বলা হয়, শিক্ষা, সংস্কৃতির মতো বাঙালির রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাজনীতি। কিন্তু রাজনীতি বড় নির্মম যে। নিজের জয় আর বিরোধীর পরাজয় ছাড়া আর কিচ্ছু বোঝেনা যুদ্ধক্ষেত্রে। বিরোধীকে হেও করতে নিচে নামার কোন শেষ রাখে না। এটাই তো পলিটিক্স কালী দা। সব খেলার সেরা বাঙালির পলিউটেড ট্রিক্স। যাতে কালচার ফালচারের একটু টাচআপ দিতে হয় ‘সান্সকিতিক সোন্ধায়’।
এই বাংলায় এক অভিনেতা ছিলেন তুলসী চক্রবর্তী বলে। সত্যজিৎ রায় বলতেন ‘ভারতের মরিস শিভ্যালিয়র’। হলিউডে জন্মালে নাকি ড্রইংরুমে গোটা তিনেক অস্কার সাজানো থাকতো। সেই তুলসী বাবু হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে যে দিন মারা যান, সৎকারের খরচ জোগাতে ও কালঘাম ছুটে গেছিল স্ত্রীর। চূরান্ত দারিদ্রের মধ্যে দিন কাটতো ভারতের মরিস শিভ্যালিয়র।
সত্যজিৎ এর আরেক অভিনেতা ছিলেন তপেন চট্টোপাধ্যায়৷ আমরা অবশ্য গুপী গাইন হিসেবেই একে চিনতাম। শেষ বয়সে গড়িয়ার অটোর লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতো ঘেমে নেয়ে। আধময়লা জামা, রুগ্ন, মধ্যবিত্ত৷ কে বলবে রাজার জমাই এই লোকটাই বাঘার সাথে তালি দিয়ে যেখানে খুশী যেতে পারতো।
ফেলুদা ও তো শেষ বয়সে এসে বাতের তেল, চিটফান্ডের ফাংশন, বি গ্রেডের ছবিতে মনোযোগ দিয়েছেন। সেই চারমিনার ও নেই, সেই টাকার দাম ও নেই। অগত্যা যা হাতে আসে তাই নেওয়া। লেজেন্ডস মানে স্টার হল কই? তাই চালিয়ে যাওয়া টু পাইস পেতে। বুঝলি তপসে?
আচ্ছা দুর্ধর্ষ দুশমন মন্দার বোসকে মনে আছে? যে আবার কাশতে কাশতে জাগলিং ও নাইফ থ্রোইং এর ভেলকি দেখাতো? কামু মুখার্জী। এতো কিছু করে ও কাজ পেতো না। মারণ রোগ বাসা বেঁধেছিল। খুব বিশেষ সাহায্য ও পায়নি। টাকা ও না। অনাদরে অবহেলায় গ্লোব ট্রটারের মৃত্যু হয়েছিল।
এভাবে একাধিক কিংবদন্তি বিস্মৃতির কবরে গেছে এ ভূমিতে। সখ করে আমরা যাকে সাংস্কৃতিক রাজধানী বলি। দারিদ্র্য, অবহেলা, অনাদর, কাজ না পাওয়া, স্বীকৃতি না দেওয়ার এক বিশাল দলিল রাখা থাকবে৷
এই ছবিটা এবছর ২১শে জুলাইয়ের পর থেকে ভাইরাল হয়ে গেছে। ফোনে ফোনে ঘুরছে। মস্করা চলছে। এই কিম্ভুত পোষাক, চড়া মেকআপ নিয়ে নকি দুই কিংবদন্তি শিল্পী ২১জুলাই শহীদ দিবসের অনুষ্ঠানে যোগদান করেছিলেন৷ পাব্লিক ও “হেব্বি খাচ্ছে” এই ফেক নিউজ। কিছু রাজনীতির বেসাতি করা লোক খাওয়াচ্ছে। অদ্ভুত ব্যাপার মানুষ একবার ও নিজের তাগিদে খোঁজ না নিলো না এই ছবির সত্যতা সম্বন্ধে। কাউকে প্রতিবাদ ও করতে দেখলাম না।
এই ছবিতে যে দুজন শিল্পীকে দেখা যাচ্ছে, তাদের মধ্যে একজন সত্যজিৎ রায়, মৃনাল সেন, ঋত্বিক ঘটকের কালজয়ী ছবির নায়িকা। জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত মাধবী মুখার্জি। অপরজন পদ্মশ্রী ভূষিত অভিনেত্রী। উত্তম কুমারের বহু ছবির নায়িকা, মঞ্চ অভিনেতা। সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়।
এদের সিভিতে বা ঝুলিতে যে মাপের কাজ আছে বা যাদের সাথে কাজের অভিজ্ঞতা আছে, হলিউড ছাড়ুন, বলিউড হলে ও সেসব ভাঙিয়ে শেষ জীবন কাটিয়ে দিতেন৷ মাঝেমধ্যে কিছু নস্টালজিয়া উস্কানো সাক্ষাৎকার। কিন্তু এটা বাংলা। এটা সাংস্কৃতিক রাজধানী। এখানে মাধবী বা সাবিত্রীর মাপের অভিনেতাদের ও বৃদ্ধ বয়সে এই ভাঁড়ামি করতে হয়। চড়া মেকআপ, হাস্যকর পোষাকে ক্যামেরার সামনে আসতে হয় টাকার জন্য৷
না ছবিটা ২০১৮ সালের ২১ জুলাই এর না। ছবিটা এক বছর আগের কোন এক শুটিংয়ের। ছোট পর্দার কাজ। ভায়াকমের কালার্স বাংলাতে সম্প্রচারিত হয়েছিল৷ প্রগতিশীল বাঙালির থেকে এই নিকৃষ্ট রসবোধ আসা করা যায় কি? না আমরা ক্রমশ গোটাটাই মধ্যমেধাবী এখন? যাদের ভালোবাসা রোদ্দুর রায়ের গান, হিরো আলমের অভিনয় আর ভাগাড় নিয়ে সান্ধ্য ডিবেট৷
আমরা কেউ অনুতাপ করছি না এই দুই অভিনেতার জন্য যারা আজ ভাঁড় সেজেছে টাকার জন্য। যাদের একসময় সত্যজিৎ বা উত্তমের সাথে কাজ করতে দেখা যেত। বাঙালির রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাজনীতি। তাই এখানেও অনুতাপের বদলে রাজনীতি পরিবেশন করা হলো। ছড়িয়ে দেওয়া হলো এক বছর আগের এক ছবি। কারণ বিরুদ্ধতা বজায় রাখতে হবে। বিক্ষুব্ধ সময়ে শিল্প ফিল্প কালচার ফালচার নিয়ে কে ভাবে? ওদের অপমান করলে কি এলো গেলো? দেশ ও দশের সামনে একটা চারুলতা, একটা গলি থেকে রাজপথ, একটা সূবর্ণরেখা, একটা নিশীপদ্ম বা মরুতীর্থ হিংলাজের কিই বা অবদান আছে?
বাঙালি নিজেকে প্রগতিশীল বলে। কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথ, সত্যজিৎ, উত্তম আওড়ায়। কিন্তু তাদের সাথে জড়িয়ে থাকা মানুষদের যদি এই অসম্মান করা হয়, সুকুমার রায়ের দেশের লোকের রসবোধ যদি এই পর্যায় গিয়ে ঠেকে, তবে বাঙালির এপিটাফ লেখার সময় এলো বলে।
( মতামত ব্যক্তিগত )