আজকের নারী স্বাধীনতার ধ্বজা অনেক দিন আগেই উড়িয়েছিলেন তিনি। মঞ্চে যখন পুরুষদের মাতামাতি তখনি নিজের জায়গা করে নিয়েছিলেন শোভা সেন। সেই সব চরিত্র শুধু থেকে যাবে। কারন মঞ্চ আজ ‘শোভা-হীন’। গতবছরের আজকের দিনে (১৪ই আগস্ট, ২০১৭) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন নাট্য ব্যক্তিত্ব শোভা সেন।
৯৪ বছরের বয়সজনিত কারণেই চলে গেছেন তিনি। রেখে গেছেন সমাজ থেকে মঞ্চ প্রত্যেক ক্ষেত্রে নারী স্বাধীনতার ধ্বজা। মঞ্চ হোক বা সিনেমার পর্দা, শিল্প জগত্ তাঁকে কখনোই উত্পল দত্তের স্ত্রী হিসাবে দেখেনি। দেখেছে শোভা সেন হিসাবেই। তিনি ১৯২৩ সালে অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেন।
স্বাধীনতার আগে মহিলাদের মঞ্চে নাটক করা মানে এক বিশাল ব্যাপার। এমন এক সময়েই ১৯৪২ সালের ৪ জুলাই,বেথুন কলেজেই নাট্যাভিনয় শুরু শ্রীমতি শোভা সেনের৷ মহিলা হয়ে পুরুষ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি৷
নাটক “শেষরক্ষা”য় গদাইয়ের বাবা এবং “সীতা”য় বাল্মীকি চরিত্রে অভিনয় দিয়েই নাট্য ব্যক্তিত্ব শোভা সেনের যাত্রা শুরু। ১৯৪৪ সালের ২৪শে অক্টোবর “নবান্ন” নাটক দেশের নাট্য ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে৷ সেই নাটকেই প্রথম পেশাদারি অভিনেত্রী হিসেবে শোভা সেনকে দেখা গিয়েছিল৷ তারপর আর ফিরে তাকাননি। একের পর এক কঠিন চরিত্রে মঞ্চ কাঁপিয়েছেন।
এসবের মাঝেই বেথুন কলেজে পড়ার সময়েই বিয়ে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য দেবপ্রসাদ সেনকে। সেই বিয়ে টেকেনি। কারন? ওই যে নিজ ব্যক্তিত্বে বাঁচতে চাইতেন শোভা। সঙ্গে চেয়েছিলেন স্বাধীনতা। অভিনয় করার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন তাঁর স্বামী,ফলে সাংসারিক বিরোধের সূচনা। অতঃপর বিবাহ বিচ্ছেদ।
তিতুমীর, ব্যারিকেড, নবান্ন এবং টিনের তলোয়ার নাটকের নায়িকা হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তিনি৷ বাড়ির দলিল বন্ধক দিয়ে তিনি দলের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন। প্রচুর বিদেশ ভ্রমণ এবং বিদেশী থিয়েটারকে আত্মস্থ করার পর সবচেয়ে বেশী প্রভাবিত হয়েছিলেন বার্লিনের হেলেন ভাইগেলের অভিনয়ের দ্বারা। এসবের মাঝেই বিবাহ বিচ্ছেদ।
১৯৬০ সালের ১০ মার্চ নাট্য সহকর্মী ও সহযোদ্ধা উত্পল দত্তকে বিয়ে। তবু লড়াই থামেনি। এবার লড়াই সংসার ধরে রাখার। টানাটানির সংসারকে ধরে রাখতে হাতিয়ার সেই অভিনয়ই।
নিমাই ঘোষের ‘ছিন্নমূল’-এর মাধ্যমে বড়পর্দায় প্রবেশ করেন তিনি। এরপর ‘সবার উপরে’, ‘পথে হলো দেরী’, ‘শঙ্খবেলা’র মতো সিুপারহিট বাংলা সিনেমায় দেখা গেছে তাকে। ঋত্বিক ঘটকের ‘ঝড়’, ‘নাগরিক’, মৃণাল সেনের ‘একদিন প্রতিদিন’, ‘এক অধুরি কাহানি’, গৌতম ঘোষের ‘দেখা’, বাসুদেব চ্যাটার্জীর ‘পসন্দ আপনি আপনি’র মতো সিনেমায় অভিনয় করেছেন তিনি। ১৯৫২ সালের হিন্দি সিনেমা ‘বাবলা’ তাকে সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এনে দেয়।
রুপোলী পর্দার ঝলকানিতে ভোলেননি প্রিয় নাট্য জগতকে। ১৯৮৭ সালে ফ্রিত্স বেনেভিত্স-এর তত্বাবধানে কাজ করেছেন “হিম্মত্বাঈ” নাটকে। ওই বছরই তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেটের সদস্য নির্বাচিত হন। শোভা সেন অভিনীত নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ও অন্যতম “বাস্তুভিটা”, বিসর্জন”, “দলিল”, “তরঙ্গ”, “নীলদর্পণ”,”ইন্সপেক্টর জেনারেল”, “কলঙ্ক” এবং পরে এল.টি.জি এবং পি.এল.টি-র প্রায় সব নাটকেই তিনি অভিনয় করেছেন। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ “স্মরণে বিস্মরণে নবান্ন থেকে লালদুর্গ”। ৭৪ সালেই শোভা সেন পেয়েছিলেন সংগীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার।
১৯৯০ সালে রাজ্য নাট্য আকাদেমি তাঁর এক ভিডিও সাক্ষাত্কার সংরক্ষণ করে। শোভা সেনের অভিনয় জীবনের ৫০ বছর সাড়ম্বরে উদযাপিত হয় ১৯৯৩ সালে। দীনবন্ধু পুরস্কারে সম্মানিত হন ১৯৯৫ সালে এবং প্রবীণ নাট্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে সংবর্ধনা ১৯৯৭ সালে। এবং অন্য থিয়েটার আয়োজিত নাট্য স্বপ্নকল্প অনুষ্ঠানে তিনি সংবর্ধিত হন ২০০০ সালে। শেষ অভিনয় ২০০৪ সালে জার্মান পরিচালক ফ্লোরিয়ান গালেবারজারের বাংলা ছবি “শ্যাডো অফ টাইম”-এ।
অভিনয়ের পাশাপাশি বামপন্থী রাজনীতিতেও তাঁকে সক্রিয় ভূমিকায় দেখা গিয়েছে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল শোভা সেনের। গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন। এই সংগঠনে শোভা সেনকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখা গিয়েছেল।
শর্ট ফিল্মের যুগে নাটক দেখার সময় হয় না আজকের প্রজন্মের। শোভা সেন নাম বললে কতজন এক ডাকে তাঁকে চিনবে তা বলা মুশকিল। কিন্তু মঞ্চ জানে শোভা সেনকে৷ ভারতীয় মঞ্চকে তিনি কি দিয়েছেন। শোভা সেন নারী স্বাধীনতা। শোভা সেন একটি অধ্যায়। শোভা সেন একটি যুগ।