বিশ্বকাপ এসে চলে গেল। রাশিয়ায় শেষ হয়ে গেল ফুটবল মহাযজ্ঞ। বিশ্বকাপ মঞ্চ থেকে একটি দল শিরোপা নিয়ে চলে গেল নিজ দেশে। শিরোপাজয়ী দলের খেলোয়াড়রা নিশ্চিতভাবেই অন্য দলগুলোর চেয়ে পারফর্মেন্সে এগিয়ে ছিলেন বলেই সেটা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এছাড়াও কয়েকজন তারকা পুরো বিশ্বকাপেই নজর কেড়েছেন স্বীয় নৈপুণ্যে উদ্ভাসিত থেকে। বিশেষ করে তৃতীয় স্থান দখল করা বেলজিয়ামের ২৭ বছর বয়সী ফরোয়ার্ড এডেন হ্যাজার্ড সবারই মনে জায়গা করে নিয়েছেন। এছাড়াও সবার হৃদয় রাজ্যে স্থান করে নিয়েছেন ক্রোয়েশিয়ার ৩২ বছর বয়সী মিডফিল্ডার লুকা মডরিচ ও ফ্রান্সের ২৭ বছর বয়সী তারকা ফরোয়ার্ড এ্যান্টোনি গ্রিজম্যান। তবে এদের ছাপিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করেছেন টিনেজ ফরাসী ফরোয়ার্ড কিলিয়ান এমবাপে। এবার রাশিয়া বিশ্বকাপে ১৯ বছর বয়সী এ তারকা তাক লাগিয়েছেন বেশ কিছু দুর্দান্ত নৈপুণ্য দিয়ে।
কিলিয়ান এমবাপে (ফ্রান্স)
সেমিফাইনালে কি ক্লান্ত ছিলেন এমবাপে? দুয়েকটি দুর্দান্ত পাস দিয়ে অবশ্য সবার চোখ কপালে তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু গতিময় এমবাপেকে দেখা যায়নি সে ম্যাচে। এছাড়া এবার বিশ্বকাপের সবচেয়ে আলোচিত মুখ এ ১৯ বছর বয়সী তরুণ। ফরাসী আক্রমণভাগের অন্যতম তুখোড় খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিপক্ষের জন্য ত্রাস হয়ে উঠেছিলেন শুরু থেকেই। বিশেষ করে দ্বিতীয় রাউন্ডে শক্তিশালী ও হট ফেবারিট আর্জেন্টিনার বিপক্ষে তার জোড়া গোল করার বিষয়টি ইতিহাস খুঁড়ে বের করেছে। ২০ বছরের নিচে নকআউট পর্বে শুধু ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি পেলেই জোড়া গোল করেছিলেন ১৯৫৮ সালে (১৭ বছর বয়সে)। এমবাপে সেটি ছুঁয়ে ফেলেন। এর আগেও আলোচনায় ছিলেন তিনি তীব্র গতি, এনার্জি ও কৌশলের জন্য। এবার বিশ্বকাপে ৩ গোল করেছেন তিনি। তবে এরচেয়ে বেশি ভুগিয়েছেন সব প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগকে। আর এভাবেই এমবাপে নিজেকে পরিচিত করেছেন তিনি।
ইডেন হ্যাজার্ড (বেলজিয়াম)
বেলজিয়ামের এবারের দলটিকে গত বিশ্বকাপ থেকেই বলা হচ্ছিল সোনালি প্রজন্ম। কারণ একঝাঁক তরুণ খেলোয়াড়ে পরিপূর্ণ ছিল দলটি যারা এই বিশ্বকাপে অনেকটাই হয়ে উঠেছিলেন অভিজ্ঞ। রোমেলু লুকাকু, কেভিন ডি ব্রুইন ও মারুয়ান ফেলাইনিরা ছিলেন লাইম লাইটে। তবে এদের ছাড়িয়ে বেলজিকদের সেরা তারকা এডেন হ্যাজার্ড। এবারের বিশ্বকাপে দুর্দান্ত নৈপুণ্য দেখিয়েছেন এ ২৭ বছর বয়সী ফরোয়ার্ড। তিনি সর্বাধিক চারটি ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন এবার। আর এখান থেকেই বোঝা যায় তিনি বেলজিকদের জন্য কত বড় অবদান রেখেছেন। ৩ গোল করেছেন হ্যাজার্ড এবং গোল করিয়েছেন দুটি। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজের দক্ষতাটা ঠিকই দেখিয়েছেন। ফরাসীদের বিপক্ষে সেমিফাইনালে হেরে গেলেও চৌকস নৈপুণ্য দেখিয়েছেন তিনি। আবার তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন একটি গোল করার পাশাপাশি পুরো সময়টাতে প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ডের রক্ষণভাগকে ভুগিয়ে। এ্যান্টনি গ্রিজম্যান (ফ্রান্স) ॥ ফ্রান্সকে ১২ বছর পর আবার ফাইনালে তোলার অন্যতম নায়ক গ্রিজম্যান। গ্রুপপর্বের প্রথম ম্যাচেই গোল করেছিলেন তিনি। এরপর নকআউট পর্বে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে জয়ের নায়ক। গোল করেছেন আবার করিয়েছেন। উরুগুয়ের বিপক্ষেও কোয়ার্টার ফাইনালে দুর্দান্ত খেলেছেন তিনি। তিনটি নকআউট ম্যাচের দুইটিতেই গোল করার কারণে সেরা খেলোয়াড় হওয়ার দৌড়ে বেশ ভালভাবেই এগিয়ে ছিলেন গ্রিজম্যান। তারচেয়েও বড় কথা, অভিজ্ঞতার অভাবে খেই হারিয়ে ফেলা ফরাসী আক্রমণভাগকে এক সুতোয় গেঁথে রেখেছেন তিনি। সবমিলিয়ে ফাইনালের আগ পর্যন্ত ৩ গোল ও ১টি এ্যাসিস্ট করেছেন তিনি। ফরাসীদের আক্রমণভাগে এমবাপের সঙ্গে এই ২৭ বছর বয়সী তারকা ফরোয়ার্ডের জুটি নিশ্চিতভাবেই প্রতিপক্ষ শিবিরের জন্য ছিল অন্যতম মাথাব্যথার কারণ। আর নিজেকে মেলে ধরে ঠিকই ফরাসীদের আস্থা ও নির্ভরতার যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়েছেন।
লুকা মডরিচ (ক্রোয়েশিয়া)
পারফর্মেন্স বিবেচনায় ক্রোয়েট মিডফিল্ডার মডরিচকেই সবাই এগিয়ে রেখেছেন সবদিক থেকে। দেশের ফুটবল ইতিহাসে প্রথমবার ক্রোয়েশিয়াকে ফাইনালে নিয়ে যাওয়ার নায়ক ৩২ বছর বয়সী ছিপছিপে শারীরিক গঠনের অধিকারী মডরিচ। অধিনায়ক হিসেবে মাঠে তার যোগ্য নেতৃত্বের পথ ধরে প্রথমবার ফাইনালে বলকান দেশটি। তিনি গোল করার পাশাপাশি সতীর্থদের দুর্দান্ত সব পাসে বল বানিয়ে দিয়েছেন গোল করাতে। মরডিচ ফাইনালের আগেই তিনটি ম্যাচসেরার পুরস্কার পেয়েছেন। দুটি গোল করেছেন আর একটি করিয়েছেন। ৪২৪ মিনিট মাঠে থেকে এই মিডফিল্ডার ২৯৪টি পাস দিয়েছেন। পাস দেয়ায় সাফল্যের হার ৮৬ শতাংশ। আর এতেই বোঝা যায় মাঝমাঠে তার অবদান কতখানি ভূমিকা রেখেছে ক্রোয়েটদের সেরা সাফল্য অর্জনের ক্ষেত্রে। তবে একটিই তার সেরা হওয়ার পেছনে নেগেটিভ পয়েন্ট হয়ে ছিল। সেটি হচ্ছে- ডেনমার্কের বিপক্ষে অতিরিক্ত সময়ে গড়ানো খেলায় পেনাল্টি মিস করেছিলেন তিনি। অবশ্য সেটি শুধরে নিয়েছেন পরপর দুই ম্যাচে পেনাল্টি শূটআউটে লক্ষ্যভেদ করে। তাছাড়া সার্বিক নৈপুণ্য বিবেচনা করলে তিনিই ক্রোয়েশিয়ার অন্যতম সেরা এবং চলতি বিশ্বকাপেরও সেরা একজন পারফর্মার এতে কোন সন্দেহ নেই।
এছাড়াও ব্রুইন, লুকাকু আর ৬ গোল করা ইংল্যান্ডের কেনও এবার বিশ্বকাপে নজর কেড়েছেন। উরুগুয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে বিদায় নিলেও তাদের দুই তারকা এডিনসন কাভানি ও সুয়ারেজ নজর কেড়েছেন নিজেদের উদ্ভাসিত নৈপুণ্য দেখিয়ে। বেলজিয়ামের লুকাকু টানা দুই ম্যাচে জোড়া গোল করে কিংবদন্তি আর্জেন্টাইন তারকা দিয়েগো ম্যারাডোনার কীর্তি ছুঁয়েছেন। এছাড়া ব্রাজিলের নেইমার, ফিলিপ কুটিনহো, আর্জেন্টিনার এ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া, কলম্বিয়ার কুয়াড্রাডো, নাইজিরিয়ার আহমেদ মুসারা নজর কেড়েছেন।