সংসদীয় দায়িত্ববোধ আর ভারতীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থার শিকড় তাঁর গভীরে প্রোথিত ছিল। তাই ২০০৮-এ তিনি আপস করেননি। ‘দেশের আগে দল’-এর ‘বিশুদ্ধ’ বিপ্লবীতত্ত্বকে নস্যাৎ করেই সোমনাথদা পক্ষ নিয়েছিলেন। দেশের পক্ষ। গণতন্ত্রের পক্ষ। সংসদীয় দায়িত্ববোধের পক্ষ।
তাঁর এই পক্ষ নেওয়াকে অবশ্য ‘দেশের আগে দল’-এর ‘বিপ্লবী নেতারা’ নস্যাৎ করেছিলেন। ‘শ্রেণিশত্রু’ তকমা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল দশ-দশবারের সাংসদ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের গায়ে। ছাত্র আন্দোলনের কর্মী হিসেবে আমি তখন দিল্লিতে থাকি। চোখের সামনে দেখার সুযোগ হয়েছিল কিভাবে তাঁর বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ চলছে। তিনি ‘পুঁজির দালাল’, ‘সিআইএর এজেন্ট’, ‘ভারতবর্ষে বিপ্লবের চূড়ান্ত ক্ষতি করছেন’, — এসব তকমা একেজি ভবনের কারাত অনুগামীরা তখন আউড়ে চলেছেন। ছাত্র অফিসে বসে কেরলের কে কে রাগেশ-এর (তৎকালীন এসএফআই-এর সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক, বর্তমানে সাংসদ) থেকে শুনতে হল সোমনাথদার মতন শ্রেণিশত্রু কিভাবে পার্টির মধ্যে ছিল, তা নাকি কেরালার নেতাকর্মীরা বুঝেই পাচ্ছেন না। বলার তির্যক ভঙ্গিমা আরও যন্ত্রণা দিয়েছিল। দিল্লিতে প্রবল বাংলা বিরোধী আবহাওয়া ততদিনে ভাল মতন টের পেয়ে গিয়েছি। প্রকাশ কারাতের বরপুত্ররা প্রবল কুৎসা ও ব্যক্তি আক্রমণ চালাচ্ছিল। তার মধ্যেই সোমনাথদাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত ঘোষণা। একেজি ভবনজুড়ে যেন যুদ্ধজয়ের উচ্ছ্বাস। ভাবখানা এমন যেন সোমনাথদাকে বহিষ্কার করে সিপিআইএম কয়েকশো বছর এগিয়ে গেল। সিদ্ধান্ত যাঁরা নিলেন তাঁরা কোনওদিন কাস্তে হাতুড়িতে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাননি। পাবেনও না। যাঁদের পাশের বাড়ির লোকেরাও ঠিক করে চেনেন না, তারাই তাড়িয়ে দিলেন দশ বারের ভোটে জেতা সাংসদকে। এরাই ১৯৯৬ সালে বাঙালিকে প্রধানমন্ত্রী হতে দেয়নি। প্রবল বাংলা বিদ্বেষী এই কারাত কোটারি সোমনাথদাকে তাড়িয়ে আরও একবার প্রমাণ করেছিল সিপিএমে ব্যক্তি পছন্দ-অপছন্দের শিকড় কতটা গভীরে প্রোথিত।
আসলে জ্যোতি বসু, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বিরোধিতা করতে গিয়ে এটাই বারেবারে প্রমাণ হয়েছে যে সিপিএম আদতে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপরই আস্থাশীল নয়। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় কারাত-কোটারি সম্পর্কে সোমনাথদার মূল্যায়ন কানে বাজে ‘They are aware of their rights but not of their responsibilities’.
কারাতদের নেতৃত্বে সিপিএম দেশের সংসদীয় রাজনীতিতে প্রায় সাইনবোর্ডে পরিণত হয়েছে। ভিজিটিং কার্ড হওয়ার দিকে এগোচ্ছে। বাস্তবতাহীন, বাক সর্বস্ব তাত্ত্বিকতা যে আজকের দিনে অসাড়, তা সিপিএমের গালভরা ‘রণনীতি’ আর ‘রণকৌশল’ দেখলেই বোঝা যায়। দেশের আগে দল- এই বীজমন্ত্র নিয়ে কারাতরা আর তাদের তল্পিবাহকরা ভারতীয় বিপ্লবের স্তর করবেন। আর সোমনাথদারা সংসদীয় গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবেই থাকবেন। ভারতবর্ষের গণতন্ত্র সেই ষোড়শ মহাজনদের আমলের গণরাজ্যে শিকড়স্থ। সেই গণতন্ত্র আবহমান কাল থেকেই চিরভাস্বর। সংসদীয় দায়বদ্ধতা আর দলের আগে দেশের অগ্রপথিক হিসেবেই বেঁচে থাকবেন সোমনাথদারা।
বাংলা ও বাঙালির প্রতি একেজি ভবনের জাতক্রোধ আজ দিনের আলোর মতন পরিষ্কার। বিজেপির মতন সিপিএমও মজ্জায় মজ্জায় বাংলা ও বাঙালি বিরোধী পার্টি। বাংলার স্বার্থ কখনোই একেজি-আলিমুদ্দিনের এজেন্ডায় ঠাঁই পায়নি। বাংলা ও বাঙালির ভাবাবেগকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলা অভ্যাসে পরিণত করেছিল সিপিএম। আর সেই কারণেই বাঙালি সিপিএমকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তাতে অবশ্য কারাত আর তার বঙ্গজ এজেন্টদের কিছু যায় আসেনি। দেশের সামনে প্রধানতম বিপদ ফ্যাসিবাদী বিজেপিকে রুখতে জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন অগ্রণী ভূমিকা নিচ্ছেন , তখন সিপিএমের স্লোগান- বিজেপিকে হারাতে গেলে আগে মমতাকে পরাজিত করতে হবে। এই সোনার পাথরবাটি মার্কা স্লোগান নিয়ে বিজেপির হাত শক্ত করে চলেছেন সিপিএমের বিপ্লবীরা। এসি ঘরের ঘেরাটোপে নিকারাগুয়ায় জিডিপি বাড়লো না কমল তা নিয়ে বিপ্লবী চর্চায় বাংলা ও বাঙালির কিছু যায় আসে না। ‘বামপন্থা’র স্বঘোষিত জাগির নিয়ে আত্মশ্লাঘায় মশগুল থাকা সিপিএম সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে সদস্য পদ ফিরিয়ে দিল কি দিলো না, পার্টি অফিসে তার দেহ নিয়ে গিয়ে লাল পতাকা দিলো কি দিলো না তা নিয়ে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মূল্যায়ন হবে না। জীবদ্দশায় যাকে পদে পদে অপমান করেছেন সিপিএমের পিবি, সিসির মাতব্বররা, তারাই অনেকে আজ কুম্ভীরাশ্রু ফেলছেন। সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়িয়ে ছিলেন সোমনাথদা। দলের আগে স্থান দিয়েছিলেন সংসদীয় গণতান্ত্রিক কাঠামোকে। সেই কাঠামো, সেই প্রতিষ্ঠান আজ ফ্যাসিস্ত আক্রমণের মুখে। সেই আক্রমণ প্রতিহত করাই এখন ইতিহাসের দায়িত্ব। সোমনাথদা কে শ্রদ্ধা জানাতে গেলে সেই সংসদীয় গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান রক্ষার লড়াইকে মজবুত করতে হবে। সোমনাথদা কে যথাযোগ্য সম্মান জানাতেই বাঙালি প্রধানমন্ত্রীত্বের স্বপ্নের বাস্তবায়ন হোক।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )