মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে চীন সফরে গিয়ে নরেন্দ্র মোদী যে কূটনৈতিক মর্যাদা পেয়েছিলেন, সেই রেকর্ড অক্ষত রাখতেই কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সফর নিয়ে উদাসীন কেন্দ্র? ২০১১ সালে ইউপিএ জমানায় গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী মোদীর চীন সফরে সদর্থক ভূমিকা নিয়েছিল মনোমোহন সিং সরকার। কিন্তু সেই মোদী সরকারের বিদেশ মন্ত্রক মমতার সফর সম্পর্কে কি একই তৎপরতা দেখিয়েছে? নাকি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বৈরিতামূলক সম্পর্কই শেষ পর্যন্ত বিড়ম্বনায় ফেলতে চেয়েছিল মমতাকে? তাই উপযুক্ত চীনা নেতৃত্বের বৈঠক নিশ্চিত না হওয়ায় ‘সফর মুল্যহীন’ বলে দাবি করেছিলেন মমতা। নবান্নের ব্যাখ্যা, এটা মুখ্যমন্ত্রীর ইজ্জতের প্রশ্ন।
নরেন্দ্র মোদী যখন চীনে গিয়েছিলেন, তখন গুজরাতের শাসকদলের সঙ্গে কেন্দ্রের শাসক কংগ্রেসের অহিনকূল সম্পর্ক। অথচ সেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নয় দিনের চীন সফরে যে গুরুত্ব ও মর্যাদা পেয়েছিলেন, তা এখনও পর্যন্ত কোনও ভারতীয় অঙ্গরাজ্যের প্রধান পাননি। নজিরবিহীনভাবে বেজিংয়ের গ্রেট হল অফ পিপল-এ অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিল গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীকে। সাধারণত কোনও দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বা দেশনেতাকে গ্রেট হল অফ পিপল-এ অভ্যর্থনা জানানোই রেওয়াজ। সেই প্রথম ভারতের একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর জন্য সেই চিরাচরিত প্রথা ভেঙেছিল চীনা সরকার। নিজের ওয়েবসাইটে একথা ফলাও করে প্রচারও করেছিলেন মোদী। যা বস্তুত ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী মোদীর ‘বায়ো-ডেটা’য় উজ্জ্বল সংযোজন হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। সেই সময় চীনে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের পদে ছিলেন পি জয়শঙ্কর। ইউপিএ সরকারের সদিচ্ছা ও বেজিংয়ের ভারতীয় দূতাবাসের সক্রিয়তায় সেদিন মোদী বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিলেন। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির প্রধান তথা পলিটব্যুরো সদস্যের সঙ্গে বৈঠক ছাড়াও তাঁর সফরসঙ্গী বেশ কিছু শিল্পোদ্যোগীকে নিয়েও সেখানকার বণিকসভার সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন মোদী।
নবান্নের দাবি, বিদেশ মন্ত্রকের প্রস্তাবে সায় দিয়েই মমতা চীন যাওয়ার ব্যাপারে মনস্থ করেছিলেন। দুই দেশের কুটনৈতিক বিনিময় কর্মসূচির অন্তর্গত ওই সফরে মুখ্যমন্ত্রী চীনা শিল্পমহলের সঙ্গেও আলোচনার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষস্তরের সঙ্গে আলোচনার জন্য আগ্রহী ছিলেন মমতা। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় বিদেশ মন্ত্রকের যে ভূমিকা নেওয়ার প্রয়োজন ছিল, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে মমতা চীনে গেলে সেটা তাঁর প্রাপ্য ‘ইজ্জতের’ সঙ্গে মানানসই হত না। কেননা, মোদী যখন চীনে গিয়েছিলেন, তখন তিনি কেবলমাত্র একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। অথচ মমতা ১৯৮৪ সাল থেকে (একবার বাদে) লোকসভার সদস্য। দুই দফার রেলমন্ত্রী ছাড়াও কেন্দ্রের একাধিক মন্ত্রকের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর দল বর্তমান সংসদে বস্তুত তৃতীয় বৃহত্তম দল। অর্থাৎ ২০১১ সালের মোদীর সঙ্গে কোনও মতেই মমতার রাজনৈতিক ওজনের তুলনা হতে পারে না। এহেন মমতা চীনের ‘উপযুক্ত’ নেতৃত্ব ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে আলোচনায় বসবেন কেন? এই প্রশ্ন যথেষ্ট সঙ্গত বলেই মনে করা হচ্ছে।
আগামী লোকসভা ভোটে মোদী বিরোধী জোটের কাণ্ডারীর ভূমিকা নিতে চলেছেন তৃণমূল নেত্রী। বিরোধী আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যে ঐক্য প্রয়াসে মমতার তৎপরতা এখন রাজ্যের সীমানা ছাপিয়ে সর্বভারতীয় স্তরে জায়গা পেতে চলেছে। মোদীর বিকল্প মুখ হিসেবে জাতীয় রাজনীতিতে মমতার নাম নিয়ে চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছে। এই অবস্থায় মমতার রাজনৈতিক মর্যাদা দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে স্বীকৃতি পেলে, তা বিজেপির পক্ষে বাড়তি চাপ হতে পারে। তাই কি শেষ পর্যন্ত দিল্লির সাউথ ব্লকের চালে মমতার সফর বাতিল হল? অথবা দিল্লির সেই চাল ধরতে পেরেছিলেন তৃণমূল নেত্রী। তাঁকে অপদস্থ করতেই যে ঘুঁটি সাজানো হচ্ছে, তা বুঝেই শেষ লগ্নে সফর বাতিল করে কার্যত কেন্দ্রকেই মোক্ষম জবাব দিয়েছেন মমতা। এই সব প্রশ্নই এখন রাজনৈতিক মহলে আলোচিত হচ্ছে।