সবুজে ঘেরা রাস্তা। লোকজন খুব বেশি চলাচল করে না। এই জাতীয় সড়ক দিয়েই শিলচর থেকে গুয়াহাটি যাওয়া যায়। রাস্তাটি সত্যিই অদ্ভূত। অসমের বরাক উপত্যকা থেকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় পৌঁছতে গেলে এই রাস্তা দিয়েই যেতে হবে। কিন্তু এই রাস্তার আকর্ষণীয় বিষয় হল, ভৌগোলিক কারণে রাজ্যের একস্থান থেকে অন্যত্র যেতে হলে, পড়শি রাজ্য মেঘালয়ের বিস্তীর্ণ অংশ পেরিয়ে যেতে হয় অসমবাসীকে। অনেকে এই রাস্তাটিকে শিলং রোডও বলে। এই রাস্তাই এখন জাতীয় নাগরিকপঞ্জি প্রকাশের পর বহু মানুষের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমস্যাটি বোঝার জন্য রবিবার গভীর রাতে গুয়াহাটি থেকে গাড়ি রিজার্ভ করে প্রায় আট-ন’ঘণ্টা সওয়ারির পর পৌঁছলাম অসমের কালাইনে। এই যাত্রায় গুয়াহাটি-মেঘালয় সীমান্তের জোড়াবাট দিয়ে কোনও সমস্যা হয়নি। কিন্তু বরাক উপত্যকায় ঢোকার জন্য মেঘালয়-অসম সীমান্তের রাতছড়া পৌঁছতেই ভুল ভাঙল ।
মেঘালয়ের পূর্ব জয়ন্তিয়া হিলস জেলার রাতছড়া-উমাকিয়াংয়ের মাঝখানে পৌঁছতেই দেখি, সারি সারি গাড়ি দাঁড়িয়ে। সামনেই চেকপোস্ট। পুলিস রয়েছে। সঙ্গে রয়েছে বেশ কয়েকজন যুবক। বরাক উপত্যকা থেকে যে গাড়িগুলি গুয়াহাটিমুখী, সেগুলিতে চলছে দফায় দফায় তল্লাশি। গুয়াহাটিমুখী বাসগুলি থেকে বাঙালিদের নামিয়ে নাগরিকপঞ্জির কাগজ দেখা হচ্ছে। পুলিসকে টপকে ওই যুবকরা যেন মুরুব্বির ভূমিকা নিয়েছে। অন্ধকারে ডুবে থাকা রাস্তাটিতে এভাবে তল্লাশি দেখেই মনে হল, এই যুবকরা হল খাসি স্টুডেন্টস ইউনিয়ন নামক ছাত্র সংগঠনের সদস্য। যাদের এখন একটাই নীতি, এনআরসি’তে নাম নেই, তাই মেঘালয় দিয়ে গুয়াহাটি যাওয়ার অনুমতি নেই। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নয়, সরাসরি তারা গুয়াহাটিগামী গাড়িগুলোতে থাকা যাত্রী বা চালকদের মুখের উপরে বলে দিচ্ছে সেই কথা। ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে রাস্তার মাঝপথ থেকেই। এনআরসি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ যে এরা মানছে না, সেটি বুঝতে বেশি সময় লাগল না। গাড়িতে বসেই দেখতে পেলাম, গুয়াহাটিগামী একাধিক চালককে মাঝপথে রীতিমতো হেনস্তা করা হচ্ছে। দেখলাম বেশ কয়েকজনের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কিও হচ্ছে। রাতের রাস্তায় পুলিসের সামনে এভাবে হেনস্তা! পরিস্থিতি ভালোভাবে দেখার জন্য গাড়ি থেকে নামতেই হেনস্তার শিকার হওয়া এক রূপঙ্কর চৌধুরী নামে বাঙালির সঙ্গে দেখা। তিনি বললেন, বাঙালি হলেই মুশকিলে পড়তে হচ্ছে। তাঁদের মতো বরাকের বাঙালিদের অধিকাংশকে রাতছড়া থেকে ফিরে আসতে হচ্ছে। গুয়াহাটিতে কাজ থাকলেও, যেতে দেওয়া হচ্ছে না। নাগরিকপঞ্জির খসড়ায় নাম ওঠার প্রমাণ চাওয়া হচ্ছে তাঁদের কাছে। অথবা ১৯৭১-এর আগের কাগজপত্র। খসড়ার প্রমাণপত্র অনেকেই এখনও সংগ্রহ করতে পারেননি। আর ’৭১-এর আগের কাগজপত্র? সেটাই বা কতজনের কাছে থাকতে পারে বলুন, আমাকেই প্রশ্ন করলেন রূপঙ্করবাবু।
তল্লাশির জেরে যানজট থাকায় গাড়ি থেকে নেমে রূপঙ্করবাবুর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই দেখলাম, আরও এক বাঙালি ব্যক্তি রবিরঞ্জন নাথ রীতিমতো কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। বরাক উপত্যকার ওই বাসিন্দা গুয়াহাটিতে ব্যবসা করেন। দু’টি ট্রাকে করে কয়েক লক্ষ টাকার সামগ্রী নিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তাঁকে যেতে দেওয়া হবে না। কারও তিনিও তালিকা-ছুট। কী হয়েছে? জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, আমাকে বলা হচ্ছে, বিমানে সামগ্রী নিয়ে যেতে। যতদিন পঞ্জিতে নাম নেই, এই রাস্তা দিয়ে ব্যবসার মালপত্র নিয়ে যাওয়ার অনুমতি নেই। আমরা কী করতে পারি বলুন তো! বিমানে কত খরচ করব? জীবনভর এই রাস্তা দিয়েই গিয়েছি। ছয়ের দশক থেকে আমি বরাক উপত্যকায় থাকি। তাও নাম ওঠেনি। বাঙালি বলেই হয়তো ব্রাত্য পঞ্জিতে। ব্যবসা না করলে, চলবে কীভাবে? কীভাবে এই সমস্যার সমাধান হবে, জানি না। অসহায় রবিরঞ্জনবাবুকে গাড়ি নিয়ে ফিরে যেতে দেখলাম।
সংশ্লিষ্ট রাস্তাটি শুধু বরাক-ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার যোগাযোগের মাধ্যমই নয়, ত্রিপুরা-মিজোরাম যেতে হলেও এই রাস্তা ব্যবহার করতে হয়। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে লোকসভায় শিলচরের এমপি সুস্মিতা দেব অভিযোগ করেছিলেন, মেঘালয়-অসম সীমান্ত দিয়ে যাতায়াতকারী বাঙালিদের শারীরিক নিগ্রহ করা হচ্ছে। তালিকাছুট নাগরিকের নিরাপত্তার দাবি জানান তিনি। অসমের সচিবালয় সূত্রে খবর, রাজ্যের মানুষদের হেনস্তা করা নিয়ে মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমার সঙ্গে কথা বলেছেন অসমের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনওয়াল। কিন্তু খাসি স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সদস্যদের তা নিয়ে বিশেষ মাথাব্যথা নেই। কারণ তাদের একটাই মন্ত্র, বাঙালি মানেই অনুপ্রবেশকারী। শুধু অসম নয়, তালিকাছুট সেই বাঙালির মেঘালয়েও ঠাঁই নেই।
আমার গাড়ি বরাক উপত্যকাগামী ছিল। তাই বিশেষ অসুবিধা হল না। তার উপর গাড়ির চালক অসমীয়া। সেই পুলিসের সঙ্গে কথা বলল। আমার গাড়িও ছেড়ে দেওয়া হল। পাশাপাশি, আমাকে নিয়ে পুলিসের কৌতুহল ওই চালকই নিজঙ্গ ভঙ্গিতে সমাধান করলেন। গাড়ি চলতে শুরু করলে চালক রবীন্দ্র সিংকে জিজ্ঞেস করলাম, কোনও সমস্যা হয়নি তো? সে বলল, আমি অসমীয়া, আর ভাগ্যক্রমে জাতীয় নাগরিকপঞ্জির কাগজও রাখা ছিল। তাই অসুবিধা হয়নি।
(সংগৃহীত)