বেসরকারি হাসপাতালের মতো ঝকঝকে ওয়ার্ড আর সরকারি হাসপাতালের সেরা ডাক্তারবাবুদের হাতে চিকিৎসা। দুইয়ের মিশেলে চালু হওয়া হাই প্রোফাইল ‘উডবার্ন মডেল’ সাফল্যের মুখ দেখবে কি দেখবে না! এই নিয়ে কম উৎকণ্ঠা ছিল না। বিশেষত যেখানে বেড ভাড়া হাফ কেবিনে ২৫০০ এবং ফুল কেবিনে ৪০০০ টাকা। আদৌ কতজন মানুষ পিজি হাসাপাতালের সদ্য চালু হওয়া উডবার্ন ওয়ার্ডে ভর্তি হতে আসবেন? নাকি লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে উডবার্নের আধুনিকীকরণের পুরোটাই জলে যাবে?
পিজি সূত্রের খবর, মধ্যবিত্তদের জন্য চালু ‘উডবার্ন মডেল’ বেশ ভালোমতোই সাফল্যের মুখ দেখল। আজ, শনিবার এক মাস পূর্ণ হবে নতুনভাবে চালু হওয়া এই ওয়ার্ডের একটি অংশের। একতলা ও দোতলা মিলিয়ে মোট ১৬ বেডের এই নয়া অংশে এক মাসে ভর্তি হয়েছেন ৫০ জন রোগী। নিখরচায় চিকিৎসার জন্য সরকারের ঘর থেকে যেখানে কোটি কোটি টাকা নিত্য খরচ হচ্ছে, সেখানে মাত্র এক মাসে এই ১৬টি আধুনিক বেডের সৌজন্যে সরকারি কোষাগারে জমা হল প্রায় নয় লক্ষ টাকা। সবমিলিয়ে সরকারি হাসপাতালে মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তদের টানতে প্রাইভেট পরিষেবার ঢঙে ঝাঁ চকচকে পরিষেবা সাফল্যের মুখ দেখায় উচ্ছ্বসিত পিজি কর্তৃপক্ষ।
যদিও বেশ কয়েকটি বিষয়ে পরিবর্তন না আনতে পারলে নতুন চালু হওয়া হাইপ্রোফাইল ওয়ার্ড নিয়ে ক্ষোভ বাড়তে বেশিদিন লাগবে না— এমনটাও মনে করছেন এখানে ভর্তি হওয়া বেশ কয়েকজন রোগীর বাড়ির লোকজন। পিজি’র নতুন অধিকর্তা ডাঃ মণিময় বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ভালো কাজ করার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। যেসব খামতি রয়েছে, ধাপে ধাপে মেটানোর চেষ্টা করব। রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা (শিক্ষা) ডাঃ দেবাশিস ভট্টাচার্য বলেন, বাজেট হাসপাতালের একটি ট্রায়াল রান হয়ে গেল। মানুষ খুশি হলেই আমরা খুশি।
পিজি’র এই হাইপ্রোফাইল ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেল, একতলা ও দোতলা মিলিয়ে রয়েছে ১৬টি কেবিন। একতলায় ছ’টি, দোতলায় ১০টি। ছোট কেবিনগুলির দৈনিক ভাড়া আড়াই হাজার টাকা। বড়গুলির ভাড়া দিনে চার হাজার টাকা। একদিকে, আধুনিক বেড, দামি সোফা ও আসবাব, অন্যদিকে, ঘরের বাইরে মার্বেলে মোড়া চওড়া বারান্দা, ব্রিটিশ আমলের ইজি চেয়ার।
আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের মিশেলে তৈরি নতুন অংশের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল বোধহয় ‘ওয়ান উইন্ডো’ ব্যবস্থা। ইমার্জেন্সি রোগীকে দেখানোর পর ডাক্তারবাবু উডবার্নে ভর্তি লিখে দিলেই ব্যস। মাঝে শুধুমাত্র একবার প্রশাসনিক ভবনে গিয়ে সেই কাগজ দেখিয়ে আসা। তারপর রোগীকে নিয়ে উডবার্নে এলে সব দায়িত্ব নতুন উডবার্নের রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিযুক্ত বেসরকারি সংস্থার। রোগীকে বেডে নিয়ে যাওয়া, সর্বক্ষণের আয়া লাগলে তার ব্যবস্থা করা, খাবারদাবারের ব্যবস্থা করা, ঘর-বারান্দা-বাথরুম ঝকঝকে তকতকে রাখা, রোগীর স্বাচ্ছন্দ্য ও প্রয়োজনের খেয়াল রাখা— সবটাই করছে এই বেসরকারি সংস্থা।
কাঁথির বাসিন্দা গৌতম গিরি ডায়াবেটিস ফুট আলসারের জন্য এখানে ভর্তি হয়েছেন। জানালেন, যথেষ্ট ভালো পরিষেবা। যা হিসেব করলাম, ১০ দিনে ৩০-৩৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। প্রাইভেটে গেলে বিশাল অঙ্কের খরচ হতো। মারাত্মক পথ দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত ডায়মন্ডহারবারের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ডাঃ দেবাশিস রায়ের মেয়ে দেবলীনা রায়। রাখঢাক না করে দেবাশিসবাবুর বক্তব্য, নতুন মডেল হিসেবে খুব ভালো। কিন্তু, মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করব তিন-চারটি বিষয়ে একটু লক্ষ রাখতে। এক, এখানে কোনও আইসিইউ-আইটিইউ নেই। দুই, সেন্ট্রাল এসি থাকলেও ঘরগুলির এসির নিজস্ব নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেই। তিন, রক্ষণাবেক্ষণকারী সংস্থার কর্মীদের আরও পেশাদার হওয়ার দরকার আছে। সিঙ্গুরের বাসিন্দা জয়ন্ত মুখোপাধ্যায়ের বাবা ভর্তি এখানে। জয়ন্তবাবু বললেন, প্রাইভেট হাসপাতালের লাগামছাড়া বিলের হাত থেকে বাঁচাতে এর চেয়ে দারুণ কিছু হয় না। তবে সরকারি হাসপাতালের সেই চেনা ঢিলেঢালা মানসিকতা এখানেও কিছুটা আছে। সেটা কাটাতে পারলে এই মডেল রাজ্যজুড়ে সাফল্যের মুখ দেখবে।