কনকনে ঠাণ্ডা, বৃষ্টি পড়ছে। ভোর তখন তিনটে। অ্যালিসভিলার গেট থেকে বেরিয়ে এলাম। রেলিং টপকে নামলাম রাস্তায়। একটু অস্বস্তি হচ্ছিল না তা নয়, চারদিক জনমানবহীন, ঘুটঘুটে অন্ধকার। দার্জিলিং তখন যাকে বলে একেবারে উত্তেজনায় ফুটছে। রোজ মৃত্যু, পুলিশের ওপর আক্রমণ, রাষ্ট্রবিরোধী সন্ত্রাস। খবরের কাগজের পাতা খুললেই গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের নেতা সুবাস ঘিসিং-এর নানা ‘কীর্তিকলাপের’ বিবরণ। আমি এসেছি আত্মগোপনকারী ঘিসিং –এর একটা এক্সক্লুসিভ ছবি তুলতে। এই আসারও একটা কারণ আছে। সেবার স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে ঘিসিং হুমকি দিয়েছিলেন তিনি স্বাধীনতা দিবসে পাহাড়ে কোন জাতীয় পতাকা তুলতে দেবেন না। তা কভার করতেই আমার পাহাড়ে আসা। সঙ্গী সাংবাদিক পূষন গুপ্ত। আমি তখন আজকালে।
রাস্তায় নেমে খানিকক্ষণ দাঁড়াতেই অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে এল সহকর্মী সাংবাদিক তুষার প্রধান। চৌখস রিপোর্টার, পাহাড়ের খবরে সেসময় ওর ধারেকাছে কেউ ছিল না। ঘিসিং ঘনিষ্ট তুষারের সহায়তায় ওর ডেরায় পৌঁছনোর জন্যই এই ভোর রাতের অভিযান। রাস্তায় নেমে হাঁটা শুরু করলাম। তুষারের হাতে একটা ছোট টর্চ, কীভাবে যাচ্ছি কোথায় যাচ্ছি কিছুই জানি না। উঁচু নিচু পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে একসময় পৌঁছলাম একটা বাড়ির সামনে। পুরোটা গাছে ঢাকা, ভেতরে যে একটা বাড়ি আছে তা বোঝা কঠিন। আচমকা হাজির হল দুজন লোক। নেপালি ভাষায় তাদের সঙ্গে কথা বলে তুষার আমাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে একটা ঘরের সামনে বসিয়ে চলে গেল। আমার বেশ ভয়ই করছিল। একটু পরেই তুষার এসে বলল, এই ঘরেই সুবাস ঘিসিং শুয়ে আছেন। কিন্তু আমি তোমাকে নিয়ে যাবো না। তুমি ঢুকে ম্যানেজ করে নাও, ঠিক সময় আমি ঢুকবো। ব্যস, এটুকু বলে তুষার উধাও।
আমিও ক্যামেরা বাগিয়ে ঘরে ঢুকে পড়লাম, ঘরে ঢুকেই দেখি ঘিসিং শুয়ে আছেন। মাথার কাছে একটা পেল্লায় কুকরি। আমি একটা ছবি তুলতেই ফ্ল্যাশের আলোর ঝলকানিতে জেগে উঠলেন ঘিসিং। চিৎকার করে উঠে তার কুকরিটা আমার মাথার ওপর ধরলেন। আমি তৎক্ষণাৎ এক লাফে পড়ে গেলাম ওর পায়ে। বললাম, আমাকে মারবেন না, আমি একজন ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার। এই ছবি আমি কোথাও দেবো না, তবে আপনার ছবি তুলতে পারলে আমার কোন জায়গায় চিত্র সাংবাদিক হওয়ার সুযোগ হবে। প্রথমে নেপালি তারপর ইংরেজিতে তারস্বরে আমাকে গালাগাল করতে শুরু করলেন। ঠিক এই মুহূর্তেই ঘরে ঢুকল তুষার।
ওকে দেখেই ঘিসিং নেপালি ভাষায় বলে উঠলেন, ‘ও কীভাবে এখানে এল? তুমি কি ওকে নিয়ে এসেছে?’ তুষার তা অস্বীকার করল। তবে তুষার জানাল সে আমাকে চেনে। এই বলে সে আমার প্রশংসা করতে শুরু করল। এরই মধ্যে চা নিয়ে ঢুকলেন ঘিসিং-এর স্ত্রী ধনকুমারি। আমি জল চাইলাম। আমি জানতাম, ঘিসিং ক্যামেরা থেকে রোলটা নিয়ে নেবেন। তাই তুষারের সঙ্গে ওর কথাবার্তার ফাঁকেই ক্যামেরা থেকে রোলটা বার করে একটা নতুন রোল ভরে দিলাম। যথারীতি ঘিসিং ক্যামেরা থেকে রোলটা বার করে নিলেন। আমিও মুক্তি পেলাম। আজকাল পত্রিকায় ছাপা হয় আমার সেই এক্সক্লুসিভ ছবি। তুষার প্রধানের সহায়তা ছাড়া আমি একাজ করতে পারতাম না। তা ছাপা হওয়ার পর অন্য কাগজের চিত্র সাংবাদিকরা আমার সঙ্গে কথা বলেনি। একমাত্র স্টেটসম্যানের শ্যামল মৈত্র ও দ্য উইক পত্রিকার অশোক বসু আমাকে বাহবা দেন, সাহস যোগান। দিদির সঙ্গে এবারের পাহাড় সফরের সময় সেদিনের সেই ঘটনার কথা বলছিলাম ঘিসিং তনয় মনকুমার ঘিসিংকে। ও বলল,‘দাদা, কিতনে দিন সে কাম কিয়া আপ, অব কিতাব লিখো।’
সেই পাহাড় আর এই পাহাড়ের কত তফাৎ গড়ে দিয়েছেন দিদি। এমনকি মন কুমারের মত তরুণরাও একথা বিশ্বাস করতে চায় না। এই বদলটা তো আমি চোখের ওপর দেখলাম। গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের সময় মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবাবু তো বটেই এমনকি বুদ্ধবাবুদের মত নেতাও পাহাড়ে পা রাখেন নি। বিচ্ছিন্নতাবাদিদের হুমকির সামনে কলকাতার দেওয়ালে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা সাক্ষী থাকুক পাহাড়ে কারা লড়ছে’ জাতীয় সস্তা কবিত্বমাখা স্লোগান লেখা ছাড়া সিপিএম আর কিছু করেনি। ওদের জেলার নেতারাও পাহাড় থেকে নেমে গিয়ে শিলিগুড়িতে বসে কাগজে বিবৃতি দিয়ে বীরত্ব ফলাচ্ছিলেন। আর জ্যোতিবাবু অর্থ ও সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে ঘিসিং কে তুষ্ট রাখার চেষ্টা করেছিলেন। এতে তার লোভ আরও বেড়েছিল।
দিদি কিন্তু জনবিচ্ছিন্ন এই সন্ত্রাসবাদীদের মোকাবিলায় জ্যোতিবাবুদের রাস্তায় হাঁটেন নি। ঘিসিং এর ড্রাইভার বিমল গুরুং এর নেতৃত্বে পাহাড়ে নতুন করে সন্ত্রাস শুরু হতেই তিনি শক্ত হাতে হাল ধরেছেন। গোড়াতেই তিনি ধরেছেন সমস্যার মূল জায়গাটা। তা হল পাহাড়ের সমস্যা সমাধানের জন্য পাহাড়ের মানুষদের কাছেই পৌছতে হবে। সমস্যার সমাধান করতে হবে তাদের নিয়ে। সিপিএমের মত শহরে বসে বিবৃতি দিয়ে আর পার্টির নেতাদের মুখে ঝাল খেয়ে এই পরিস্থিতি বদলানো যাবে না। পাহাড়বাসীদের আস্থা অর্জন করলেই তারা তার পাশে থাকবেন। আজ যখন সুকনা থেকে দার্জিলিং যাওয়ার পথের দুপাশে ‘ওয়েলকাম দার্জিলিং’ ঘোষণাসহ দিদির ছবি দেখি তখন বুঝতে পারি তিনি পাহাড়বাসীর হৃদয় জয় করেছেন। আগে এখানে থাকতো গোর্খাল্যান্ডের ঘোষণা ও পতাকা।জিএন এল এফের অস্ত্র ভাণ্ডার ছিল নিবেদিতার স্মৃতি বিজড়িত রায় ভিলা। পরবর্তীকালে এখানেই ছিল গুরুং এর গুন্ডাদের দাপট। দিদি সেটা গুরুংদের কাছ থেকে উদ্ধার করে রামকৃষ্ণ মিশনের হাতে তুলে দিয়েছেন। এখন সেখানে শান্তির আবহাওয়া। এটা একটা বিরাট কাজ করেছেন তিনি।
ক্ষমতায় আসার পর থেকে বছরে চার পাঁচবার তিনি ছুটে গেছেন পাহাড়ে। আর প্রতিবারই আমি দিদির সফর সঙ্গী। তিনি সেখানকার সর্বস্তরের মানুষের কথা শুনেছেন, তাদের সমস্যার সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন, দেখছি বলে ফেলে না রেখে আমলাদের দিয়ে বহু সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান করেছেন। পাহাড়বাসী তার আন্তরিকতা বুঝেছেন। আবার একইসঙ্গে বিমল গুরুংদের কোন অন্যায় দাবী তিনি সঙ্গে সঙ্গে নাকচ করেছেন।
একসময় পাহাড়ের মুখে হাসি ফোটার কথায় যারা মুখ টিপে হেসেছিলেন তারা এখন দেখছেন পাহাড় সত্যি সত্যি হাসছে। পর্যটনে, প্রশাসনে, গোটা দার্জিলিং জুড়ে তামাং, ধিমাল, লেপচা, গোর্খা সহ সব পাহাড়ি জনজাতির উন্নয়নের মধ্যে দিয়ে পাহাড়বাসীদের মুখে হাসি ফুটেছে। সাংবাদিক জীবনে বহুবার কাজের সূত্রেই সমস্যা কবলিত পাহাড় ও জঙ্গলমহলে বারবার যাবার সুযোগ হয়েছে আমার। দিদি যেভাবে এদুটো জায়গাকে বদলে দিলেন আমি তার প্রত্যক্ষদর্শী। আমাকে চামচা, দালাল যাই বলা হোক না কেন, সারা জীবন আমি এই উদ্যোগের পাশে থাকবো।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )