১৯৮৪ সালে যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রে তাঁকে হারিয়েছিলেন আনকোরা মমতা ব্যানার্জি। ৩৪ বছর পর সেই প্রবল প্রতিপক্ষের চিরবিদায়ের সময়ে যিনি বিরল সম্মানের শ্রদ্ধাঞ্জলি নিয়ে হাজির রইলেন, তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি।
সোমবার সকালে সোমনাথ চ্যাটার্জির প্রয়াণের পর যে ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন মমতা, সেই সৌজন্য রাজ্য তো বটেই, দেশের রাজনীতিতেও বিরল।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে দশ–দশবার সাংসদ হয়েছেন। কিন্তু কখনও বিধায়ক হননি সোমনাথ। তা সত্ত্বেও তাঁর নশ্বর দেহ রাজ্য বিধানসভা ভবনের চত্বরে নিয়ে গিয়ে গান স্যালুটে বিদায় জানালেন রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান। জানালেন, কারণ, তাঁর ‘সোমনাথদা’র জন্য প্রোটোকলের নিগড় সরিয়ে রেখেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। অগ্রজ রাজনীতিবিদ, দুঁদে আইনজীবী, লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার সোমনাথ চ্যাটার্জি তো ছিলেনই। কিন্তু তাঁর প্রয়াণে সেই আনুষ্ঠানিকতা সরিয়ে রেখে শেষযাত্রায় ছোটবোনই দাঁড়িয়েছিলেন দাদার পাশে।
সেই ছোটবোনই বিধানসভায় নিজের ঘরে বসে স্মৃতিচারণ করছিলেন, ‘সোমনাথদা চলে গেলেন। উনি সংসদে আমাকে তিরস্কার করেছেন। সংসদে দেখা হত। তবে তিরস্কার রাজনীতির ব্যাপার। আমি কিন্তু সৌজন্য ভুলি না। সংসদে অনেক বিরোধ হয়েছে। কিন্তু এদিন বিধানসভায় দাঁড়িয়ে এসব ব্যাপারে কি কারও কিছু মনে হয়েছে? এটাই বাংলার সংস্কৃতি।’
বিকেলে যখন লোকসভার বর্তমান স্পিকার সুমিত্রা মহাজন সোমনাথের বাড়ি গিয়ে শ্রদ্ধা জানান, তখনও মমতা সেখানে পাঠিয়েছিলেন দলের সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েনকে।
সকালে সোমনাথের মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পরই টুইট করে প্রাক্তন লোকসভা স্পিকারের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান মমতা। পরে বিশদ শোকবার্তায় মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘বিশিষ্ট প্রবীণ রাজনীতিবিদ, আইনজীবী ও লোকসভার প্রাক্তন অধ্যক্ষ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণে আমি গভীর শোকপ্রকাশ করছি। তিনি আজ ৮৯ বছর বয়সে কলকাতায় প্রয়াত হন। ১৯৭১ থেকে ২০০৯–এর মধ্যে তিনি ১০ বার লোকসভার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৯৬ সালে তাঁকে আউটস্ট্যান্ডিং পার্লামেন্টারিয়ান অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। তিনি ২০০৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত লোকসভার স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর প্রয়াণ রাজনৈতিক জগতে এক অপূরণীয় ক্ষতি। আমি প্রয়াত শ্রী চট্টোপাধ্যায়ের আত্মীয় পরিজনসহ তাঁর অনুগামীদের আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি’।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রী পৌঁছে যান মিন্টো পার্কের কাছে বেলভিউ হাসপাতালে। দীর্ঘ রোগভোগের পর সেখানেই প্রয়াত হন প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা। সেখানেই তিনি জানিয়ে দেন, গান স্যালুটে বিদায় জানানো হবে প্রবীণ রাজনীতিককে। তার আগে তাঁর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে কলকাতা হাইকোর্টে। সেখান থেকে দক্ষিণ কলকাতায় রাজা বসন্ত রায় রোডের বাড়িতে। চক্ষু ও দেহদানের অঙ্গীকার করে গিয়েছেন সোমনাথ। তাই বাড়ি থেকে তাঁর দেহ নিয়ে যাওয়া হয় এস এস কে এমে।
বেলভিউ থেকে হাইকোর্ট হয়ে বিধানসভা— সারাক্ষণই সোমনাথের মরদেহের পাশে উপস্থিত ছিলেন মমতা। সোমনাথের স্ত্রী রেণুদেবী এবং কন্যা অনুশীলা বসুকে সর্বক্ষণ আগলে রেখেছিলেন তিনি স্বয়ং।
কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্য শ্রদ্ধা জানান সোমনাথকে। হাইকোর্টের অন্য আইনজীবীরাও শ্রদ্ধা জানান। গান স্যালুটের পর বিধানসভা ভবনে নিয়ে আসা হয় মরদেহ। বিধানসভায় সোমনাথকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন বিভিন্ন দলের বর্ষীয়ান নেতারা। তাঁরা কে কোথায় বসবেন, কোথা দিয়ে যাওয়া–আসা করবেন, তারও দেখভাল করছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। যেন তিনি বিরোধী দলের রাজনীতিক নন, পরিবারেরই এক সদস্য।
একটা সময়ে প্রবীণ রাজনীতিকের মরদেহের দিকে অপলকে তাকিয়েছিলেন দৃশ্যত শোকবিহ্বল মুখ্যমন্ত্রী। সম্ভবত তাঁর মনে পড়ছিল, দীর্ঘ ৩৪ বছর পর ২০১১ সালে সোমনাথেরই দলকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি গিয়েছিলেন সোমনাথের রাজা বসন্ত রায় রোডের বাড়িতে দেখা করতে। কথা হয়েছিল দীর্ঘক্ষণ। সিপিএম থেকে বহিষ্কৃত সোমনাথ নবীন মুখ্যমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেছিলেন, ‘ভালভাবে কাজ কর।’
সেই সৌজন্যই ফেরত এল সোমনাথের প্রয়াণে।