প্রধান শত্রুর বিরুদ্ধে এক হয়ে লড়াই করা যে কোন যুদ্ধের আসল কথা। রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি সব ক্ষেত্রেই একথা খাটে। দিদির ফেডারাল ফ্রন্টের ডাক নিয়ে গোটা দেশের রাজনীতিতে যে আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছে তার দিকে নজর রাখলে এ সত্যটা পরিষ্কার হবে। বিজেপির মত একটা দানবিক শক্তি যা দেশের একটা নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের ভোট ব্যাঙ্ককে নিজেদের স্বপক্ষে টেনে আনার জন্য নানা কৌশলের আশ্রয় নিয়ে গোটা দেশকে আড়াআড়ি ভাবে ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছে তা রুখতে ফেডারাল ফ্রন্ট ছাড়া আর কোন রাস্তা নেই। দিদি প্রায় বছর দুয়েক আগে থেকে বিজেপিকে রুখতে বারবার এই কথাটা বলে আসছেন। তিনিই প্রথম বিজেপির বিরুদ্ধে একটি ফেডারাল ফ্রন্ট গড়ে তোলার জন্য সমাজবাদী পার্টি, টি ডি পি, কংগ্রেস, ডি এম কে, বহুজন সমাজ পার্টি, এন সি পি, ন্যাশনাল কনফারেন্স এমনকি সিপিএমের সঙ্গেও সংলাপ শুরু করেন। স্বাভাবিক রাজনৈতিক দূরদর্শিতা থেকেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এটাই বিজেপির মত একটা সাম্প্রদায়িক দলকে রোখার এবং ক্ষমতাচ্যুত করার একমাত্র রাস্তা। এর জন্য নিজেদের অন্যান্য রাজনৈতিক বিরোধকেও উপেক্ষা করতে হবে এবং আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার চেষ্টা করতে হবে। মোদ্দা কথা, এই মুহূর্তে গোটা দেশ জুড়ে লড়াই শুধুমাত্র বিজেপির সঙ্গে। এটাই দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা।
এই আওয়াজটাই এতদিন পর বিজেপির মনে ভয় ধরাতে পেরেছে। ফেডারাল ফ্রন্ট ভাঙার জন্য বিজেপি যথারীতি হট অ্যান্ড কোল্ড ট্রিটমেন্টের রাজনীতি শুরু করে দিয়েছে। শিব সেনা, রামবিলাস পাসোয়ানের লোকজনশক্তি পার্টি, অকালি দলের মত যে সব ছোট খাটো এন ডি এ শরিকদের মোদী গত কয়েক বছর ধরে মোটেই পাত্তা দিচ্ছিলেন না তাদের সঙ্গেও এখন তোয়াজ করে কথা বলছেন মোদী-অমিতরা। অসুস্থ করুণানিধির শারীরিক অবস্থা জানতে চেয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফোন করছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু তাতে বরফ গলছে না কারণ, এই দলগুলির নেতারা বুঝতে পারছেন জনবিরোধী এই সরকারের সঙ্গে থাকলে নিজেদের রাজ্যে তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। মোদী সরকারের বিরুদ্ধে দেশের দলিতদের অসন্তোষ নিয়ে মোদীকে চিঠি লিখেছেন রামবিলাসের ছেলে চিরাগ পাসোয়ান। মহারাষ্ট্রেও শিবসেনা ও এন সি পির মোদী বিরোধী জেহাদ তুঙ্গে। ফেডারাল ফ্রন্টের ডাক এন ডি এ-এর অবহেলিত শরিকদের মধ্যেও এক বিকল্প ভাবনার জন্ম দিয়েছে, যা বিজেপির থিঙ্ক ট্যাঙ্কদেরও ভাবাচ্ছে। আগামী ৩০শে আগস্ট চেন্নাইয়ে রাজ্য স্বশাসন সন্মেলন এর ডাক দিয়েছেন ডি এম কে নেতা স্ট্যালিন। কারণ, এই উদ্যোগগুলির মধ্যে দিয়ে সংগঠিত হচ্ছে দেশজোড়া বিজেপি বিরোধী শক্তি।
জাতীয় ক্ষেত্র ছেড়ে রাজ্য রাজনীতির দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব ফেডারাল ফ্রন্টের ডাকে সিপিএম রাজনৈতিকভাবে ব্যাপক অসুবিধায় পড়ে গেছে। তারা এটা গিলতেও পারছে না, ওগরাতেও পারছে না। মতাদর্শগত ভাবে বিজেপি তাদের প্রধানতম শত্রু। প্রধান শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করার সব থেকে বড় হাতিয়ার হচ্ছে বিজেপি বিরোধী অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ফেডারাল ফ্রন্ট। কিন্তু রাজনৈতিক সুবিধাবাদ তাদের মমতা বিরোধিতার বাইরে বেরোতে দেয় না। বিজেপির জনবিরোধী রাজনীতি দেশের শাসকদলের বিরুদ্ধে সিপিএমকে সরব হতে বাধ্য করেছে। এই বাধ্যবাধকতার জন্যই তাদের নেতারা এখন সব ছুৎমার্গ দূর করে ফেডারাল ফ্রন্টে সামিল হওয়ার ব্যাপারে ভাবনা চিন্তা শুরু করেছেন। অবশ্য তীব্র মমতা বিরোধিতার কারণে এই নিয়ে তাদের মধ্যে মতপার্থক্যও আছে।
বিজেপি অবস্থা সামলাতে না পেরে খুবই সুপরিকল্পিতভাবে বিরোধী ঐক্যে ফাটল ধরানোর জন্য একটা চেষ্টা করেছিল। তাও মাঠে মারা গিয়েছে। এখন তারা বলার চেষ্টা করছে, ফেডারাল ফ্রন্টের নেতা কে হবে তা বিরোধীরা জানাতে পারছেন না। এই নেতৃত্ব নিয়ে তাদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। নেতৃত্ব নিয়ে এই অশান্তির জেরেই ভেঙে যাবে ফেডারাল ফ্রন্ট। কিন্তু শকুনের অভিশাপে গরু মরে না। তাই এখনও অবধি ফ্রন্ট ভাঙার কোন লক্ষন দেখা যাচ্ছে না। বরং আগামী ১৯শে জানুয়ারি ব্রিগ্রেড প্যারেড গ্রাউন্ডে দেশের বিজেপি বিরোধী শিবিরের প্রথম সারির নেতাদের নিয়ে দিদি দেশ থেকে বিজেপিকে হঠানোর জন্য যে রাজনৈতিক সমাবেশের ডাক দিয়েছেন তা থেকে এই কর্মসূচি এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছবে বলেই রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
দেশের বিরোধী দলগুলিকে এক করার প্রক্রিয়া প্রথমে শুরু করেছিলেন আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরিস্থিতি তাকে এই প্রক্রিয়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এনে ফেলেছে। মূলত পাঁচটা কারণে এটা ঘটছে। এক, রাজ্যে দিদিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মত এখন আর কেউ নেই। দুই, ফেডারাল ফ্রন্ট নিয়ে তার বক্তব্য এখন গোটা দেশের বিরোধী দলনেতারা মূলত স্বীকার করে নিয়েছেন। তিন, ফেডারাল ফ্রন্টের ডাক এন ডি এ এর শরিকদলগুলিকেও মুখ খোলার সাহস দিয়েছে। শাসক ফ্রন্টে বিভেদ বিজেপির অস্বস্তি বাড়িয়েছে। চার, রাজ্যের দুটি প্রধান বিরোধী দল সিপিএম ও কংগ্রেস বিজেপির শত্রু। কিন্তু ফেডারাল ফ্রন্টের ডাকের পর তারা কৌশলগত ভাবে মমতা বিরোধিতা কমাতে বাধ্য হবে। পাঁচ, দেশজোড়া বিজেপি বিরোধী ফেডারাল ফ্রন্টের ডাক প্রথমে দিয়েছিলেন আমাদের দিদি। তিনিই প্রথম এই আওয়াজ নিয়ে বিভিন্ন রাজ্যে গিয়ে নানা নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এসব কিছুই তাকে করে তুলেছে ফেডারাল ফ্রন্টের মুখ।
বিরোধীদের ঐক্য ভাঙার জন্য বিজেপি একটা ঘৃণ্য কৌশল নিয়েছে। তারা প্রশ্ন তুলেছে নেতৃত্ব নিয়ে নিজেদের লড়াইয়ের কারণেই ফেডারাল ফ্রন্ট ভাঙবে। কিন্তু নিজের রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তা দিয়েই এই কূট চালটাকে এড়িয়ে গেছেন দিদি। তিনি বলেছেন, এই মুহূর্তে লড়াইয়ের নেতা কে সে প্রশ্নটা খুব একটা বড় নয়। বিজেপিকে পরাস্ত করাটাই এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। নেতা উঠে আসবে লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। ন্যাশনাল কনফারেন্সের ওমর আবদুল্লার মুখে শুক্রবার কলকাতায় এই কথাটারই প্রতিধ্বনি শুনলাম।
৩০ বছরের বেশি সাংবাদিক জীবনে বহু রাজনৈতিক নেতা, নেত্রী আমি দেখেছি। আমার মনে হয় দেশের শাসক ও বিরোধী রাজনৈতিক দল কোনটাতেই দিদির মত অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, বিচক্ষণ, লড়াকু, সবাইকে নিয়ে চলতে সক্ষম, সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার মত কোন রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব নেই। শাসক ও বিরোধী দুটি ভূমিকাতেই তিনি সফল। কেন্দ্র ও রাজ্য দুটি জায়গাতেই তিনি কাজ করেছেন। বিরোধী দলের অন্যান্য নেতাদের তুলনায় তার গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। শাসকদল তাকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায় একারণে তার ওপর শারীরিক আক্রমণ সবচাইতে বেশি হয়েছে। স্বাভাবিক কারণে বিজেপি বিরোধী রাজনীতির প্রধান মুখ হিসেবে তিনিই উঠে আসছেন। এও এক রাজনৈতিক বাস্তবতা।
( মতামত ব্যক্তিগত )