২৯ জুন, ১৯৫৮। খেলার ৫৫ এবং ৯০ মিনিটে দুটি গোল করেছিলেন ১৭ বছরের এক তরুণ। ৫–২ গোলে সুইডেনকে হারিয়ে প্রথম বারের জন্যে জুলেরিমে ট্রফি জিতেছিল ব্রাজিল। ’৫৮–র বিশ্বকাপ সেই ১৭ বছরের তরুণের বিশ্বকাপ হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে আছে। অনেকেই বলেন যে, মূল দলে সুযোগ পেলেও হাঁটুর ইনজুরি এবং গায়ের রং সেই সতেরোর তরুণকে প্রথম এগারোয় ঢুকতে দিচ্ছিল না। সোবিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে পেলেকে মাঠে নামার সুযোগ দেন কোচ ভিনসেন্ট ফিওলা। সেই ম্যাচে পেলে গোল করতে পারেননি।
ওয়েলসের বিরুদ্ধে একমাত্র জয়সূচক গোলটি করেন পেলে। বিশ্বকাপের ইতিহাসে সব থেকে কমবয়সির করা গোল।
ফ্রান্সের বিরুদ্ধে সেমিফাইনালে হ্যাটট্রিক করেন ১৭ বছরের পেলে— বিশ্বকাপে সর্বকনিষ্ঠর হ্যাটট্রিক।
২৯ জুন, ১৯৫৮। ১৭ বছর ২৪৯ দিন বয়সে ফাইনাল খেলতে নেমে সুইডেনের জালে দু’বার বল জড়িয়ে দেন ভবিষ্যতের ফুটবল সম্রাট, যে রেকর্ড সম্ভবত কোনও দিন হয়তো ভাঙবে না। ’৫৮–র বিশ্বকাপে ৬টি গোল করেছিলেন পেলে।
ঠিক ছ’দশক পরে ২০১৮–র রাশিয়া বিশ্বকাপের ফাইনালে গোল করলেন কিলিয়ান এমবাপে— ক্যামেরুনজাত ফরাসি ফুটবলার। জিতে নিলেন রুপোর বল। পেলেকে না ছুঁতে পারলেও টুর্নামেন্টে ৪ গোল করে নিজের উপস্থিতি জানান দিলেন এই উদীয়মান তারকা।
ক্যামেরুনজাত এমবাপে, গিনিজাত পল পোগবা ক্রোয়েশিয়ার জালে যখনই বল জড়িয়েছেন, গ্যালারিতে উদ্দাম উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়তে দেখা গেছে তরুণ ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁকে। এই উচ্ছ্বাসের বহিঃপ্রকাশের মধ্যে রয়েছে বর্ণবিদ্বেষ–বিরোধী তীব্র ঘৃণা।
১৯৯৮ সালে প্রথমবারের জন্য ফ্রান্স যখন বিশ্বকাপ জেতে ফ্রান্সের উগ্র জাতীয়তাবাদী নেতা জ্যঁা মারি লা পেন তীব্র ঘৃণা ছড়িয়ে বলেছিলেন, এটা আদপে ফরাসি দলই নয়। ক্যারিবিয়ানজাত লিলিয়াম থুরাম, থিয়েরি হেনরি, ক্রিস্টিয়ান কারেম্বু, বার্নার্ড দেওমিদে, ঘানাজাত মার্সেল দেশঁ, সেনেগালজাত প্যাট্রিক ভিয়েরা এবং আলজেরিয়ান জিনেদিন জিদান— এঁরা নাকি ফরাসি রক্তের অপমান, এমনই দাবি ছিল লা পেনের।
আসলে বর্ণবিদ্বেষ খেলার মাঠে নতুন কোনও ঘটনা নয়। কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি আর তির্যক মন্তব্য এ সব কালো চামড়ার ফুটবলারদের সহ্য করা বন্ধ হয়নি এখনও। তিতিবিরক্ত হয়েই ২০১২–র ইউরো সেমিফাইনালে জার্মানির বিরুদ্ধে জোড়া গোল করে পিঠে রং মাখা অভিনব প্রতিবাদ পৃথিবীর সামনে তুলে ধরেছিলেন মারিও বালোতেলি।
বর্ণবিদ্বেষের কালো থাবা যত ধারালো হয় খেলার মাঠে পোগবা, এমবাপে, উমতিতি, লুকাকু, অসলে ইয়ং, রাহিম স্টারলিং, ডেলে এলি, জেরোম বোয়েটাং, ভিনসেন্ট কোম্পানিরা ততই ফুল ফোটান।
এবারের বিশ্বজয়ী ফরাসি দলে ২৩ জন ফুটবলারের মধ্যে ১৭ জনই অভিবাসী। ১২ জন সরাসরি আফ্রিকানজাত। যে কারণে গতকাল সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ কেউ লিখেছেন, বিশ্বকাপ জিতল আফ্রিকা।
কুড়ি বছর আগে ক্যারিবিয়ানজাত লিলিয়াম থুরামের জোড়া গোলে ক্রোয়েসিয়াকে হারিয়ে ফাইনালে গিয়েছিল ফ্রান্স। কুড়ি বছর পরে ক্যামেরুনজাত স্যামুয়েল উমতিতির হেডেই ফ্রান্সের ফাইনালের দরজা খুলে যায়।
লা পেনরা যতই গালমন্দ করুন, ওঁরা ভুলে যান যে, ফ্রান্সের চিরশ্রেষ্ঠ ফুটবলার মিচেল প্লাতিনিও ছিলেন অভিবাসী পরিবারের সন্তান।
১৯ বছর বয়সে মহাতারকা হওয়ার সিঁড়িতে পা রাখা কিলিয়ান এমবাপের বাবা ক্যামেরুনের। মা আলজেরিয়ার। এমবাপেকে নিয়েও আপত্তি রয়েছে উগ্রজাতীয়তাবাদী লে পেন ও তাঁর অনুগামীদের।
২০০৬ সালে খেলার মাঠে বর্ণবিদ্বেষ বাড়তে থাকায় ফুটবল বিশ্বের সর্বোচ্চ নিয়ামক সংস্থা ফিফা ‘Say No to Racism’ প্রচার চালু করে। কতটা লাভ হয়েছে এটা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেছে।
বেলজিয়ামের উপনিবেশ ‘বেলজিয়ান কঙ্গো’জাত রোমেলু লুকাকু এ ব্যাপারে পরিষ্কার বলেছেন, ‘আমি বেলজিয়ামের হয়ে খেলি আর আমার গায়ের রং যেহেতু কালো, তাই খেলার মাঠে আমি বর্ণবিদ্বেষের মুখোমুখি হব না। এ হতেই পারে না।’
পশুপাখির ডাক, কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি কলা ছোড়া ‘নিগার’ বলে গালি দেওয়া এগুলো বন্ধ হয় না। আর এর জবাবে খেলার মাঠেই ফেটে পড়েন এমবাপে, লুকাকুরা।
১৯৫৮ থেকে ২০১৮— ছ’দশক কেটে গেলেও চেহারাটা খুব একটা পাল্টায়নি। গায়ের রং নিয়ে যে ১৭ বছরের ছেলেটাকে গ্যালারি থেকে বিদ্রুপ করা হয়েছিল, তিনি তাঁর ফুটবলজীবনে হাতে নিয়েছেন তিন তিনটি বিশ্বকাপ। গোটা ক্যারিয়ারে হ্যাটট্রিক করেছেন ৯২ বার। আন্তর্জাতিক ও ক্লাব ফুটবল মিলিয়ে গোল করেছেন ১,২৮৩টি। ১৭ বছর ২৩৯ দিনে সব থেকে কম বয়সে বিশ্বকাপে গোল করেছেন। ১৭ বছর ২৪৪ দিনে সব থেকে কম বয়সে বিশ্বকাপে করেছেন হ্যাটট্রিক। আর ১৭ বছর ২৪৯ দিনে সব থেকে কম বয়সে হাতে নিয়েছেন বিশ্বকাপ।
‘নিগার’ বলে গালি খাওয়া সেই ১৭ বছরের পেলেই পরবর্তীতে ভূষিত হয়েছেন ফুটবলের সম্রাট হিসেবে। ১৯৫৮ সালের ছ’দশক পরেও গ্যালারি থেকে এমবাপেদের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া হয় কলা। এই অন্ধকার মনোবৃত্তিকে বুকের যন্ত্রণায় চেপে রেখে রেকর্ড গড়েন এমবাপেরা। আর মানবতা, ভ্রাতৃত্ব, বহুত্ববাদ, বর্ণবিদ্বেষ–বিরোধী লড়াইয়ের অভ্রভেদী বিজয়কেতন উড়িয়ে গ্যালারিতে মাথা তোলে ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর মুষ্টিবদ্ধ হাত। উদ্বেলিত হয় দুনিয়াজোড়া ফুটবলপ্রেমীরা।
মানুষের খেলা ফুটবলের অবিরাম যাত্রার চির সঙ্ঘর্ষে জেগে থাকেন পেলেরাই। ব্যাটন তুলে নেন এমবাপেরা। আর সেই লড়াইয়ে লা পেনদের আঁস্তাকুড়ে ছুঁড়ে ফেলে জয় হয় ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁদের। জয় হয় ফুটবলের। জয় হয় মানবতার।
(সৌজন্য- আজকাল)