কিছুটা শীতল আবহাওয়া এবং উষ্ণ মানুষজন। রাশিয়া সম্পর্কে এমনটাই আমার ধারণা। ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে রাশিয়া এক ঐতিহ্যশালী দেশ। পূর্ব ইউরোপের প্রথম দেশরূপে রাশিয়া এবার বিশ্বকাপ আয়োজন করছে। আমি সফল বিশ্বকাপ আয়োজনের আশায় প্রহর গুণছি।
রাশিয়া কিংবা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে ফুটবল জীবনে আমার খেলার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ১৯৭১ সালে রাশিয়ার কিংবদন্তি গোলরক্ষক লেভ ইয়াসিনের বিদায়ী ম্যাচ খেলতে আমি সেদেশে গিয়েছিলাম। মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামটা নতুনভাবে গড়ে উঠলেও আমি পুরানো স্টেডিয়ামেই খেলেছিলাম। তখন ফুটবল দুনিয়ার সবচেয়ে বড় তারকাদের অন্যতম বেকেনবাওয়ার, ইউসেবিওরাও ওই ম্যাচে আমার সঙ্গে খেলেছিল। এছাড়া রাশিয়া বলতে আমার স্মৃতিতে এখনও অমলিন ১৯৫৮ সালে সুইডেনে আয়োজিত বিশ্বকাপের একটি ম্যাচ। সেটাই ছিল আমার প্রথম ইউরোপ সফর। বয়স মাত্র ১৭ বছর। দু’চোখে বিহ্বলতা নিয়ে আমি সেবার মোট চারটি বিশ্বকাপের মধ্যে প্রথমটি খেলতে গিয়েছিলাম। বাকিটা ইতিহাস। ১৯৫৮ সালেই আমরা প্রথমবার জিতেছিলাম জুলে রিমে কাপ। সেটাই তখন ছিল ফিফা বিশ্বকাপ। মোট তিনবার জুলে রিমে কাপ জিতে ব্রাজিল সেটি চিরকালের মতো দখলে নিয়ে নেয়। তারপর ১৯৭৪ সাল থেকে শুরু হয় ফিফা ওয়ার্ল্ডকাপ।
১৯৫৮ সালে আমার প্রথম বিশ্বকাপে কিছুটা চোট নিয়ে গিয়েছিলাম। প্রথম দু’টি ম্যাচে কোচ ভিনসেন্ত ফিওলা আমাকে খেলাননি। মূলত বিশ্রাম দেওয়ার জন্যই। এরপর সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ব্রাজিলের খেলাটি ছিল মাস্ট উইন ম্যাচ। সোভিয়েত গোলের নীচে ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে লেভ ইয়াসিন। ওর বিরুদ্ধে তখন গোল করাই ছিল খুব কঠিন কাজ। দলের সিনিয়ররা কোচ ভিনসেন্ত ফিওলাকে অনুরোধ করলেন, ফরোয়ার্ডে গ্যারিঞ্চা এবং আমাকে খেলানো হোক। এরপর আমাদের দলের সাইকোলজিস্ট আমাকে বার কয়েক বাজিয়ে দেখলেন। আমার ফাইটিং স্পিরিট আছে কি না, সেটাই ছিল তাঁর দেখার বিষয়। আমি ও গ্যারিঞ্চা শেষ তিনটি ম্যাচে ঝড় তুলে প্রতিপক্ষকে উড়িয়ে দিয়ে ব্রাজিলকে প্রথমবার বিশ্বকাপ এনে দিয়েছিলাম।
কিছুটা অতীতচারণার পর আবার বর্তমানে ফিরে আসি। অনেকেই এবারের ব্রাজিল দল সম্পর্কে আমার মতামত জানতে চাইছেন। আমরা চার বছর আগে ঘরের মাঠে বেলো হরাইজন্তেয় বিশ্বকাপ সেমি-ফাইনালে জার্মানির কাছে ১-৭ গোলে চূর্ণ হওয়ার ক্ষত সারিয়ে উঠতে পেরেছি কি না, তা নিয়েও বিস্তর প্রশ্ন শুনতে হয়েছে। আমার মতে, ২০১৬ সালে তিতে দায়িত্ব নেওয়ার পর ব্রাজিল আবার স্বমহিমায় বিউটিফুল ফুটবল খেলতে শুরু করেছে। কিছুদিন আগেও নেইমারের চোট নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল। কিন্তু এখন ও প্রায় পুরো ফিট। এবার বিশ্বকাপে দাগ কাটার জন্য মরিয়া নেইমার। আমার ধারণা ব্রাজিল এবার ফ্রি-ফ্লোয়িং ফুটবল খেলবে। আপফ্রন্টে ফেলিপ কুটিনহো, গ্যাব্রিয়েল হেসাস ও রবার্তো ফারমিনোর সঙ্গে নেইমার জুটি বেঁধে বিশ্বের যে কোনও দলের রক্ষণকে তছনছ করে দিতে সমর্থ। তবে রক্ষণকে সুদৃঢ় করতেই হবে। আর মিডফিল্ডে চাই ইমপ্রোভাইজেশন। তিতের আসল পরীক্ষা ইউরোপিয়ান দলগুলির বিরুদ্ধে। যেমন প্রথম রাউন্ডেই পড়ছে সার্বিয়া।
অন্য দলগুলির মধ্যে জার্মানি অবশ্যই এবারও ফেভারিট। ওদের স্ট্রাইকার নিয়ে একটু সমস্যা রয়েছে। বাকি সবক’টি পজিশনে জার্মান দলে যথেষ্ট ভারসাম্য রয়েছে। স্পেনও খুব ভালো দল। ইনিয়েস্তার এটাই শেষ বিশ্বকাপ। পর্তুগাল এবং ফ্রান্সের দিকে আমি তাকিয়ে থাকব। দু’টি দলই ইউরো-২০১৬’র ফাইনালে খেলেছিল। এছাড়া মেসির আর্জেন্তিনাকেও নম্বর দিতেই হবে। মেসি এবার বিশ্বকাপ জিততে মরিয়া। তাকিয়ে থাকব ইংল্যান্ড এবং বেলজিয়ামের দিকেও।
আবার ফিরে যাই, ফুটবল জীবনের সূচনায়। ১৭ বছর বয়সে ১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে শেষ তিনটি নক-আউট ম্যাচে আমি মোট ৬ গোল করে ব্রাজিলকে প্রথমবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করেছিলাম। ১৯৬২ সালের বিশ্বকাপের শুরুতে আমি চোট পেয়ে গেলেও গ্যারিঞ্চা একাই দলকে বিজয়মঞ্চে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। ৬৬’র বিশ্বকাপে আমাদের হিংস্র ট্যাকলে ক্ষত-বিক্ষত করে দেওয়া হয়। তার জবাব দিয়েছিলাম ১৯৭০ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপ জিতে। অবসর ভেঙে আমি সেবার ফিরে এসেছিলাম। মারিও জাগালোর প্রশিক্ষণে ব্রাজিল সেবার আক্ষরিক অর্থেই ‘বিউটিফুল’ ফুটবল খেলেছিল। আশা রাখি, এবার রাশিয়া বিশ্বকাপেও সেই রকম ‘জোগো বোনিতো’ উপহার দিয়ে নেইমাররা ষষ্ঠবার ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফিরবে!
(সংগৃহিত)