বিধানসভায় পরিবহন মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী ঘোষণা করলেন কলকাতার রাস্তায় ডাবল ডেকার বাস আবার ফিরছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলকাতাকে লন্ডনের মত বিশ্বমানের করে তোলার উদ্যোগে নিশ্চই এটা এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমি ব্যক্তিগত ভাবে এই প্রস্তাবে খুব খুশি।
আমরা সবাই এই দোতলা লাল বাস দেখে বড় হয়েছি, অনেকে ছোট বেলায় চড়েওছি। কিন্তু সময়ের সাথে কোনো অজানা কারণে এই দৈত্যাকার বাসগুলো কলকাতার রাস্তা থেকে হারিয়ে যায়, থেকে যায় শুধু নস্টালজিয়ার আড়ালে। ২০১১ সালের সেই ঐতিহাসিক পালা বদলের পর যখন নতুন সরকার ক্ষমতায় আসে, বৃদ্ধ কলকাতায় যেন এক নতুন যৌবনের ছোঁয়া লাগে, চারিদিকে উৎসবের আমেজ, মৃতপ্রায় শহর যেন হঠাৎ জেগে উঠেছে। সব পুরোনো জরাজীর্ণ স্মৃতি আজ ধুয়ে মুছে নতুন উদ্যমে শুরু করতে হবে, অনেক কিছু করার আছে, অনেকটা পথ হাঁটার আছে, আমাদের প্রিয় তিলোত্তমা কলকাতা, আমাদের সাধের বাংলাকে আবার বিশ্বে শ্রেষ্ঠর আসনে বসাতে হবে। আর এই আনন্দের মুহূর্তে, এই পরিবর্তনের উদ্যম ইচ্ছায় আমিও গা ভাসিয়ে দিয়েছিলাম।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার ইন্টারভিউতে বললেন যদি কারুর কাছে কোনো ভালো প্রস্তাব থাকে সরকার নিশ্চই বিবেচনা করে দেখবে। ছোটবেলা থেকেই আমার মাথায় কলকাতা নিয়ে, বাংলা নিয়ে অসংখ্য চিন্তাভাবনা ঘোরাঘুরি করে, ভাবলাম বলেই ফেলি। ফেসবুকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখনও ওনার পেজ খোলেননি, ওনার নামে একটা গ্রুপ খোলা হয়েছিল, শুনেছিলাম এটা তৃণমূলেরই গ্রুপ, তৃণমূলের শীর্ষ নেতারা এটার ওপর নজর রাখেন। গিয়ে তিনটে প্রস্তাব লিখে দিলাম, প্রথমটা কলকাতায় ডিসনিল্যান্ড খোলার জন্য, দ্বিতীয়টা ছিল কলকাতার ট্রাম আমাদের সম্পদ, ওটা বন্ধ না করে, কি ভাবে আবার লাভজনক করা যায় সেই নিয়ে ও তৃতীয়টা ছিল ডাবল ডেকার বাস কলকাতার রাস্তায় আবার চালু করার জন্য।
ডিসনিল্যান্ডের প্রস্তাব দেওয়ার কারণ আমার মনে হয়েছিল যদি পশ্চিমবঙ্গকে দ্রুত অগ্রগতির পথ নিতে হয়ে তাহলে তার সহজ উপায়ে হলো পর্যটন। আমরা যদি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর দিকে তাকাই তাহলে দেখবো শুধু পর্যটনের জোরেই তারা তাদের অর্থনীতি বিশ্বের প্রথম সারিতে তুলে নিয়ে এসেছে। পর্যটন একটা বিষয় যেটা আমরা কোনোদিনই বেশি গুরুত্ব দিইনি যেটা আমার মনে হয়েছিল পাল্টানো উচিত। তাই যদি আমরা এমন কিছু কলকাতায় আনতে পারি যা পৃথিবী বিখ্যাত, জগতের কাছে একটা দারুন বার্তা পৌঁছাবে। ডিসনিল্যান্ড একটা আইকনিক প্রতিষ্ঠান যাকে এক বাক্যে পৃথিবী চেনে, এমন কিছু কলকাতায় তৈরি হলে শুধু পুরো ভারত না, ভারতের আসে পাশের দেশ থেকেও অসংখ্য লোক যাদের সামর্থ নেই ইউরোপ, আমেরিকা, দক্ষিণ কোরিয়া বা হংকং যাওয়ার তারা কলকাতায় আসবে। কলকাতার অর্থনীতিকে এটা বিশাল সাহায্য করবে। কলকাতায় কয়েক হাজার কোটি টাকার বিদেশি বিনিয়োগ হবে, অসংখ্য লোক চাকরি পাবে, সরকার বিশাল অঙ্কের রাজস্ব পাবে ও সবচেয়ে বড় কথা ভাবমূর্তির পরিবর্তন ঘটবে, যেটা ২০১১ সালে অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রস্তাবটা ছিল ট্রাম ও ডাবল ডেকার বাস নিয়ে। আমি পাবলিক ট্রান্সপোর্টের পক্ষে। আমি মনে করি ভবিষৎ যে দিকে যাচ্ছে পৃথিবীর প্রত্যেক সরকারকে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ঢেলে সাজাতে হবে, মাস পাবলিক ট্রান্সপোর্টই আমাদের ভবিষ্যৎ। অনেকেরই মুখে শুনি ট্রাম লাভজনক না তাই বন্ধ করে দেওয়া হোক। আমি এর ঘোর বিরোধী। যে কোনো জিনিষকেই যদি আমরা ফেলে রাখি, সময়ের সাথে তার প্রযুক্তিগত মানোন্নয়ন না করি তার অবনতি ঘটবে। ট্রাম চিরকাল অবহেলিত। যদি আমরা ট্রামকে ঠিক মত ব্যবহার করতে পারি ট্রাম কলকাতার সবচেয়ে বড় সম্পদে রূপান্তরিত হতে পারে, কলকাতার ভাবমূর্তিতে আমূল পরিবর্তন ঘটাতে পারে। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ আমরা পাবো অসংখ্য ইউরোপীয় ও আমেরিকান শহরের রাস্তায়।
আমার শেষ প্রস্তাবটা ছিল কলকাতার রাস্তায় ডাবল ডেকার বাস ফেরানো নিয়ে। কলকাতার মতো শহর যেখানে রোড স্পেস এতো কম সেখানে ডাবল ডেকার বাস পরিবহন ব্যবস্থাকে অনেক সাহায্য করবে। একটা বাসে দুটো বাসের যাত্রী যেতে পারবে এটা যে শুধু রাস্তা থেকে গাড়ির সংখ্যা এবং ট্রাফিক জ্যাম কমাবে তাই নয়, তেল কম পুড়বে, সরকারের খরচ বাঁচবে ও পরিবেশ দূষণ কম হবে। আমরা তো ৮০-৯০ লক্ষ টাকা খরচা করে ভলভো-মার্সিডিজ বেনজ বাস কিনি, আমরা অনায়াসে উন্নতমানের ডাবল ডেকার বাসের পরিষেবা কলকাতায় চালু করতে পারবো। লন্ডন, প্যারিস, বার্লিন, বেজিংয়ের মতো শহরে এই বাস পরিবহন ব্যবস্থার জন্য অপরিহার্য। লন্ডনে কেউ গেলে তার প্রথম চোখে পড়ে লাল ডাবল ডেকার বাস। ওখানে হুড খোলা দোতলা বাস যার নাম “হপ ইন হপ অফ”-এ করে পর্যটকরা শহর ভ্রমণে বেরোয়। আমরা কেন এমনটা কলকাতায় চালু করতে পারিনা।
আমার এই ডাবল ডেকার বাসের প্রস্তাবটা টাইমস অফ ইন্ডিয়ার সাংবাদিক কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের নজর কাড়ে এবং উনি তার ওপর একটা খবর তৈরি করে। এক মাস পর ১৬ই জুলাই, ২০১১ সালে টাইমস সিটিতে ছাপেন। তিনি ডাবল ডেকার বাস নিয়ে তৎকালীন পর্যটন মন্ত্রী রাচপাল সিংকে প্রশ্নও করেন। রাজপাল সিং উত্তরে বলেন নিশ্চই লন্ডনের মতো কলকাতাতেও এরম করা যেতে পারে। তার উক্তি ” This can be replicated in Kolkata too. Imagine seeing this grand city from the top of a bus” TOI আর্টিকালে ছাপে।
তারপর মিডিয়া থেকে যা জানতে পারি সরকার বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছে ভালো মানের ডাবল ডেকার বাস কেনার কিন্তু নানান কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। অবশেষে ২০১৬ সালে একটা পুরোনো ডাবল ডেকার বাস নতুন ভাবে সাজিয়ে সরকার রাস্তায় নামায় যেটা ১০ কিমি রাস্তা ইকো পার্কের ৪ নম্বর গেট থেকে ইকোআরবান ভিলেজ অব্দি যায়।
যখন কাল খবরটা শুনলাম যে আমার প্রথম প্রস্তাব মতো লন্ডনের রেড বাস ধাঁচে ডাবল ডেকার বাস কলকাতার রাস্তায় নামতে চলেছে সত্যি উচ্ছসিত হয়েছিলাম। এই তিলোত্তমার অগ্রগতিতে আমি আমার সামান্য অবদান দিতে পারলাম এটা আমার কাছে বিশাল প্রাপ্তি। কলকাতার জন্য আমার অনেক স্বপ্ন আছে। কলকাতার নাম জগতে উজ্জ্বল হয়ে উঠুক এই স্বপ্ন আমরা সবাই দেখি। আজ সেই পথে এক পা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পশ্চিমবঙ্গের পরিবহন মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ। বিশ্বাস রাখি আগামী দিনে আপনারা এরম আরো অনেক সিদ্ধান্ত নেবেন জনগণের স্বার্থে, রাজ্যের স্বার্থে।
( মতামত ব্যক্তিগত )