স্টেডিয়ামে বড় বড় করে জ্বলজ্বল করছে সাইনবোর্ড- ইংরেজি আর রাশিয়ান ভাষায়- ‘তামাক মুক্ত ২০১৮র ফিফা বিশ্বকাপে স্বাগত।’
গ্যালারিতে এসে বসলেন তিনি। চোখে রঙিন সানগ্লাস। পকেট থেকে বার করলেন মন্তেক্রিস্টো- হাভানা চুরুটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লেন। উদ্বেলিত জনতার দিকে মুষ্টিবদ্ধ হাত নাড়লেন। অন্য হাতে জ্বলছে হাভানা সিগার। ফুটবলের রাজপুত্রকে দেখে স্টেডিয়াম তখন গর্জমান। সিটে বসলেন চির বিদ্রোহী দিয়েগো মারাদোনা। ফিফার ‘তামাক মুক্ত’ গ্লোসাইন বোর্ডের দিকে তাকিয়ে হাভানার ধোঁয়া উড়িয়ে দিলেন।
এই ডোন্ট কেয়ার ভাবটারই নাম মারাদোনা। ৮২’র লাল কার্ড, ৮৬’র হ্যান্ড অফ গড, ৮৬’র একক দক্ষতায় দেশকে বিশ্বকাপ দেওয়া, ৯০’র পরাজিত নায়ক, ৯৪’র ডোপ কেলেঙ্কারিতে নির্বাসিত- মারাদোনা মানেই নতুন কোন ঘটনা।
এবারে বিশ্বকাপের গ্রুপ ভাগের লটারিতে হাজির হলেন। অংশ নিলেন। আর তারপর তার সাথে সাপে নেউলে সম্পর্কের ফুটবল সম্রাটের মাথায় চুমু খেলেন। পাশে পুতিন। ছবি ভাইরাল হল। আমাদের মতন অন্ধ ব্রাজিল অনুগামীরাও খুশি হলাম।
মারাদোনা অনন্য। কিন্তু পেলে যে ফুটবলের সম্রাট। একটা বিশ্বকাপে হাত দিতেও যেখানে তথাকথিত ‘মহাতারকাদের’ কাল ঘাম ছুটে যাচ্ছে সেখানে সম্রাট হাতে নিয়েছেন তিন তিনটি বিশ্বকাপ। হুইলচেয়ারে বসা সম্রাটের মাথায় চুমু দেওয়াটা তাকেই মানায়। তিনি দেশের জার্সিতে অতিমানব- তিনি আগুনের গোলা- বর্ণময় দিয়েগো মারাদোনা- হাভানা চুরুটের মতনই তিনি অনির্বাণ।
গ্যালারিতে যখন আগুনের পাখায় রং ছড়াচ্ছেন মারাদোনা তখন তার স্বপ্নের নীল সাদা জার্সিধারীরা একেবারে ফ্যাকাসে। গ্যালারিতে আক্ষেপ- দিয়েগোর রঙের ছিটেফোঁটাও যদি মাঠে গিয়ে ‘বার্সেলোনার মহাতারকাকে’ রাঙিয়ে দিত। ম্যাচ শেষে আক্ষেপ পরিণত হল হতাশায়।
বুয়েনস এয়ার্স থেকে উড়ে আসা মাঝবয়সী দম্পতি মিডিয়া বাইট দিতে গিয়ে বলেই বসলেন যে তারা ভেবেছিলেন ৪-০ বা নিদেনপক্ষে ৩-০ গোলে ম্যাচ জিতবেন। যুগলের পুরুষটি বললেন – মেসি আসলে বার্সেলোনার জার্সিতে যতটা ঝলমলে ততটাই রংহীন দেশের নীল সাদায়। ভাইকিং ‘দৈত্য’রা আজ প্রায় বোতলবন্দী করে রেখেছিল লা লীগার ‘সুপারস্টার’কে। পেনাল্টি পেলেন। নিজেই মারলেন। উড়ে গিয়ে রুখে দিলেন অধুনা ভাইকিং মৎস্যজীবী ও সিনেমা পরিচালক। ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র আইসল্যান্ড-এর গোলরক্ষক হ্যালডারসনের ওই দুর্দান্ত সেভের পর আরও ফ্যাকাসে হয়ে যান বার্সেলোনার মহাতারকা। গ্যালারিতে ঝলমলে মারাদোনা দেখতে থাকেন আর্জেন্টিনার সাদা-কালো ফুটবল। অবসর নেওয়া মেসি রেকর্ড সময়ে অবসর ভাঙায় আর্জেন্টাইন সমর্থকেরা আশায় বুক বেঁধেছিলেন। প্রথম ম্যাচের পর হতাশা সম্বল করেই ২১ তারিখের ম্যাচের দিকেই তাকাচ্ছেন তাঁরা- বার্সালোনার জার্সিতে মেসির জ্বলে ওঠা এবার অন্তত হোক নীল-সাদায়- এই প্রত্যাশা নিয়েই।
ইতিহাসের দুর্ধর্ষ ভাইকিংদের ছিল ঝড় তোলার নেশা। সমুদ্রে পারদর্শী এই স্ক্যান্ডেনেভিয়ানরা অষ্টম থেকে একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত সমুদ্রে ছিল অপ্রতিরোধ্য। ভূমধ্যসাগর ছাড়াও উত্তর আফ্রিকা, মধ্য প্রাচ্য ও এশিয়ার জলসীমা ভাইকিংদের দুঃসাহসের সাক্ষ্য বহন করেছিল। সেই ভাইকিংদের আধুনিক প্রতিনিধিরা বিশ্বকাপের আসরে লিখল নতুন ইতিহাস।
কোচ দাঁতের ডাক্তার। দলের ছয় ফুটবলারের পেশাও ডাক্তারি। একজন রাইট ব্যাক নুনের ব্যবসা করেন। দেশে নেই কোনো পেশাদারী লিগ।
আর হ্যালডারসন মাছের ব্যবসার সাথে সাথে সিনেমাও পরিচালনা করেন। ২০১২’র ইউরো ভিশনের জন্য দেশের শর্ট ভিডিও তারই বানানো। তৈরি করেছেন এই বিশ্বকাপের জন্য আইসল্যান্ডের প্রোমো ভিডিও। পেশাদার ফুটবলার হন ২০১৩ তে। ২৯ বছর বয়সে আইসল্যান্ডের ফুটবল রূপকথায় নিজের নাম গাঁথলেন ওই পেনাল্টি বাঁচিয়ে।
গত ইউরো মাতিয়েছিল এই আইসল্যান্ড। পর্তুগালকে রুখেছিল ১-১ গোলে। গত একবছরে হারিয়েছে ইংল্যান্ড ও ক্রোয়েশিয়াকে। এবার রুখল মেসিদের।
গত ইউরোতেই নজর কেড়েছিলেন আইসল্যান্ডের সমর্থকরা। ভাইকিংদের পুরোনো সাজে ছন্দময় ভাইকিং ক্ল্যাপ হৃদয় জিতে নিয়েছিল ফুটবল দুনিয়ার। ৩লাখ ৩৪ হাজার মানুষের দেশের ১৫ শতাংশ এসেছে রাশিয়ায়। ভাইকিং ক্ল্যাপে দলকে উদ্বুদ্ধ করতে।
বর্ণময় মারাদোনা, রংহীন মেসির সাথে সাথে ভাইকিং ক্ল্যাপের দেশপ্রেমিক সৈনিকরা তাল তুললেন। ভাইকিংদের রণতরী যখন বিজয়কেতন ওড়াবার জন্যে পাড়ি দিত অজানায় তখন দাঁড় বাওয়া হত তালে তালে। ইতিহাসের সেই তালি আবারও শোনা গেল। আগুয়েরোর গোলে যে তালি দমল না; গোল শোধের পর ভাইকিং ক্ল্যাপ দৃঢ় হল; পেনাল্টি বাঁচাবার পর সে তালি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আর জয়ের শেষেও আবেগতাড়িত কিন্তু ভাইকিং শৃঙ্খলায় ঋজু।
আইসল্যান্ডের বিশ্বকাপে প্রথম পয়েন্ট পাওয়ার ম্যাচ স্মরণীয় থাকবে মারাদোনার বর্ণময়তায়, মেসির ফ্যাকাসে পারফরম্যান্সে আর ভাইকিংদের অদম্য সংঘবদ্ধ তালিতে- ভাইকিং ক্ল্যাপে।