দেশেই হোক বা বিদেশে সর্বত্রই প্রতিবাদী কণ্ঠকে থামিয়ে দেওয়াটাই বিজেপির এখন প্রধান অ্যাজেন্ডা। প্রথমে শিকাগো তারপর চিন সবশেষে দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তৃতা একেবারে শেষ মুহূর্তে বাতিল করে দেওয়ার রহস্য লুকিয়ে আছে এখানেই। মোদী-অমিতদের ভয়, সুযোগ পেলেই দেশ বিদেশের মানুষদের কাছে তাদের সুশাসন এর প্রকৃত চেহারাটা তুলে ধরবেন বাংলার অগ্নিকন্যা। বিদেশের আলোকপ্রাপ্ত মানুষ আর নামী কলেজের ছাত্রছাত্রীদের কাছে আমাদের দিদি তার ঘরোয়া ঢঙে যুক্তি সাজিয়ে ভারতবর্ষে মোদীরা কেমন সুশাসন চালাচ্ছেন তা তুলে ধরলে তাদের সযত্নে নির্মিত ব্র্যান্ডটি তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়বে। তাই তাকে ন্যাশনাল বা ইন্টারন্যাশনাল কোন গুরুত্বপূর্ণ ফোরামে কোনভাবেই মুখ খুলতে দেওয়া যাবে না। এটা বিজেপির একটা অঘোষিত নীতি। এ কারণেই তিনটি জায়গাতে একই ঘটনা ঘটেছে। এটা আমার কোন রাগের কথা নয়, একটু তলিয়ে ভাবলেই আপনাদের কারও কাছেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছনো কঠিন হবে না।
দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজে দিদির বক্তৃতার বিষয় ছিল, নেশন অ্যান্ড ইটস সেকুলার রুটস। নামেই বোঝা যাচ্ছে এই প্রসঙ্গটিতে ব্যাপক বিপদে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে মোদী-অমিতদের। ক্ষমতায় আসার পর থেকে গোটা ব্যাপারটার যাকে বলে একেবারে আদ্যশ্রাদ্ধ করে ছাড়ছেন তারা। এর ওপর সেন্ট স্টিফেন্সের জিজ্ঞাসু ছাত্রছাত্রীদের কাছে যদি তিনি মোদী অ্যান্ড কোং-এর সাম্প্রদায়িক কাজকারবারের নমুনা পেশ করেন তাহলে তারা আরও বিপদে পড়ে যাবেন। এমনিতেই অবস্থা ভাল নয়। ওয়াকিবহাল মহলের মতে এক প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর চাপে এই কাজটি করতে বাধ্য হয়েছেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। অনুষ্ঠান বাতিল করার যুক্তি হিসেবে কলেজ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, ইনঅ্যাডিকোয়েট ইনফ্রাস্ট্রাকচার বা অনুপযুক্ত পরিকাঠামোর কথা। এটা একটা হাস্যকর যুক্তি, কারণ ছ সপ্তাহ আগে অনুষ্ঠানটি হবে বলে স্থির করা হয়। তারপর আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর অফিসে। বলা হয়, কবে আসতে পারবেন তা তিনি যেন নিজেই ঠিক করে তাদের জানান। এরপর দিদি তাতে সন্মতি দেন। অবশেষে শুক্রবার বেলা ৩টের পর প্ল্যানিং ফোরাম নামে কলেজের স্টুডেন্ট বডির তরফে একটা ইমেল মারফৎ জানানো হল অনুষ্ঠান বাতিল হওয়ার কথা। সেন্ট স্টিফেন্সের মত একটা নামী কলেজে বক্তৃতা দেওয়ার মত পরিকাঠামো নেই এটা কি কোন যুক্তিসঙ্গত কথা? আর তা না থাকলে ছ সপ্তাহ আগে তাকে আমন্ত্রণ জানানোই বা হল কেন? কলেজ কর্তৃপক্ষ কী ভেবেছিলেন, ছ সপ্তাহের মধ্যে একটা পরিকাঠামো গড়ে তুলতে পারবেন তারা? এ ব্যাপারে প্রিন্সিপালের বক্তব্য আমরা জানিনা।
সমস্যাটা আসলে অন্য জায়গায়। আগামী ৩১শে জুলাই দিল্লিতে ইন্ডিয়ান ক্যাথলিক চার্চের বিশপদের একটা কনফারেন্সে দিদি যোগ দেবেন। সেখানে তার বক্তৃতার বিষয়, সংখ্যালঘুদের ওপর বেড়ে চলা অসহিষ্ণুতার বিপদ। প্রথমে সংখ্যালঘুদের কাছে বক্তৃতা, যার আবার বিষয় তাদের ওপর বেড়ে চলা অসহিষ্ণুতা, তারপর ছাত্রদের কাছে ধর্ম নিরপেক্ষতা বিষয়ে বক্তৃতা, এর কোনটাই বিজেপির পক্ষে হজম করা কঠিন। কারণ তারা জানে দিদি যদি এ ব্যাপারে মুখ খোলেন তাহলে তা মোটেই তাদের পক্ষে যাবে না। তাই তারা পারলে দুটি অনুষ্ঠানই আটকাতে চেয়েছিল।
ছাত্রদের কাছে জোরালো বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া কী হয় তা আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বিলক্ষণ জানা আছে। ২০১৩ সালে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে তার গরম গরম বক্তৃতায় বিরাট প্রতিক্রিয়া হয়েছিল শ্রীরাম কলেজের ছাত্রদের মধ্যে। শ্রোতাদের অনেকে বলেছিলেন তিনিই ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। অনেকে আবার বলেছিলেন মোদী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার নায়ক। বক্তৃতা চলাকালীন সময়ে বাইরে চলছিল বিরাট ছাত্র বিক্ষোভ। বক্তৃতার শক্তি জানেন বলেই তার চ্যালা চামুণ্ডারা তাদের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারেন এমন কাউকে ঘরে বাইরে কোন জায়গাতেই বক্তব্য রাখতে দিতে নারাজ। শ্রীরাম কলেজে যাবতীয় বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি বক্তব্য রাখলেও দিদির মত কাউকে ছাত্রছাত্রীদের ফোরামে বক্তব্য রাখতে দিতে নারাজ তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা। বিজেপির রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার এ এক সাম্প্রতিকতম নিদর্শন।
শ্রীরাম কলেজের মঞ্চে যিনি দেশকে ২১শতকের উপযোগী করে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ক্ষমতায় আসার পর তার একের পর এক জনবিরোধী সিদ্ধান্ত গোটা দেশকে এক বিরাট গহ্বরের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। ডিমনিটাইজেশন থেকে শুরু করে কৃষকদের থেকে খাদ্যশস্য সংগ্রহের নুন্যতম সহায়তা মূল্য হ্রাস, আদিবাসী ভূমিপুত্রদের নিজেদের জমি থেকে উচ্ছেদ, গঙ্গা দূষণ ও স্বচ্ছ ভারত গড়ার নামে কোটি কোটি টাকা নয়ছয়, দেশের টাকা মেরে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া মানুষদের আড়াল করা এমন একের পর এক ঘৃণ্য কাজ করে চলেছে মোদী অ্যান্ড কোং। নিজেদের ট্র্যাক রেকর্ড নিজেদের কাছে পরিষ্কার বলেই কাউকে এনিয়ে সরব হতে দিতে তারা নারাজ। সঙ্গত কারণেই দিদিকে তারা প্রধানতম রাজনৈতিক শত্রু বলে মনে করেন। এজন্যই দেশে বিদেশে দিদিকে বক্তব্য রাখতে দিতে চান না তারা। গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করার যে চেষ্টা তারা করে চলেছেন তা কিন্তু গোটা দেশের মানুষ ভালভাবে মেনে নিচ্ছেন না। তাই সরব হচ্ছেন মানুষ।
শুধু মোদী নয় পৃথিবীর যে কোন শাসকই তার ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার সময় এগিয়ে এলে ঠিক এই কাজটিই করেন। অনেক আস্ফালন সত্ত্বেও মোদীরা এখন হয়ে উঠেছেন একটা হাসির খোরাক। দিদির বক্তৃতা বাতিল করা তাদের সেই শয়তানি মাখা এক হাস্যকর কর্মকাণ্ড। এ কাজ তারা যতবার করতে যাবেন ততবার অপ্রস্তুত হবেন। দিদির যে কোন বক্তৃতাতেই কোন প্রচার ছাড়াই অসংখ্য মানুষ আসেন। মোদীদের এই কাজকারবার দেশের যে কোন জায়গাতেই দিদির সভায় ভিড় বাড়াবে। তাই এই শেষ বেলায় এমন হাস্যকর কাজকারবার না করলেই আপনাদের মঙ্গল। মানুষের প্রতিবাদের ভাষাকে পড়তে শেখাটাই কিন্তু শাসকদের সবচাইতে প্লাস পয়েন্ট।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )