আমরা অনেক সময় শুনে থাকি ভুয়ো প্রাইভেট ইনস্টিটিউটে ছাত্রদের প্রতারিত হওয়ার কথা। বেশ কিছু বছর পড়াশুনো করে তারপর জানতে পাড়া যায় যে সেই সংস্থা ভুয়ো, কোনো এফিলিয়েশানিই নেই। এই ধরণের সংস্থাগুলো যাতে দেশে না গজিয়ে উঠতে পারে তার জন্য সরকারের কাছ থেকে সব সময় আমরা কড়া পদক্ষেপ আশা করি।
কিন্তু যদি বলি এমন এক সংস্থা আছে আমাদের বাংলায়, বহাল তবিয়তে কাজ করে চলেছে। একটু চিন্তিত হবেন, কিন্তু অস্বাভাবিক তো নয়। এরম তো কতই হয়ে, এ আর নতুন কি ? দাবী জানাবেন যাতে সরকার দ্রুত কড়া পদক্ষেপ নেয়। যদি বলি এটা কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা, শুধু তাই নয় ঢাক ঢোল পিটিয়ে তৎকালীন দেশের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, ইউপিএ চেয়ারম্যান সোনিয়া গান্ধী এবং অসংখ্য নামি দামি ব্যক্তিরা এসে এই সংস্থা উদ্বোধন করেন ২০১০ সালে বাংলার মালদা জেলায়। এবং পরবর্তী সময়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি অব্দি এসেছেন, এই ইনস্টিটিউটের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। কি ? ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না তো ? হ্যা। আমারো হয়নি যেদিন প্রথম শুনলাম গনি খান ইনস্টিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (জিকেসিআইটি)-র কথা।
আজও যদি আপনি কেন্দ্রীয় সরকারের মানবসম্পদ মন্ত্রকের ওয়েবসাইটে যান দেখতে পাবেন জ্বলজ্বল করে লেখা আছে জিকেসিআইটির নাম। মজার ব্যাপার হলো এটি ভারত সরকারের বাংলার বুকে তৈরি করা একমাত্র টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট। প্রযুক্তি-শিক্ষা প্রদান, স্বনির্ভর করা ও প্রযুক্তিতে পারদর্শী লোকবল তৈরি করার জন্য ২০১০ সালে এটা তৈরি হয়ে ভারতবর্ষের মড্যুলার প্যাটার্নে চতুর্থ ইনস্টিটিউট হিসেবে। এই সংস্থা তৈরির পিছনে সরকারের মূল লক্ষ্য ছিল সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণীকে এগিয়ে নিয়ে আসা, তাদের প্রযুক্তি-শিক্ষা প্রদান করা এবং স্বাধীন ভাবে, স্বনির্ভরতা ও স্বসম্মানে জীবন যাপন করার একটা পথ তৈরি করে দেওয়া। কিন্তু সমাজের চিরাচরিত নিয়মে এই উপেক্ষিত, অনুন্নত সমাজের মানুষগুলো আরো একবার প্রতারণার শিকার হলো। এইবার তার প্রতারক আর কেউ নয় তার রক্ষক নিজেই।
মড্যুলার প্যাটার্ন হওয়ার সুবাদে মাধ্যমিক পাস করেই এখানে ভর্তি হওয়া যায়। প্রথমে দুই বছর ক্লাস টুয়েলভ সমতুল্য ডিগ্রি, তারপর দুই বছর ডিপ্লোমা ও দুই বছর বিটেক কোর্স করার পর ২০১৬ সালে তারা সার্টিফিকেট নিতে গিয়ে জানতে পারে, এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোনো এফিলিয়েশানি নেই তাই তারা কোনো সার্টিফিকেট দিতে পারবে না। ২০১০ থেকে ২০১৬ , জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান ৬টা বছর দেওয়ার পর, এতগুলো টাকা,সময়, শ্রম ব্যয় করার পর তারা জানতে পারে সব মিথ্যে। জীবনের ছ-ছটা বছর শিক্ষা অর্জনে মনোনিবেশ করার পর তারা জানতে পারে বাজারে তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা হলো ক্লাস ১০ পাস।
এই নির্লজ্জ প্রতারণা, কিছু মানুষের ক্ষমার অযোগ্য অপদার্থতা এতগুলো ছেলে-মেয়ের জীবনকে আজ খাদের কিনারায় নিয়ে চলে এসছে, এক অন্ধকার, বিষন্নতা মোড়া ভবিষৎ উপহার দিয়েছে। আজ তাদের সামনে বাঁচবার একটাই পথ, “সংগ্রাম”। এটা সেই চেনা পথ, যার ওপর দিয়ে তারা বহুবার হেঁটেছে, এই পথ তাদের মানুষ করে তুলেছে, ভেবে ছিল যদি জীবনে ভালো করে পড়াশোনাটা করতে পারে হয়তো এই অন্ধকারের জীবন একদিন অতীত হবে। নতুন সূর্য, নতুন সকাল নিয়ে আসবে। কিন্তু আজ আরও একবার তাদের জগতের দরবারে পরীক্ষায় বসতে হবে। আরও একবার ওদের চোখে আঙুল দিয়ে সমাজকে দেখিয়ে দিতে হবে কিভাবে প্রতিনিয়ত তারা প্রতারিত, বঞ্চিত, উপেক্ষিত। তারা হারতে জানে না, হার মানে যে মৃত্যু, তারা মরতে জানে না। তারা সংগ্রাম করতে জানে। সংগ্রাম করে, সকল বাধাকে ম্লান করে নিজের হক আদায় করতে জানে।
সেই সংগ্রামের পথই বেছে নিল গনি খানে যুবক যুবতীরা। ২৬ দিন অনশন চললো। জাতীয় সড়ক, রেলপথ স্তব্ধ হলো। অবশেষে রাজ্য সরকার ডিপ্লোমা অব্দি এফিলিয়েশান দেওয়ার ঘোষণা করলো, বিটেকের এফিলিয়েশান এনএইটি দুর্গাপুর দেবে বলে ঘোষণা করল কেন্দ্রের মানবসম্পদ মন্ত্রক। কিন্তু পরবর্তী সময়ে রাজ্য সরকার তার কথা রাখলেও, এনআইটি দুর্গাপুরের কতৃপক্ষ তাদের দেওয়া কথা থেকে সরে আসেন, ছাত্ররা আরো একবার প্রতারিত হলো।
আজ ২০১৮ সালের প্রায় অর্ধেক পেরিয়ে গেলেও গনি খানের ছেলে-মেয়েরা তাদের বিচার পায়নি। ১৬ বছরের সেই ছেলে-মেয়েগুলোর আজ বয়েস হয়েছে ২৪। যারা নতুন ভোরের স্বপ্ন নিয়ে একদিন এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পা রেখেছিল, সংগ্রাম এখন তাদের দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতা। প্রতিনিয়ত বঞ্চিত ও প্রতারিত কিন্তু হার না মানা অক্লান্ত সংগ্রামের নাম গনি খান। এদের নিয়ে পেপারে খবর পাবেন না, এদের নিয়ে কলকাতার নামি দামি চ্যানেলে টক শো পাবেন না, এদের নিয়ে বুদ্ধিজীবী, বিদ্বজনদের মিছিল,মিটিং কিছুই পাবেন না। কারণ এরা সবাই নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান, কলকাতার জাঁকজমক থেকে বহুদূর, এলিট বামপন্থী অতলামির থেকে বহুদূর মাঠে ঘাটে ঠোকর খাওয়া লড়াকু সন্তান। মার্ক্স-এঞ্জেলস, লেনিন, ট্রটস্কি পড়ে এদের শিখতে হয়নি শ্রেণী সংগ্রামের বাস্তবতা। এরা জানে হোস্টেল-অ্যাডমিশান ভক্ত ছাত্র-যুব নেতাদের তাদের প্রতি কোনো দয়া, পিরিত নেই। তাদের লড়াই তাদেরকেই করতে হবে, ঠিক যেরম চিরাচরিত করে এসেছে, ঠিক যে ভাবে আমাদের সমাজে এ যাবৎকাল হয়ে এসেছে। গণি খানের ছেলে-মেয়েরা সেই চেনা পথেই হাঁটবে তাদের ন্যায্য দাবী আদায়ের জন্য। গনি খানের ছেলে-মেয়েদের মশালের আলো আজ রাজপথের অন্ধকার কাটিয়ে এগিয়ে চলেছে সেই নতুন সকালের দিগন্তে। কথা ছিল জিকেসিআইটি এই ছেলে-মেয়েদের সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখাবে। না, তাদের মাথা চিরকালই উঁচু ছিল, তাদের মেরুদণ্ড চিরকালই শক্ত ছিল,আজ তারা আর একবার সেটা প্রমান করে দেখাবে।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )