লোকসভা ভোটের আর বেশি দেরী নেই। বছর গড়ালেই বেজে উঠবে ভোটের দামামা। এরই মধ্যে একটি নতুন সমীকরণে দেশ উত্তাল। আগামী ৭-৮ই জুলাই আইন কমিশন বসতে চলেছে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে। এজেণ্ডা – লোকসভা ও বিধানসভা ভোট একসঙ্গে করা যায় কিনা বিচার করা।
২০১৭ সালে জাতীয় আইন দিবস উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে সমকালীন ভোটের ভাবনা প্রথম জনসমক্ষে তুলে ধরেন। তার মতে, একসাথে সংসদ ও বিধানসভার ভোট হলে খরচ বাঁচবে, সাধারণ মানুষের সুবিধে হবে, সরকারি কর্মচারী – যাদের ভোটের ডিউটি করতে হয় – তাদেরও কল্যাণ হবে। এছাড়া, নির্বাচনী বিধির জন্য সরকারি পরিষেবা প্রদানের কাজও ব্যাহত হবে না। যদিও এই যুক্তিগুলো শুনতে ভাল লাগে, সমকালীন ভোটের এই প্রস্তাব ধোঁপে টেঁকে না।
বিশাল খরচের রহস্য
সাধারণভাবে লোকসভা ও বিভিন্ন বিধানসভার ভোট করতে এখন নির্বাচন কমিশনের খরচ হয় প্রত্যেক পাঁচ বছরে প্রায় ৮০০০ কোটি টাকা। যা গড়ে দাঁড়ায় বছরে ১৫০০ কোটি টাকা। যদি ধরে নেওয়া যায় যে ৬০ কোটি মানুষ নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার ভোটবাক্সে জাহির করেন, তাহলে অঙ্কটা কেমন দাঁড়ায়? না, বছরে জনপ্রতি ২৭ টাকা। আমাদের এই বিশাল দেশে গণতন্ত্র বাঁচিয়ে রাখতে বছরে ভোটার পিছু ২৭ টাকা খরচ করাটা কি অপ্রয়োজনীয় খরচ বলা যায়? না, বলা যায় না। তাহলে কেন নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে ব্যয়বহুল প্রতিপন্ন করার একটা চেষ্টা চলছে?
নির্বাচনী বিধি
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন নির্বাচনের জন্য সরকারি কাজ ব্যাহত হয়। ঠিকই তো। জনতার রায়ের জন্য যে কর্মকান্ড তাতে যদি ভুক্তভোগী হয় জনতাই, তাহলে তো অন্য উপায় দরকার। কিন্তু ভেবে দেখুন, গুজরাটে ভোট হলে কি পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী বিধি লাগু হবে? তামিল নাড়ুতে ভোট হলে কি হরিয়ানায় নির্বাচনী বিধি লাগু হয়? হয় না। তাহলে সারা দেশে একসাথে নির্বাচন করলে লাভ কার? নির্বাচনের জন্য যাতে সরকারি পরিষেবা প্রদানের কাজ আটকে না যায় তার জন্য দরকার বিধির সংস্কার, নির্বাচনী প্রক্রিয়ার নয়।
আসলে বিজেপির (এবং অনেকাংশে কংগ্রেসের) নির্বাচনী লড়াইটা খুবই দিল্লি-কেন্দ্রিক। মহারাষ্ট্রের পুরভোট হোক কিংবা গুজরাটের পঞ্চায়েত – দিল্লির বিধানসভা ভোট হোক কিংবা উত্তরপ্রদেশে উপনির্বাচন, বিজেপির তুরুপের তাস একটাই – মোদী (কংগ্রেস যে গান্ধী পরিবার নির্ভর দল সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না)। তাই তো গুজরাটে বিধানসভা নির্বাচনের জন্য সংসদের শীতকালীন অধিবেশন একমাস পিছিয়ে দেওয়া হল। ২০১৪-র পর থেকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা যতটা না নর্থ/সাউথ ব্লকে কাটান, তার চেয়ে বেশি রাজ্যে রাজ্যে প্রচারে। বদল যদি কিছুর দরকার হয়, সেটা এই ব্যবস্থার। সমকালীন নির্বাচনের নামে তাই দিল্লি-কেন্দ্রিক ‘জাতীয়’ দলগুলি নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে চায়।
লোকবল – চাহিদা বাড়বে বই কমবে না
পাঁচবছরে একবার লোকসভা ভোট করতে যত লোকবল দরকার, তার সাথে ৩১টি রাজ্যে এবং ৭টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভোট করাতে অনেকগুন বেশি লোকবল দরকার পড়বে। অনেক সময়ই দেখা গেছে, যারা লোকসভা ভোটে ডিউটি করেন, তারাই পরে নিজেদের রাজ্যে বিধানসভা ভোটে ডিউটি করেন। তাহলে একসাথে ভোট হলে, লোক আসবে কোথা থেকে? তাদের পারিশ্রমিক দেবে কে? নিরাপত্তার কি ব্যবস্থা হবে? বাড়তি লোকেদের থাকা, খাওয়া খরচপাতি ধরলে দেখা যাবে সমকালীন ভোটের খরচ আরও বেড়ে যাবে। বিভিন্ন রাজ্যে যেখানে একাধিক পর্যায়ে ভোট করাতে নির্বাচন কমিশনের কালঘাম ছুটে যায়, সেখানে একসাথে লোকসভা ও বিধানসভা ভোট করতে গিয়ে দক্ষযজ্ঞ বেঁধে যাবে, এমনটা ভাবা কি অতিরঞ্জিত মনে হয়?
মানুষের গণতান্ত্রিক কণ্ঠরোধ
সমকালীন ভোটের সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়বে মানুষের মতপ্রকাশের ওপর। ‘দ্য হিন্দু’ কাগজে একটি পর্যেষণায় উঠে এসেছে এক ভয়ঙ্কর তথ্য। ১৯৯ থেকে ২০১৪ অবধি যতগুলি লোকসভা ও বিধানসভা ভোট একসাথে হয়েছে, তাতে জনমত প্রভাবিত হয়েছে একটি দলের প্রতি। দ্য হিন্দুর তথ্য অনুযায়ী, ৭৭% কেন্দ্রে মানুষ রাজ্য ও কেন্দ্র স্তরে একই দলকে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু দেখা গেছে যেখানে এই নির্বাচনগুলি একসাথে না হয়ে কিছু মাসের ব্যবধানে হয়েছে, সেখানে এই বুথের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৬১% তে। এর থেকেই প্রমাণিত হয় যে সমকালীন ভোট হলে মানুষ একই দলকে ভোট দেন।
আসলে, ২০১৪-র পর থেকেই মোদী হওয়ার দৌলতে রাজ্যে রাজ্যে বিজেপি নিজেদের জয়ধ্বজা উত্তোলিত করে থাকলেও ২০১৬-র পর থেকে তাদের পালে হাওয়া নেই। মোদীর জনপ্রিয়তা তলানিতে এসে ঠেকেছে। ২০১৯ এর বৈতরণী যদিও বা পার হয়, পরবর্তী বিধানসভা ভোটগুলিতে জেতার আশা ক্ষীণ। তাই যেন তেন প্রকারেণ জেতা চাই। সেই থেকেই সমকালীন নির্বাচনের ভাবনা।
যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো
সমকালীন ভোট হলে আরও সমস্যা দেখা দেবে। আমাদের দেশ বহুদলীয় গণতন্ত্রকে রীতিতে চলে। তাই, বিভিন্ন সময়ে কেন্দ্রে ও রাজ্যস্তরেও জোট সরকার গঠন হয়। ধরা যাক কোনও কারণে যদি কেন্দ্রে জোট সরকারের পতন হয়, তাহলে কি প্রত্যেকটা রাজ্যে গণতান্ত্রিক সরকারগুলিও ফেলে দেওয়া হবে, নতুন করে সমকালীন নির্বাচন করার জন্য? এতো যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর ওপর বিরাট আঘাত। কিংবা কোনও রাজ্যে জোট সরকারের পতন হলে সেই রাজ্যে পুনঃনির্বাচন কি কেন্দ্রের সরকারের মেয়াদ শেষ না অবধি টলানো হবে? দেশের বহুদলীয় গণতন্ত্রকে রীতি পাল্টে জোর করে দ্বিমাত্রিক রাজনীতিকরণের চেষ্টা চলছে, যা গণতন্ত্রের পক্ষে মঙ্গলময় নয়।
পরিশেষে
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ভারতবর্ষের গণতন্ত্র ৭০টি বছর অতিক্রম করেছে একটি মাত্র কারণের জন্য। ভারতের বিবিধতা কে গণতান্ত্রিক মান্যতা দেওয়া হয়েছিল। ‘এক দেশ এক ভাষা’ কিংবা ‘এক দেশ এক ভোট’ অথবা ‘এক দেশ এক কর’ – শুনতে ভাল লাগলেও এই ভাবনাগুলি কিন্তু আখেরে ভারতবর্ষের বিনাশের বীজ বপন করছে। ঐক্য চাই অভিন্নতা নয়।
( মতামত ব্যক্তিগত )