বহুদিন আগে একটা গান শুনেছিলাম ‘টিয়া টিয়া টিয়া অজ পাড়াগাঁয় থাকে’। অজ পাড়াগাঁয় নয়, শহরেও নয় – আসলে টিয়া থাকে আমাদের মনে। নিজেদের আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে এই টিয়াকে আমরা নির্মাণ করি, আবার কাজ ফুরোলেই উড়িয়ে দিই। বিশ্বকাপের প্রাক্কালে সোশ্যাল মিডিয়াতে টিয়ার ভবিষ্যৎবাণী মিলে যাওয়া নিয়ে হৈচৈ দেখে কথাগুলো আবার মনে পড়লো। অজানাকে জানার উৎকণ্ঠা আছে বলেই আমরা জ্যোতিষীর কাছে ছুটি। কিন্তু বিশ্বকাপের উৎকণ্ঠা দুপেয়ে জ্যোতিষীও সামাল দিতে পারেনা। দুনিয়াজোড়া এই ফুটবল মহাযজ্ঞের সময় এখন পাঁচ মহাদেশ জুড়েই মানুষ ছুটছে বিড়াল, ম্যাকাও, সিল, কচ্ছপ, অক্টোপাস, বাঘ, ভালুক আর শেষমেশ টিয়ার কাছে। কোন ম্যাচে কে জিতবে, কে হারবে আর কেই বা হবে চ্যাম্পিয়ন এসব জানতে মানুষের জলচর, স্থলচর, উভচর, খেচর কারো কাছে যেতেই আপত্তি নেই।
তবে এবার সবাইকে টেক্কা দিয়েছে আমাদের বাংলার ঘরোয়া সবুজ টিয়া। বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ফাইনাল অবধি তার সমস্ত ভবিষ্যৎবাণী যাকে বলে অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছে। গোড়ার দিকে অন্যান্য প্রাণীদের তুলনায় ততটা কুলীন নয় টিয়াকে বিপ্লবী বাঙালি মোটেই তেমন পাত্তা দেয়নি। এর অবশ্য কারণও আছে। গণৎকার টিয়া বলতে আমাদের মনে পড়ে ধূলি ধূসরিত ফুটপাথে ছোট্ট কাঠের খাঁচায় বন্দী গণৎকার টিয়ার কথা। হাওড়া ব্রিজ, কার্জন পার্ক এবং জাদুঘরের সামনে অনিবার্য ছিল গণৎকার ও তার পোষা টিয়ার উপস্থিতি। মানুষ এলে গণৎকারের নির্দেশে টিয়া খামের বান্ডিল থেকে একটা খাম তুলে তার প্রশ্নকর্তার জীবন ও যৌবনের যাবতীয় সমস্যা ও সম্ভাবনা জানিয়ে দিত। সোশ্যাল মিডিয়ার টিয়া এবারের বিশ্বকাপের সম্ভাবনাময় অনেক দাবীদারকে অস্তে পাঠিয়েছে আবার অনেককে তুলে এনেছে পাদপ্রদীপের আলোয়। এমন চমৎকার পারফর্মেন্স দেখে সরকার বাড়ির নাক উঁচু কাগজও তাকে নিয়ে দুরন্ত অ্যাঙ্কর স্টোরি করে ফেলেছে। পিছিয়ে পড়তে না চাওয়া বাঙালি তা গোগ্রাসে গিলেছে।
টিয়ার সঙ্গে আমার আলাপ তা প্রায় আট বছর। তখন আমি আনন্দবাজারে। কলকাতা পাতায় নিয়মিত শহরের বহমান জীবনের একেকটা খন্ডচিত্র তুলে ধরাটাই ছিল আমার মূল অ্যাসাইনমেন্ট। খুব সম্ভবত ২০১০ হবে, বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে শহরের ফুটবল জ্বরকে কেন্দ্র করে একটা অন্যরকম ছবি তোলার কথা ভাবছি। হঠাৎ মনে পড়ল টিয়ার কথা। দু জায়গায় জ্যোতিষীর কাছে টিয়াকে দিয়ে মজা করে দুবার খাম তুলিয়েছিলাম আমিও। দুবারই একই ঘটনা ঘটেছিল। টিয়ার তোলা খামে লেখা ছিল অপঘাতে আমার মৃত্যু হবে। প্রতিকার হিসেবে তিনি বিধান দিয়েছিলেন ১০০ টাকা দিয়ে একটা মাদুলি নিলে বিপদ কাটবে। যাই হোক কার্জন পার্কে বসা এক গণৎকারের সঙ্গে ব্যবস্থা করে আমি তার টিয়াটাকে দিয়ে একটা খাম তোলালাম যাতে লেখা আছে স্পেন বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হবে। খামের কাছে কয়েকটা ছোলা রাখতেই টিয়া অনায়াসে এক ঠোকরে স্পেনকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন করে দিল। বিশ্বকাপের বাজারে সে ছবি যাকে বলে ব্যাপক হিট।
আমি নিজে এসব বুজরুকি মানিনা। সেটা ছিল স্রেফ মজা করেই একটা ছবি তোলার পরিকল্পনা। আমি রক্তমাংসের মানুষকে জানি, বুঝি আরও বুঝতে চাই। আট বছর টিয়ার সঙ্গে ঘর করছি আমি। টিয়া আসলে মানুষের ইচ্ছাপূরণের গল্প। আমাদের না পূরণ হওয়া ইচ্ছা, না সত্যি হওয়া স্বপ্ন যেন টিয়ার ডানায় ভর দিয়ে জীবন্ত হয়ে উঠতে চায়। আপনার, আমার মতই তার ক্ষুধা, তৃষ্ণা, মান, অভিমান সবকিছুই আছে। আপনার, আমার মতই তার কান্না পায় আবার ইচ্ছা পূরণ হওয়ার পর সে হাসে। এই ব্যাপারটা মাথায় রেখেই এবারের বিশ্বকাপে ছবি নয়, সোশ্যাল মিডিয়াতে টিয়াকে আমি নবরূপে ফিরিয়ে এনেছি। বিশ্বকাপের একেবারে গোড়ার থেকেই মানুষের আগ্রহ আছে এমন নানা ম্যাচ সম্পর্কে টিয়ার ভবিষ্যৎ বাণী হোয়াটসঅ্যাপে নিয়মিত পোস্ট করতে থাকি। ঘটনাচক্রে বেশিরভাগই মিলতে থাকে। তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এটা স্বাভাবিক, কারণ আমরা প্রতিটি মানুষই মনে মনে কোন না কোন প্রতিপক্ষ তৈরি করে নিই। তাদের পতনে খুশি হই আবার নিজের কথা না মিললে দুঃখ পাই।
এই কাজে আমার সঙ্গে ছিল আমার ছোট ছেলে পিকু। ও ইস্টবেঙ্গল সাব জুনিয়ারে নিয়মিত খেলত। মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য মায়ের বকাবকিতে খেলা ছেড়েছে। কিন্তু ওর ফুটবলবোধ প্রখর। স্কুল, কলেজে ফুটবল খেলেছি আমিও। ভ্রাতৃসঙ্ঘের চন্দ্রনাথ চ্যাটার্জির ডাক পেয়েও সেখানে পারিবারিক নানা কারণে খেলতে পারিনি। আমি আর পিকু দুজনে মিলে ঠিক করতাম আজ টিয়া কি বলবে। বিভিন্ন ম্যাচে কোন দল কেমন খেলেছে তা আমরা চুলচেরা বিশ্লেষণ করতাম। এই প্রথম আমরা দুজনে এবারের বিশ্বকাপের সব খেলাই দেখেছি। সেটা টিয়ার মুখে ভবিষ্যৎবাণী বসাতে সাহায্য করেছে। আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে পিকুই আমার টিয়া। আজ সকালে আনন্দবাজার পড়ে ও একচোট হেসেছে। এটা এক নির্দোষ প্রমোদ। কাউকে ছোট কিংবা বড় করার কোন উদ্দেশ্য এর পিছনে ছিলনা।
বিশ্বকাপ শেষে টিয়া এখন গেছে ক্রোয়েশিয়াতে। একটা ছোট দেশ নিজেদের চেষ্টা ও নিষ্ঠায় কীভাবে ফুটবলে এতটা এগিয়েছে তা জানতেই ওর সেখানে যাওয়া। ফিরে এসে ও এখানকার ফুটবলপ্রেমীদের সে গল্প বলবে, যা বাংলা তথা ভারতের ফুটবলকে এগোতে সাহায্য করবে। বিশ্ব ফুটবলের আনন্দ যজ্ঞে ভারত চিরকালই সাইড লাইনের ধারে বসে থাকবে বলে একশ্রেণীর ফুটবল পণ্ডিত যে চিরকেলে বাণী বিতরণ করেন আমরা তা মানিনা। আমরা বিশ্বাস করি সঠিক পরিকল্পনার ভুলেই ভারত ফুটবলে পিছিয়ে পড়েছে। এ ত্রুটি চেষ্টা ও আন্তরিকতা থাকলেই কাটিয়ে ওঠা যায়। টিয়ার ভবিষ্যৎবাণী নয়, ছোট দেশগুলোর সাফল্য আমাদের অনুপ্রাণিত করুক।