আমি সাহা বাসে স্কুলে যেতাম। যে স্কুল বাসে আসতাম যেতাম সেটার হেল্পার ছিল কেষ্ট কাকু। কুলের আচার কিনে দিতো, জোয়ান ভাজা এনে দিতো, সিটের ওপর দাঁড়িয়ে লাফালে কোথা থেকে যেন একটা লোহার রড নিয়ে খালি “তবে রে, দাঁড়া দেখাচ্ছি “, “তবে রে, দাঁড়া দেখাচ্ছি” বলে ভয় দেখাতো। কিন্তু কোনদিন দেখিনি কাউকে মারতে। কম বয়সে ভয় পেতাম ওকে। ক্লাস সেভেন এইট হয়ে গেলে পেছনে লাগতাম। বুড়ো ক্ষেপে গেলেই আনন্দ। কেষ্ট কাকু ও এসব করে ২০ বছর কাটিয়ে দিয়েছিলো। সস্মানে।
ক্লাস ফোর থেকে সিক্স একজন মিস ছিল যে ফিনফিনে শাড়ি বা কটনের সালোয়ার পড়ে ক্লাসে আসতো। ইংলিশ পড়াতো। প্রশ্রয় দিত। গাল টিপে দিতো মোটা বাচ্চাদের। চুলে ইলিবিলি কেটে দিত বাকিদের এক গাল হেসে। মনে আছে আমার নাটকে অভিনয় দেখে কেঁদে ফেলেছিল একবার। কতই বা বয়স তখন। ওটা অস্কার প্রাপ্তির থেকেও বড় ব্যাপার। উপরি পাওনা আমায় জড়িয়ে ধরতো আনন্দে। ভেবেছিলাম প্রপোজ করি। হামি দিয়েছিল বোধহয় একবার। সেই সুগন্ধিটা বোধহয় অনেক বছর নিয়ে ঘুরেছি। মিসের এখন বয়স বোধহয় ৫৫ হবে। আর প্রপোজটা করে ওঠা হয়নি।
এরকম বাসকাকু, ফুচকা কাকু, আয়ামাসি, মিস, প্রিন্সিপাল , ম্যাম, পিটি স্যার- সব ছিল আমাদের। স্রেফ একজন কাউন্সিলর মিস ছিল না। যাকে মনের সব কথা বলা যেত। যাকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া যেত, যে গার্জেন কল হলেও মা-বাবাকে আমার সব দুষ্টুমি গুলো বলে দিত না। ছিল না কোন চাইল্ড কাউন্সিলর।
“হামি” একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছবি যা হাসতে হাসতে দেখে নেওয়াই যায় স্বপরিবারে। এ ছবি দেখে মা বাচ্চার চোখে হাত দিয়ে দেবে না সেক্স সিনে, ছেলে অস্বস্তিবোধ করবে না দিদাকে নিয়ে দেখলে, বাবা বোর হবে না। এটা আদর্শ নন্দিতা ও শিবপ্রসাদীয় ছবি। হালকা করে দরকারি জ্ঞান আছে তবে খারাপ লাগে না।
সত্যি তো আমাদের সময় স্কুলে কোথায় আর ছিল সিসিটিভি আর কোথায় এত এটেন্ডেন্ট। আসতাম বাসে যেতাম বাসে। প্যান্টে হিসু করে দিলে আয়ামাসি ছিল। আর ছিল সব্বার স্মৃতির একটা কোনা যা স্কুলের কোন গাছের নিচে, শেষের বেঞ্চে, আয়ামাসির ঘরে, মাঠের দিকে আজ ও রেখে দেওয়া। হামির স্মৃতি মাখা কিছু কোনা।
হামি ছবিটা তাদের দেখার জন্য যারা আর স্কুলে নেই প্রায় এক দশক হলো। হামি তাদেরও যারা বাবা মা হয়েছে কেয়েক বছর হলো। হামি তাদের যারা এখন দাদু দিদা হবে। হয়তো সেকারনেই শিবুদাদের সব ছবি হিট ও দারুণ ব্যবসা করে। নয়ডাতে বসে লোকে হাততালি দিচ্ছে, কাঁদছে, হেসে গড়িয়ে পরছে। দম চাই ভায়া। অনেক কুলিন পরিচালক কিন্তু পারেনা।
ভারতে শিশুদের নিয়ে নাটক, ওয়ার্কশপ করা, ছবিতে কাজ করানোর জনক বলতে যাকে জানে মুম্বাই সে হল অমল গুপ্তে। “তারে জমিন পর” আর “স্টানলি কা ডাব্বা” বানিয়েছে। দারুন ছবি পেরেন্টিং নিয়ে। শিবপ্রসাদ ছাপিয়ে গেছে সেই রেকর্ড। ভুতু, চিনি, অজাতশত্রু বা সামান্য ভূমিকায় অভিনয় করেছে যে সব ছেলেমেয়ে তারা ফাটাফাটি। কি ভালোই না এরা। এদের জন্য দেখতে যান অন্তত আর কিছু না হোক।
“হামি” একটা জরুরি প্রশ্ন তুলেছে। যে দেশে চালের চেয়ে সস্তা মোবাইল সিম, স্কুলের বই এর চেয়ে সস্তা ইন্টারনেট ডেটা আর স্কুলের মাসিক ফি এর চেয়ে সস্তা স্মার্ট ফোন- সে দেশে কি priority বেছে নেওয়া উচিৎ না? মা স্টার জলসা দেখতে দেখতে বাচ্চা পড়াচ্ছে। ছেলে মা বাবা খাওয়ার সময় দেখছে নিউজ চ্যানেলে শ্লীলতাহানির রোজনামচা। তারপর আমরা মোটা টাকা দিয়ে কোন গ্লোবাল স্কুলে পাঠিয়ে ভাবছি আমার ছেলের সলিড ফাউন্ডেশন হচ্ছে। বাস্তব?
এ ছবি এই সমস্ত হুজুগে গার্জেনদের দেখা উচিৎ যারা গুজব ছড়ায়, একটা ঘটনাতেই স্কুলের মিস, প্রিন্সিপালকে ভিলেন বানিয়ে দেয়, ফেসবুক হোয়াটসাপের শেয়ার, লাইক, কমেন্টের গন্ডিতে জীবন মেপে চলে।
গোটা ছবিটা জুড়ে সাউথ পয়েন্ট স্কুল আছে। আমাদের সময় প্রবাদ ছিল, সাউথ পয়েন্টের ছাত্রসংখ্যার কারনে কলকাতাবাসীর স্কুলজীবনে একটা না একটা স্মৃতি সাউথ পয়েন্টের সাথে জুড়ে থাকবে। আমার ও ছিল প্রেম পর্যায়ে। পেশায় হেড মিস্ট্রেস দিদা বলতো Calf Love। অর্থাৎ বয়ঃসন্ধিকালে ক্ষনিকের infatuation বা প্রেম প্রেম ভাব। এটা একটা কঠিন সময়। কখন যেন হামিটা বদলে যায় চুমুতে। স্কুলের কোন বাসের শেষ সিটে। আপনার ও মনে পরে এসব?