ছোটবেলায় মা বলতো, শনি পুজো ঘরে করতে নেই, বাইরে করতে হয়। গ্রামের বাড়িতেও তাই দেখতাম। শনি পুজোর দিন মার হাত ধরে বাইরে পুজো দিতে যেতাম। পুজোর পর মা হাতে নকুলদানা প্রসাদ দিত। সেই প্রসাদ খেয়ে হাত ধুয়ে ফেলতে হত। শনিকে এতটাই ভয় ভক্তি করতাম আমরা। শহরে এসে দেখি পাড়ায় পাড়ায় শনি ঠাকুরের রমরমা। রাস্তা দিয়ে দু পা হাঁটতে না হাঁটতেই শনি-কালী-হনুমান-শিব মন্দির। যত দিন যাচ্ছে মন্দিরের সংখ্যা এবং আয়তন দুটোই বাড়ছে। রাস্তার পাশে গাছতলায় একটা কালো পাথরে সিঁদুর লাগিয়ে যে পুজোর সূত্রপাত হয়েছিল, বছর পেরোতে না পেরোতেই সেটা বদলে যাচ্ছে একটা পেল্লায় মন্দিরে। আগে যা ছিল জীবনের সর্বক্ষেত্রে মার খেতে খেতে নিরুপায় লোকেদের ঈশ্বরে স্মরণ নেওয়ার এক আশ্রয়, এখন অনেকক্ষেত্রে তা হয়ে উঠেছে একশ্রেণীর মানুষের ভক্তির নামে বিত্ত ও ক্ষমতা প্রদর্শনের জায়গা। এবং তার ঠেলায় পথচারীদের প্রাণ ওষ্ঠাগত, নাজেহাল ট্র্যাফিক পুলিশ, বিভ্রান্ত যান চালকরা।
বাঁচার তাগিদে ফুটপাথ দখল করে কোন পসরা নিয়ে বসে পড়া নয়, এ হল শহরের রাস্তায় কিংবা ফুটপাথের জায়গা বেআইনিভাবে দখল করে পুজো আচ্চা শুরু করে দেওয়া। কাজেই প্রশাসন, পুলিশ, রাজনৈতিক দল, সাধারণ মানুষ সবাই ভক্তির সামনে বড়ই অসহায়। আমরা সবাই ধর্ম মানি। তার ওপর শনি বলে কথা, শনির দৃষ্টি বড় খারাপ, কালীও অল্পেই কুপিত হন, রুষ্ট হলে শিব শুরু করতে পারেন তাণ্ডব আর হনুমান সবকিছু যে কোন মুহূর্তে লণ্ডভণ্ড করে দিতে পারেন। নিরুপায় মানুষের এইসব মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। একটু লক্ষ্য করলেই দেখবেন পথের ধারের মন্দিরের গড়ে ওঠার সূত্রপাত করেন কিন্তু এলাকার নিম্নবিত্ত কিছু মানুষ। বেশীরভাগ সময়ই এরা স্থানীয় রিকশাওয়ালা কিংবা এলাকার খুচরো দোকানদার শ্রেণীর মানুষ ও পাড়ার কিছু বেকার যুবক। কিন্তু ইদানিং দেখা যাচ্ছে মন্দির গড়ে তোলার ব্যাপারটা চোখে পড়ার মত বেড়েছে। বাংলার মন্দির সংস্কৃতির এ এক আশ্চর্য পালাবদল।
কলকাতা, হাওড়া এখন এমনকি সল্টলেকেও ফুটপাথ জুড়ে শনিপুজো বাড়ছে। বাড়ছে কালী-শিব, হনুমান পুজো। একটু তফাতে রয়েছেন মনসা, শীতলা। প্রতিষ্ঠার ছকটা একই, প্রথমে গাছের নিচে পাথর কিংবা বিগ্রহ পুজো, তারপর পাকাপোক্ত মন্দির। কয়েকটা মন্দিরের পাশে আবার স্থানীয় রাজনৈতিক দাদাদের নামও লেখা আছে। একে দেবতাদের কিছু বলা যাবে না আর রাজনৈতিক নেতাদের কাছে কোন নালিশ জানানোর কথা সাধারণ মানুষ ভাবতেই পারেন না। কার কাছেই বা যাবেন তারা? যাদের কাছে যেতেন সেই দেবতাদের বিরুদ্ধেই তো তাকে বলতে হবে। এতটা সাহস আমারও নেই, আপনাদেরও নেই।
ছোটবেলা থেকেই আমার অকারণ ভক্তি কম। কালীপুজোর দিন আমাদের বাড়িতে লক্ষীপুজো হত। আমি পুজোর আগেই ভাল ভাল যেসব প্রসাদ নাড়ু, সন্দেশ এসব খেয়ে ফেলতাম। তাই মা আমাকে সেখান থেকে চলে যেতে বলতো। শহরে এসে আরেক রকম সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি প্রায় রোজই। একানে মন্দিরের সামনে জমাট বাঁধা ভিড়, মন্দির ছাড়িয়েও ফুটপাথ জুড়ে সামিয়ানা খাটিয়ে পুজোর আয়োজনের প্রতিবাদ জানাতেই মন্দিরের পাণ্ডারা বলেন,চলে যেতে। তাদের চোখমুখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার খুব একটা ভরসা পাই না।
মন্দিরের উদ্যোক্তাদের কাছে আমার একটাই অনুরোধ, আমাদের দেশে ধর্মাচরণের স্বাধীনতা সবার রয়েছে। আপনারাও আপনাদের বিশ্বাস অনুযায়ী ধর্মাচরণ করুন। কিন্তু দয়া করে অন্য লোকের অসুবিধা করবেন না। কারণ, কোন ধর্মবিশ্বাসই অন্যের অসুবিধা করে কোন উপাসনাকে স্বীকৃতি দেয় না। অ্যাকাডেমি চত্বরে গাছতলায় পুজো আচ্চা করা নিয়ে এখন চারদিকে বেশ হৈচৈ শুরু হয়েছিল। পরে অবশ্য গাছতলায় পাথর ফেলে পুজো শুরু করার জায়গাটাকে দখলমুক্ত করে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। এই বিতর্কে একদল বলেছিলেন তারা তাদের ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী কাজ করছেন, এটা কোন অন্যায় নয়। আরেকদল বলছেন, এই জায়গাটা মোটেই পুজো আচ্চার জায়গা নয়, তাই এখনে পুজো করা যাবে না। এই বিতর্কের বাতাবরণের বাইরে বেরিয়ে আমরা যদি অ্যাকাডেমি চত্বরটার দিকে তাকাই তাহলে দেখবো সেখানে বছরভর খোলা জায়গায় নাটক, গান, আলোচনাসভা এবং সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষদের আনাগোনা নিয়ে এলাকাটি সরগরম থাকে। আর তাছাড়া রয়েছে রবীন্দ্র সদন, শিশির মঞ্চ এবং অ্যাকাডেমিতে আসা দর্শকদের ভিড়। এর মধ্যে যদি মন্দিরের ঢাকঢোল, ঘন্টা-কাঁসর এবং ভক্তদের ভিড় যুক্ত হত তাহলে গোটা জায়গাটায় একটা চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হত। ধর্মাচরণ এবং সংস্কৃতি চর্চা কোনটাই করা যেত না। তাই অ্যাকাডেমি চত্বরের গাছতলাকে বেআইনি দখলদারদের হাত থেকে মুক্ত করা সঠিক সিদ্ধান্ত। পুজোর উদ্যোক্তাদের পরবর্তীকালেও এ ধরণের কাজ থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করছি।
গাছতলায় পাথর ফেলে যে পুজো আচ্চা শুরু হয় অনিবার্যভাবেই তা বহুসময় একটা মন্দিরে রূপান্তরিত হয়। শহরের সব পথ মন্দিরেরই একই অবস্থা। কিছুদিন আগেও লেকটাউন মোড়ের কাছে যশোর রোডে একটা গাছতলায় কিছু পাথর এবং দেবদেবীর মূর্তি দেখতাম। এখন সেখানে দস্তুরমত একটি হনুমান মন্দির। এবং শুধু তাই নয় মন্দিরের বাইরেও ফুটপাথের চারপাশে অনেকটা জায়গাকে লোহার জাল দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। পুজো আচ্চা, প্রসাদ বিতরণ, ভক্তদের ভিড়, পুরোহিতদের আশীর্বাদ সব মিলিয়ে সেই ভাবগম্ভীর পরিবেশে কোন পথচারী ঢুকতে সাহস করেন না। তারা রাস্তা দিয়ে হাঁটেন। ইতিমধ্যেই ঘটেছে কয়েকটি দুর্ঘটনা। আমার মা বলত ভক্তি ভালবাসা অন্তরে রাখতে হয়, প্রকাশ করতে নেই। কিন্তু রাস্তায় যারা মন্দির বানান তারা নিজেদের ভক্তি প্রকাশ করতে বেশি উৎসাহী। তাতে যে অন্যের অসুবিধা হচ্ছে সে খেয়াল তাদের নেই।
পার্ক স্ট্রিটে ঢুকেই বাঁদিকে দেখবেন একটা বিরাট মন্দির। সকাল সন্ধ্যা ধুপধুনো জ্বালিয়ে চলছে পুজো আচ্চা। বলাবাহুল্য সবকিছু চলছে লোকের অসুবিধা করে। কিন্তু কিছু বলা যাবে না। আমাদের কারোরই সেটা বলার সাহস নেই। বললেই আপনাকে ধর্মবিরোধী বলে দেগে দেওয়া হবে। দেবদ্বিজে ভক্তি আমাদের সবার আছে। কিন্তু সেই ভক্তি দেখাতে ফুটপাথে মন্দির বানানোর কি দরকার তা আমার মাথায় ঢোকে না! আর ভক্তি দেখানোর জন্য শহরে মন্দিরের তো কোন কমতি নেই। একই এলাকায় সব দেবতার একাধিক মন্দির রয়েছে। সেখানেও তো যাওয়া যায়। কিন্তু ভক্তি দেখানোর নামে কোনভাবেই রাস্তা আটকানো যায় না, লোকের অসুবিধাও করা যায় না।
শহরে একদিকে মন্দির বাড়ছে আরেকদিকে বাড়ছে বৃদ্ধাশ্রম। বাড়িতে বাবা, মার পরিচর্যা, তাদের সন্মান ও যত্নআত্তি করা মানেই প্রকৃত ঈশ্বর সেবা সে কথা তো সব ধর্মেই আছে। পথ মন্দিরের সমর্থকরা এ কথা জানেন কিনা জানি না। তাহলে হয় তো বৃদ্ধাশ্রম এত বাড়তো না। আমি ধর্মভীরু মানুষ না হলেও আপনাদের ধর্মাচরণের বিরোধিতা করার কোন উদ্দেশ্যই আমার নেই। তবুও আপনাদের হয়েই আমি শনি-কালী-শিব-হনুমান সব দেবদেবীকেই বলছি, তারা ভক্তদের ফুটপাথ জুড়ে মন্দির গড়ে পুজো আচ্চা বন্ধ করার সুবুদ্ধিটুকু অন্তত দিন। এটা বন্ধ না হলে মন্দিরের জঙ্গলে আপনারাই পথ হারাবেন।
(মতামত ব্যক্তিগত)