আর কিছুদিনের মধ্যে আসামে ৫০ লক্ষ বাঙালি ঘর ছাড়া হতে চলেছে, দেশ ছাড়া হতে চলেছে, নিজের মাতৃভূমি থেকে উৎপাটিত হয়ে উদ্বাস্তু হতে চলেছে, ভারতবর্ষের সংখ্যাগরিষ্ট মিডিয়া চুপ, বুদ্ধিজীবী চুপ, রাজনৈতিক দল চুপ। আমরা ১০ লক্ষ রোহিঙ্গাদের উদ্বাস্তু হওয়া শুনেছি, এবার জগৎ শুনবে ৫০ লক্ষ বাঙালির নাগরিকত্ব হারিয়ে উদ্বাস্তু হওয়ার কাহিনী। এই সমস্যা আর আসামের সমস্যা রইলো না এটা এখন একটা আন্তর্জাতিক সমস্যা।
আসামে চিরকালই অসমিয়াদের মধ্যে এরম একটা ধারণা নানা প্রান্ত থেকে ঢোকানো হয়েছে যে পূর্ব পাকিস্তানি অভিবাসীরা আসামে বিপুল সংখ্যায় অনুপ্রবেশ করে তাদের জায়গা দখল করছে, রাজ্যের সামাজিক পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। এই ধারণা আরো প্রকট আকার নেয় বাংলাদেশ ১৯৭১এ স্বাধীন হওয়ার পর। বাংলাদেশি অভিবাসী বিরোধী নানা সংগ্রাম দানা বাঁধতে শুরু করে। ১৯৭৯-৮০ সালে এই “বহিরাগত হাটাও” আন্দোলনের নেতৃত্বে চলে আসে অল আসাম স্টুডেন্টস উনিয়ন (আসু) যারা এই আন্দোলনকে তীব্রতর করে তোলে। আর তার ফল হলো ১৯৮৫ সালের ১৫ই আগস্ট কেন্দ্রীয় সরকার, আসাম সরকার ও আসুর মধ্যে স্বাক্ষরিত ত্রিপাক্ষিক চুক্তি যা “আসাম একর্ড” নামে পরিচিত।
আসাম সরকার ১৯৮৩ সালে একটি আইন নিয়ে আসে ইললিগাল ইমিগ্রান্টস (ডিটারমিনেশন অফ ট্রাইব্যুনাল) অ্যাক্ট অথবা (আই.এম.ডি.টি অ্যাক্ট, ১৯৮৩) অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের মানবাধিকার রক্ষার স্বার্থে যা সুপ্রিম কোর্ট ২০০৫ সালে খারিজ করে দেয় এবং এন.আর.সির নতুন খসড়া তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করে দেয়। এন.আর.সি আসলে কি ? সহজ ভাষায় আসামের প্রকৃত বাসিন্দাদের নাম নথিভুক্ত আছে এমন একটা তালিকা। এটা প্রথম তৈরি করা হয় ১৯৫১ সালের জনগণনার পর। “আসাম একর্ড” অনুযায়ী যারা বা যাদের পূর্বপুরুষের নাম ১লা জানুয়ারি,১৯৬৬ সালের আগে আসামের ভোটার লিস্টে ছিল তারা প্রকৃত আসামের বাসিন্দা। ১লা জানুয়ারি,১৯৬৬ সাল থেকে ২৪এ মার্চ, ১৯৭১ এর মধ্যে যারা আসামে এসেছে তাদের নাগরিকত্ব ও সকল সুযোগ সুবিধা পেতে ১০ বছর অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু যারা ২৫এ মার্চ, ১৯৭১ এর মধ্যরাতের পর আসামে প্রবেশ করবে তাদের বিদেশি হিসেবে গণ্য করা হবে এবং আসাম থেকে চলে যেতে হবে। জাত, ধর্ম, ভাষার নিরিখে কোনো পক্ষপাত করা হবে না।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ৩১এ ডিসেম্বর, ২০১৭ ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন (এন.আর.সি) তাদের প্রথম ড্রাফ্ট প্রকাশ করে যাতে ৩.২৯ কোটি আবেদনকারীর মধ্যে ২.২ কোটি আসামের বর্তমান বাসিন্দার নাম নেই। নাম নেই অসংখ্য নামি, দামি লোকের যারা বিভিন্ন সময়ে দেশের সেবায় তাদের জীবন পাত করেছেন। নাম নেই আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য তপোধীর ভট্টাচার্যের যার পিতা স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন, নাম নেই এ.আই.ইউ.ডি.এফ এর সাংসদ রাধেশ্যাম বিশ্বাসের। ৩০এ জুন এন.আর.সির ফাইনাল ড্রাফ্ট জমা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আসামে বন্যা পরিস্থিতি হওয়ার কারণে তা এক মাস পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। হাতে আর মাত্র কয়েকটা দিন। তারপর এই ভারত মায়ের সংসার ছেড়ে এই অসংখ্য মানুষকে চলে যেতে হবে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে।
আসাম সরকারের পরিসংখ্যান বলছে প্রায় ৫০ লক্ষ বর্তমান বাসিন্দার নথিপত্রে গড়মিল পাওয়া গেছে। আসামের মানবাধিকার সংগঠন “সিটিজেন রাইটস প্রটেকশান কোয়র্ডিনেশান কমিটি – আসাম” (সি.আর.পি.সি.সি.এ) এর পরিসংখ্যান বলছে প্রায় ৭০ লক্ষ বর্তমান বাসিন্দাদের ধাপে ধাপে এন.আর.সির তালিকা থেকে সরানো হতে পারে। এই ৭০ লক্ষর মধ্যে প্রায় ২৫ লক্ষ বাঙালি হিন্দু ও ৪৫ লক্ষ বাঙালি মুসলমান।
এর ওপর আরো চিন্তার বিষয় বর্তমান বিজেপি শাসিত আসাম সরকারের কাজকর্ম। বিজেপি অবৈধ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের দেশ থেকে তাড়াবে বলে ভোটে জিতে ক্ষমতায় এসছে। তারা ক্ষমতায় আসার পর ফরেন ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা ৩৬ থেকে বাড়িয়ে করেছে ১০০, ডিটেনশান সেন্টার ৩ থেকে বাড়িয়ে করেছে ৬। ফরেন ট্রাইব্যুনাল যাদের আইনত ভারতীয় নাগরিক হিসেবে ইতিমধ্যেই শিকার করে নিয়েছে তাদের সিদ্ধান্তকেও আবার পাল্টানোর জন্য জেলা ও রাজ্যস্তরে রিভিউ কমিটি তৈরি করেছে।
নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে সিটিজেনশিপ বিল (অ্যামেন্ডমেন্টর) খসড়া তৈরি করেছে তাতে বলা হয়েছে সকল ধর্মের অনুপ্রবেশকারিদের ভারতে স্থান দেওয়া হবে মুসলমান ছাড়া। আর এই নিরিখে বেছে বেছে মুসলমান বাঙালিদের নির্যাতন করা হচ্ছে, প্রকৃত নাগরিকদের ওপর অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীর তকমা সাটা হচ্ছে।
তাদের বক্তব্য হলো ১৯৫১ সালে যেখানে আসামে মুসলমান জনসংখ্যা ছিল ২৪.৬৮% সেটা ১৯৯১ সালে বেড়ে হয়েছে ২৮.৪২% আর ২০১১ সালের শেষ জনগণনার ভিত্তিতে তা বেড়ে হয়েছে ৩৪.২২%। এই বিশাল সংখ্যায় মুসলমান জনসংখ্যার বৃদ্ধি নিশ্চই অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের কারণে। কিন্তু আমরা যদি ১৯৭১এ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ১৯৯১ সালে অব্দি আসামে মুসলমান জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার দেখি , তা হলো ৭৭.৪২%। সেই একই সময়ে যদি আমরা ভারতের অন্যান্য রাজ্যে মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দেখি তাহলে এরম অনেক রাজ্যই পাওয়া যাবে যেখানে আসামের থেকে বেশি হারে মুসলমান জনসংখ্যা সেখানে বৃদ্ধি পেয়েছে। যেমন বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরের রাজ্য হরিয়ানা, সেখানে বৃদ্ধির হার ছিল ৮৮.৩৬%। হিমাচল ও মধ্য প্ৰদেশে বৃদ্ধির হার ৮০.৭৬%, ৭৭.৬৪%। এর থেকে একটা জিনিস পরিস্কার আসামের মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি ভারতের অন্যান্য রাজ্যের জনসংখ্যা বৃদ্ধির থেকে খুব আলাদা নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে কম। আবার আমরা যদি সেই সময়ের আসামের অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণী যেমন শিডিউল কাস্ট, শিডিউল ট্রাইব কিংবা খ্রিস্টানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিসংখ্যানের দিকে তাকাই, তাহলে দেখবো তাদের জনসংখ্যা মুসলমানদের থেকেও বেশি বেড়েছে। এটাই প্রমান করছে জনসংখ্যা বৃদ্ধির মূল কারণ অবৈধ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী, এটা ভিত্তিহীন, বরং এর কারণ অর্থ-সামাজিক অনগ্রসরতা।
আসামে ৪৫% বাঙালির বাস। যারা বরাক উপত্যকা ও সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা বহুযুগ ধরে। অসমীয়রা ঠিক যতটা আসামের নিজের, বাঙালিরাও ঠিক ততটাই আসামের নিজের। এই জাতিবিদ্বেষ ছড়িয়ে লক্ষ লক্ষ বাঙালিকে তার মাতৃভূমি থেকে উৎপাটিত করার যে নোংরা খেলায় বিজেপি নেমেছে তাকে সর্বশক্তি দিয়ে আমাদের সকলকে প্রতিহত করতে হবে। আজ যেটা আসামে শুরু হয়েছে, সেটা কিন্তু আসামে থামবেনা। এটা একটা পরীক্ষামূলক প্রক্রিয়া, সাফল্য পেলে অন্য রাজ্যেও প্রয়োগ করা হবে। যদি সত্যি এতগুলো মানুষকে ঘর ছাড়া হতে হয় ভারতবর্ষে কি ভয়ঙ্কর দিন এগিয়ে আসছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। স্বাধীন ভারত এরম দুর্যোগ এর আগে কখনো দেখেনি। এই অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানো প্রত্যেক ভারতীয় নাগরিকের আজ জাতীয় কর্তব্য। আমরা যদি সেটা না করতে পারি আমাদের চোখের সামনে আমরা আমাদের সাধের ভারতকে ধংস হতে দেখবো, এ কখন হতে দেওয়া যায় না, এটা অন্যায়, এটা অনৈতিক, এটা ভয়ঙ্কর।
(মতামত ব্যক্তিগত)