ঘৃণা আর প্রতিহিংসার রাজনীতিই যে বিজেপি’র একমাত্র হাতিয়ার, সোমবার তা আরও একবার স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশাপাশি গেরুয়া শিবিরের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছেন পাল্টা প্রশ্ন, এত বাংলা বিরোধী কেন বিজেপি? বাংলা ভাষায় কথা বলা তো অপরাধ নয়! এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বাধিক প্রচলিত ভাষা, গোটা বিশ্বের ক্ষেত্রে যা পঞ্চম, এহেন বাংলা ভাষাকে সম্মান দিতে জানে না ওরা। বিজেপি ভয় পায় বাংলার সভ্যতা-সংস্কৃতিকে! মমতা বলেন, ঘৃণা ছড়াচ্ছে ওরা। উগ্রপন্থামূলক চিন্তাধারা, শুধুই প্রতিহিংসার রাজনীতি। এদিন বিধানসভায় নিজের দপ্তরে বসে অসমের এনআরসি সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে এ ভাষাতেই বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বিঁধেছেন গেরুয়া শিবিরকে।
মেয়ো রোডের জনসভায় বিজেপি’র সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ যে ভাবে মমতাকে নিশানা করেছিলেন, তা পরোক্ষে বাংলা তথা বঙ্গভাষীদের অপমান বলে অ্যাখ্যায়িত করেছিল তৃণমূল। অমিত শাহের মন্তব্যের প্রতিবাদে রাজ্যজুড়ে ধিক্কার দিবসও পালন করে জোড়াফুল শিবির। এই প্রসঙ্গে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, মমতাকে আক্রমণ মানেই বাংলাকে আক্রমণ। বাংলা আর মমতা আলাদা নয়। অমিত শাহের ওই মন্তব্য ইস্তক তৃণমূল শিবির থেকে নানা প্রতিক্রিয়া এলেও, এই প্রসঙ্গে এদিন দলের সুপ্রিমোর মুখ খোলাটা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। বিজেপি’র বিরুদ্ধে তোপ দাগার সময় কাউকে নিশানা করেননি মমতা। শুধু বলেছেন, বাংলা সবাইকে আপন করে নিতে পারে। সংস্কারের পথপ্রদর্শক বাংলা। কৃষ্টি আর সংস্কৃতির পীঠস্থান বাংলা। এহেন বাংলাকে যারা অপমান করে, আমি তাদের পছন্দ করি না। ওরা কেন এত বাংলা বিরোধী! আই অ্যাম শকড! একইসঙ্গে সৌজন্যই যে বাংলার কৃষ্টির একমাত্র ইউএসপি, সেটাও মমতা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন গেরুয়া শিবিরকে। বলেছেন, আজ সোমনাথ’দা প্রয়াত হয়েছেন। মতাদর্শগত বিরোধ ছিল। তবুও নির্বাচনে দাঁড়িয়ে তাঁকে প্রণাম করতে গিয়েছিলাম। লোকসভায় বহুবার তিরষ্কার করেছেন আমাকে। আজ দেখে কী মনে হচ্ছে, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর সৌজন্যতে কোনও রাজনীতি ছিল? ছিল না। এটাই বাংলা। বিজেপি’র রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ এদিন দাবি করেছেন, বাংলাকে তাঁরা হৃদয় দিয়ে ভালোবাসেন। তাঁর কথায়, নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ এ রাজ্যকে পরবর্তী টার্গেট হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তাই ভয় পেয়ে মুখ্যমন্ত্রী এসব বিভ্রান্তিকর মন্তব্য করছেন।
এনআরসি প্রসঙ্গে একটি সর্বভারতীয় নিউজ এজেন্সিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম করে তাঁকে আক্রমণ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। মোদির সেই তোপের জবাব দিয়েছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন। এদিন ফের সেই এনআরসি ইস্যুতে মুখ খুলেছেন তৃণমূল সুপ্রিমো। যাদের নাম এনআরসি থেকে বাদ পড়েছে, তার মধ্যে ৭০ শতাংশ বঙ্গভাষী। বাংলার সভ্যতা-সংস্কৃতি নিয়ে যাদের কোনও ধারণা নেই, তারাই এসব করছে। মমতার অভিযোগ, অনুপ্রবেশকারীর তকমা দিয়ে ভারতীয় নাগরিকদের ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। খেতে দেওয়া হচ্ছে না, অবর্ণনীয় অত্যাচার চলছে। আমি বিদেশিদের নয়, ভারতীয় নাগরিকদের হয়েই সওয়াল করছি। তাঁদের পাশে আছি, থাকব। মমতা বলেন, সেদিন এক বৈদ্যুতিন সংবাদ মাধ্যমের অনুষ্ঠানে এক ছাত্র ট্যুইট করে আমার কাছে জানতে চায়, দিদি, ১৯৭০ সালের ভোটার তালিকাটা পাওয়া যাবে? ভাবুন তাহলে, ওই সময়ের ভোটার তালিকায় নাম থাকা লোকজনও এনআরসি থেকে বাদ পড়েছে। তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, আজ যদি আমায় বলা হয়, তোমার মায়ের বার্থ সার্টিফিকেট জমা দাও, আমি কোথায় পাব? না দিতে পারলে, সবাই অনুপ্রবেশকারী। কটাক্ষের সুরে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ইলিশ, জামদানি শাড়ি, মিষ্টি দই, সন্দেশ আর আম— দু’পারেই জনপ্রিয়। এদের কীভাবে চিহ্নিত করা হবে? অনুপ্রবেশকারী নাকি শরণার্থী!
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ফের মানুষকে উদ্বাস্তু করার চক্রান্ত চলছে। উদ্বাস্তুদের লড়াইয়ে আমি ছিলাম, তাঁদের কষ্টটা বুঝি। একসময়ে সব কিছু ছেড়ে এক কাপড়ে এপারে চলে এসেছিলেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। অনেক কষ্টে তাঁরা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন, এখন আবার তাঁদের তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা! এসবই ঘৃণার রাজনীতি, বিভাজনের পন্থা।