘বাজপেয়ীসাব, এবার তো আপনি পাকিস্তানে ভোটে দাঁড়ালেও জিতে যাবেন’), কিন্তু সীমান্তের ওপার থেকে তখনও নিজের সংগঠনের গোলাগুলি অব্যাহত। সেই আবহে এটা না হলে আর কোনটা ‘কপি’! অনেক পরে, ২০০৫ সালে সঙ্ঘের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাজপেয়ীর সমসাময়িক এবং একদা সরকারে তাঁর ডেপুটি লালকৃষ্ণ আদবানি করাচিতে গিয়ে মহম্মদ আলি জিন্নার সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাবেন, ভিজিটর্স বুক–এ শ্রদ্ধাজ্ঞাপক মন্তব্যও লিখে আসবেন। কিন্তু খুল্লমখুল্লা সঙ্ঘকে অগ্রাহ্য করার শুরুটা করেছিলেন বাজপেয়ীই। তা–ও দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদে থেকে।
উনিশ বছর আগে, ১৯৯৯ সালে এই রিপোর্টারের সেটাই প্রথম পাকিস্তান সফর। সে অর্থে তখনও নেহাতই নাদান। কিন্তু বাজপেয়ীর কথাটা (আরও বেশি বলার ভঙ্গিটা। ১৯৯৬ সালে ১ জুন তাঁর ১৩ দিনের সরকারের পতনের দিন লোকসভায় একঘন্টার সামান্য বেশি সময়ের বক্তৃতায় যেমন বলেছিলেন। চুঁইয়ে পড়ছিল দার্ঢ্য, আত্মবিশ্বাস আর আভিজাত্য) অ্যান্টেনায় লেগেছিল। লাহোর ঘোষণাপত্রকে তুলনায় খানিকটা কম গুরুত্ব দেওয়ার ঝুঁকি–সহ মূল খবর করে পাঠিয়ে দেওয়া গেল পাকিস্তানের মাটিতে বাজপেয়ীর ঘুরে দাঁড়িয়ে কার্যত বিদ্রোহের আগাপাশতলা বর্ণনা। পরদিন জেনে আশ্বস্ত হওয়া গেল, কলকাতা অফিসও একমত। মিনার–ই–পাকিস্তানের ডেসপ্যাচই লিড স্টোরি। লাহোর ঘোষণাপত্রের কপি প্রথম পাতায় আছে বটে। কিন্তু নিচের দিকে।
১৫ আগস্ট লালকেল্লা থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন বলছেন, কাশ্মীরে তাঁর সরকার বাজপেয়ীর নির্দেশিত নীতিই নিয়ে চলবে, ততক্ষণে কি রাজধানীর কৃষ্ণ মেনন মার্গের বাসিন্দার (রাজনীতি থেকে পুরোপুরি অন্তরালে চলে যাওয়ার পর এটিই তাঁর আস্তানা ছিল) স্বাস্থ্য নিয়ে জবাব দিয়ে দিয়েছিল এইমস? কে জানে! হয়তো হ্যাঁ। হয়তো না। কিন্তু মোদির কথাটা শুনে উনিশ বছর আগে লাহোরের ময়দানে রোখা ভঙ্গিটা মনে পড়ে গেল।
বৃহস্পতিবার বিকেলে এইমসের অন্দরে যাঁর জীবনের চাকা থেমে গেল, ঘটনাচক্রে, স্রেফ ঘটনাচক্রেই, তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় এই স্মৃতিচারক দিল্লিতে পেশাগত কারণে পোস্টেড। অটলবিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে নিত্য ওঠাবসা ছিল বা তাঁর সঙ্গে রোজ গল্পগাছা হত— এমন উদ্ভদ দাবি বা বাগাড়ম্বর করলে ঘোর পাপ হবে। সরাসরি কোনওদিন কথাও বলা হয়নি। কিন্তু রাজনীতিক অটলবিহারীর জীবনের কিছু টার্নিং পয়েন্টে তাঁকে দেখতে পাওয়ার মতো কয়েকটি কাকতালীয়তা ঘটেছিল। তার মধ্যে প্রথমটা যদি হয় লাহোরের সেই শীতের বিকেল, বাকি দুটো নিঃসন্দেহে তার আগের বছর মে মাসে ৭, রেসকোর্স রোডের লনে এবং ১৯৯৬ সালে সংসদে তাঁর ১৩ দিনের সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের জবাবি ভাষণের দিন।
ভাষণের শেষে অনাস্থা ভোটে হেরে যাওয়ার অপেক্ষা করেননি বাজপেয়ী। এ–ও এক সমাপতনই যে, লোকসভার প্রেস গ্যালারিতে এই অধমের নিয়মিত বসার জায়গাটা ছিল একেবারে প্রধানমন্ত্রীর আসনের সরাসরি ওপরে। ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে। অর্থাৎ, নিচে তাকালেই তাঁর যাবতীয় নড়াচড়া দেখা যাবে। গেছিলও। ১ জুনের সেই শেষ বিকেলে ১ ঘন্টা ১৩ মিনিটের জবাবি ভাষণের শেষে (ভাষণের শুরুতে বললেন, ‘আমি গত ৪০ বছর ধরে সংসদে আছি’, তখন বিরোধী বেঞ্চ থেকে কুৎসিত টিপ্পনি করেছিলেন সিপিএমের এক প্রবীণ সাংসদ, ‘ওইজন্যই তো ব্যাচেলর থেকে গেলেন!’ বাজপেয়ী পোকামাকড় দেখার মতো উপেক্ষা করেছিলেন) সামনের ডেস্ক থেকে প্লাস পাওয়ারের চশমাটা তুলে নিয়ে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হয়েছি বটে। কিন্তু বহুমত পাইনি। এটা স্বীকার করতে কোনও লজ্জা নেই। (বিরোধী বেঞ্চের দিকে তাকিয়ে) আপনারা সরকার গড়ুন। আমরা বিরোধীদল হিসেবে আপনাদের সহযোগিতা করব। কিন্তু আবার চেষ্টা করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ফিরে আসব। এখন আমি রাষ্ট্রপতিজির কাছে আমার ইস্তফাপত্র (ত্যাগপত্র) দিতে যাচ্ছি।’ তারপর কোনওদিকে না তাকিয়ে একটা ছোট হাফটার্ন নিয়ে বেরিয়ে গেলেন লোকসভা ছেড়ে।ফিরে এসেওছিলেন। বস্তুত, দেশের ইতিহাসে তিনিই একমাত্র অ–কংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রী, যিনি প্রধানমন্ত্রী পদে নিজের মেয়াদ পূর্ণ করেছিলেন।
এনডিএ–র বলে বলীয়ান সেই প্রধানমন্ত্রীই ১৯৯৮ সালের ১৩ মে রেসকোর্স রোডের লনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন, পোখরানে পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে তাঁর ভারত। এখনও মনে আছে, পাশে দাঁড়িয়ে তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রমোদ মহাজন। যাঁর নির্দেশে তড়িঘড়ি স্ট্যান্ডে লাগানো একটা পেল্লাই জাতীয় পতাকা এনে গেঁথে দেওয়া হল পোডিয়ামের পাশে। স্রেফ দু–লাইনের একটা বিবৃতি পড়লেন প্রধানমন্ত্রী। কোনও প্রশ্ন করার অবকাশ নেই। কোনও জবাব পাওয়ার সুযোগ নেই। দরকারও ছিল না। তিনি জানতেন, কী সুতীব্র অভিঘাত তৈরি করতে চলেছে ওই দু–লাইনের নির্ঘোষ। হলও। কালক্ষেপ না করে চাঘাইয়ে পরমাণ বিস্ফোরণ ঘটাল পাকিস্তান। আমেরিকা অর্থনৈতিক নিশেধাজ্ঞা জারি করল। পাশাপাশি চড়চড় করে উত্তাপ বেড়ে গেল উপমহাদেশে। বাজপেয়ী কি অনুতাপগ্রস্ত হয়েছিলেন?
কিন্তু তাঁরই বা কী উপায় ছিল? নড়বড়ে অর্থনীতি, অহরহ সঙ্ঘের সঙ্গে লড়াই, জোট রাজনীতির বাধ্যবাধকতা মেনে চলার সেই প্রতিকূল আবহাওয়ায় জাতীয়তাবাদী আবেগ উস্কে দেওয়াটা দরকার ছিল জনসঙ্ঘের একনিষ্ঠ সাধকের। বৃহস্পতিবারের বারবেলায় যে প্রশ্নের জবাব তাঁর সঙ্গেই পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গেল— ১০ মাস পরে মিনার–ই–পাকিস্তানে দাঁড়িয়ে সঙ্ঘকে অগ্রাহ্য করার ঘোষণা কি আসলে রেসকোর্স রোডের লনে দাঁড়িয়ে সেই দু–লাইনের বিবৃতির প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন এক ধ্বস্ত রাষ্ট্রনায়ক?
(সৌজন্য:- আজকাল)