ঋতুপর্ণ ঘোষের সিনেমা ছোটবেলায় দেখা ছিল বারণ। “বড়দের” সিনেমা তাই। মনে আছে, এক দুপুরবেলা আমায় ফেলুদার হাতে সপে দিয়ে মা আর দাদা গেছিল ‘উনিশে এপ্রিল’ দেখতে। সেই থেকেই ‘ঋতুপর্ণ’ নামটার সাথে পরিচয়। এরপর কোনও এক বছর দূরদর্শনের ‘ছুটি ছুটি’ তে ‘হীরের আংটি’ থেকে ওনার প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা জন্মায়। ক্লাস টেনের পরীক্ষা দেওয়ার পর সাবালকত্ব অর্জনের দরুণ ‘শুভ মহরত’ দেখার সৌভাগ্য। সেই বছরই পুজোয় ‘উৎসব’ দেখা। চক্কোত্তি-সাহাদের দৌলতে বাংলা সিনেমা নিয়ে হাসিঠাট্টা করাটা বেমালুম ভুলে গেলাম। নতুন করে সিনেমা নিয়ে আগ্রহ জন্মালো আমার।
তিতলি, রেনকোট, বাড়িওয়ালি, অন্তরমহল, উনিশে এপ্রিল, অসুখ, দহন – ইন্টারনেটের দয়ায় ঋতুপর্ণর না দেখা সিনেমাগুলো কলেজে থাকাকালীন একাত্ম করে নিয়েছিলাম। সাথে সেই সময় বানানো ‘দোসর’, ‘খেলা’ কিংবা ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’ আর ‘আবহমান’ তো ছিলই। এরপরেই এক অন্য ঋতুপর্ণর জন্ম। নিজেকে ভাঙতে শুরু করলেন তিনি। বদলে গেল তার ছবির সংজ্ঞা, সমীকরণ সব। ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’ আর ‘মেমোরিস ইন মার্চ’ এ অভিনয়। রবীন্দ্রনাথের স্বার্ধশতবর্ষে নতুন এক রবির উদয় হল টেলিভিশনে, গানের ওপারের হাত ধরে। শুরু হল এক্সপেরিমেন্টেশন, যা চূড়ান্ত সত্ত্বা পেল ‘চিত্রাঙ্গদা’ তে।
ঋতুপর্ণ শুধুই কি চিত্রনির্মাতা ছিলেন? তাকে পরিচালকের গন্ডিতে বেঁধে রাখলে তাঁর শিল্পীসত্ত্বার অপমান। ঋতুপর্ণর জীবনদর্শন বাঙালির পথচলাকে অনুপ্রেরণা দেয়। একদিকে যখন আইপিসি ৩৭৭ নিয়ে সারা দেশ উত্তাল, ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’ আর ‘মেমোরিস ইন মার্চ’ এর মধ্যে দিয়ে কি নির্দ্বিধায় তিনি দুই পুরুষের ভালোবাসার গল্প বললেন – সমকামিতার ইস্যুটাকে বাঙালির বেডরুমে পৌঁছে দিলেন। মনে আছে ছোটবেলায় ইটিভিতে ঋতুদা একটি ‘টক শো’ সঞ্চালনা করতেন। আজ যে মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় দেশের প্রথম বৃহন্নলা কলেজ প্রিন্সিপাল হিসেবে খ্যাত, মানবী হওয়ার আগের সেই সোমনাথকে টিভির পর্দায় এনে প্রান্তিক এই মানুষদের কথা কিন্তু ঋতুদাই বাংলাকে বলেছিলেন।
নিজের শরীর নিয়ে কাঁটাছেড়া করার ফলেই নাকি ওষুধের কারবারে ঋতুদা চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে – তাকে নিয়ে বিতর্ক অনেক হয়েছে। কিন্তু, এসবের মধ্যেও ঋতুদা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেলেন, নিজের শরীরটা কিন্তু আমার নিজের। এর ওপর অধিকার বর্তায় শুধু আমার। হয়তো বনমালী নিজের রাধা সত্ত্বাকে পেতে চেয়েছিলেন। এজন্মে না হোক, একদিন নিশ্চয়ই বনমালী আর রাধার মিলন হবে।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )