‘তন্ত্রশাস্ত্রে’ উল্লেখ করা হয়েছে যে, কালী ‘শক্তিদেবী’ ‘চণ্ডী’রই রূপভেদ মাত্র। অবশ্য ‘নিম্নস্তরের অনার্য সমাজ’ থেকেই যে ‘কালিকাদেবীর উৎপত্তি’ হয়েছে, তা তাঁর ‘দেবত্বের প্রকৃতি’ থেকেই উপলব্ধি করা যায়। তন্ত্রের ভেতর দিয়ে তিনি ক্রমে ‘পৌরাণিক সাহিত্যে’ও প্রবেশ লাভ করেন। কিন্তু পরবর্তী পৌরাণিক সম্পর্কের ফলেও তাঁর ‘অনার্য প্রকৃতির মূলে’ বিন্দুমাত্র ‘আর্য প্রভাব’ দেখা যায় না। অতএব ‘অনার্য সমাজের মধ্যে’ তিনি একজন ‘বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন দেবী’ ছিলেন বলেই গবেষকরা মনে করেন। ‘লিঙ্গপুরাণ’, ‘ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ’, ‘কালিকাপুরাণ’ ইত্যাদিতে অনেক কাহিনীর অবতারণা করে কালীর সঙ্গে আর্যদের একটা মৌলিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে; আবার পুরাণে কোন কোন জায়গায় তিনি ‘চণ্ডীর সঙ্গেও অভিন্ন’ বলে কল্পিত হয়েছেন, কিন্তু তা সত্বেও তাঁর ‘বিশিষ্ট অনার্য প্রকৃতি’ অত্যন্ত স্পষ্ট। বাংলার বাইরে কোন অনার্য সমাজ থেকে উদ্ভূত হয়ে এই দেবী ক্রমে ‘তন্ত্র ও পুরাণের মধ্যে দিয়ে’ বাংলার সমাজে প্রবেশ লাভ করেছেন। এই দেবী ‘অনার্য বাংলার নিজস্ব মৌলিক সৃষ্টি’ বলে গবেষকরা মনে করেন না। সেটা না হলে বাংলার প্রাচীনতম সাহিত্যেও তাঁর সম্বন্ধে গতানুগতিক নিয়মে ‘মঙ্গলকাব্য’ রচনার একটা চেষ্টা দেখা যেত। কিছু গবেষকের মতে, ‘কালীর পরিকল্পনায়’ ‘নাগাল্যান্ডের নরমুণ্ড শিকারী নাগাজাতির’ কোন প্রভাব থাকতে পারে। কারণ, কালীর মতন শত্রুর ছিন্ন মুণ্ডের মালা গলায় ধারণ করার রীতি তাঁদের মধ্যে একসময় প্রচলিত ছিল। ওদিকে পাশ্চাত্য পণ্ডিত ‘স্টেন কোনো’ (Sten Konow) কালীর সঙ্গে জার্মান দেশের ‘নারথুস’ নামে এক লৌকিক দেবীর সম্পর্ক আছে বলে মনে করেন। তাঁর মতে, কালী ‘ইন্দো-ইউরোপীয় জাতির দেবী’ – তিনি ভারতে ‘কালী’ ও জার্মানিতে ‘নারথুস’ নামে পূজিতা হন (A European Parallell to the Durga Puja, JASB, Vol. XXI, Page: 315-24)। কিন্তু তাঁর মতের স্বপক্ষে তিনি যে সকল যুক্তি দেখিয়েছেন, সেগুলোর বিশেষ কোন সারবত্তা আছে বলে গবেষকরা মনে করেন না। ‘কালিকা-মঙ্গলে’ দেবী কালিকার ‘মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠা করা’ মুখ্য উদ্দেশ্য নয়, অন্য কোন দেবতা বা দেবীর সাথে তাঁর দ্বন্দ্বও তাতে বর্ণিত হয়নি – ‘বিদ্যা ও সুন্দরের প্রণয়কাহিনী’ই সেই কাব্যের মুখ্য বর্ণিত বিষয়। সেই কাহিনীর মধ্যে ‘মঙ্গলকাব্যের আধ্যাত্মিকতা’ আরোপ করার জন্যই একটি দেবীর নাম এনে তাতে জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
‘চণ্ডী’র মতন কালীরও ‘প্রকৃতির মধ্যে বিভিন্নতা’ দেখতে পাওয়া যায়। ‘চণ্ডী’র মত ‘বিভিন্ন অনার্য সমাজের স্বতন্ত্র ধর্মপ্রবৃত্তি’ থেকে বিভিন্ন দেবতার প্রায় অনুরূপ পরিকল্পনা করা হয়েছিল – কালক্রমে তাঁরা সকলে কালী নামের সাধারণ পরিচয় গ্রহণ করেন। ‘ভদ্রকালী’, ‘রক্ষাকালী’, ‘দক্ষিণাকালী’, ‘শ্মশানকালী’, ‘নিশিকালী’, ‘মহাকালী’, ‘উন্মত্তকালী’ প্রভৃতি সকলই এক কালীর সাধারণ নামের অন্তর্গত হলেও মূলতঃ এদের ‘উদ্ভব ও প্রকৃতি স্বতন্ত্র’। অবশ্য অনেকের উদ্ভব পরবর্তী হলেও এঁদের মধ্যে যিনি মূল, তিনি অতি প্রাচীনকাল থেকেই ‘ভৈরব শিবের সঙ্গে’ সম্পর্ক স্থাপন করে নিয়েছিলেন। আনুমানিক খ্ৰীস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে উৎকীর্ণ ‘পশ্চিম ভারতের ইলোরা গুহা ভাস্কর্য্যে’ শিবের সঙ্গে কালীর মূর্তিও পাওয়া যায় – এটিই কালীর প্রাচীনতম রূপ বলে ঐতিহাসিক ও গবেষকরা মনে করেন। ‘তন্ত্রসার’ গ্রন্থে ‘ভদ্রকালী’র যে ‘ধ্যান’ বর্ণিত আছে তার সঙ্গে এর অনেক মিল দেখতে পাওয়া যায় (A History of Fine Art in India & Ceylon, V.A.Smith, Plate: XLIII, page – 210, Oxford, 1911)। ধ্যানটি নিম্নরূপ –
‘‘ক্ষুৎকামা কোটরাক্ষী মসীমলিনমুখী মুক্তকেশী রুদন্তী।
নাহং তৃপ্তা বদন্তী জগদখিলমিদং গ্রাসমেকং করোমি।।
হস্তাভ্যাং ধারয়ন্তী জ্বলদনলসন্নিভং পাশুমুগ্রম।
দন্তইর্জম্বুফলাভৈ পরিহরতু ভয়ং পাতু মাং ভদ্রকালী।।’’
গবেষকরা মনে করেন, এই পরিকল্পনাকেই আশ্রয় করে পরবর্তীকালে সম্ভবতঃ বিভিন্ন স্থানে ‘বিভিন্ন অনুরূপ লৌকিক দেবীর পরিকল্পনা’ করা হয়েছিল। ‘কলকাতার কালীঘাটের কালী’ও তাদের মধ্যে অন্যতম। সমগ্র ‘দক্ষিণাত্য ব্যাপী’ নিম্ন জাতির মধ্যে এখনও কালীপূজার ব্যাপক প্রচলন আছে, সেখানকার প্রাচীন ভাস্কর্য্যেও বিভিন্ন প্রকৃতির বহু কালীমূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। এদের মধ্যে বিশেষ প্রকৃতির এক কালী ‘দস্যু-তস্করদের দেবী’ ছিলেন। ‘তান্ত্রিক আচারে’ তাঁর পূজা হত এবং ‘তান্ত্রিক সমাজে’ই এই দেবীর উদ্ভব হয়েছিল, ‘তন্ত্রসার’ গ্রন্থে তার উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। ‘চৈতন্য ভাগবতে’ দেখতে পাওয়া যায় যে, দুই চোর শিশু চৈতন্যকে হরণ করার জন্য এই দেবীর শরণাপন্ন হচ্ছেন। আবার ‘ধর্মমঙ্গল কাব্যে’ আছে যে, ‘শিশু লাউসেন’কে হরণ করবার উদ্দেশ্যে ‘ইন্দা মেটে’ ‘নিশাযোগে কালীপূজা’ করে নিচ্ছেন। এই ‘বিশেষ প্রকৃতির কালী’কে নিয়ে প্রাচীন বাংলায় বহু ‘পাঁচালী’ রচিত হয়েছিল, তা ‘চোরের পাঁচালী’ নামে পরিচিত। ‘কালিকামঙ্গল’ গ্রন্থেও এই প্রকৃতির এক দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। অন্যান্য প্রশ্নের বিচার করার জন্য ‘কালিকামঙ্গলের কাহিনী’টি প্রথমে সংক্ষেপে আলোচনা করা দরকার। কাহিনীটি নিম্নরূপ –
গভীর রাত্রে সুন্দর নামে এক রাজপুত্র ভদ্রকালীর পূজা করছিলেন। তাঁর পূজায় সন্তুষ্ট হয়ে কালী তাঁর সামনে উপস্থিত হলেন ও তাঁকে বললেন, ‘‘যে বর প্রার্থনা কর, তাহা লইতে পার’’। রাজপুত্র বললেন, ‘‘নিভৃতে রাজকন্যা বিদ্যার সাথে সাক্ষাতের বর প্রার্থনা করি’’। কালী ‘‘তথাস্তু’’ বলে তাঁকে একটি ‘শুকপক্ষী’ দিলেন, বললেন, এই পক্ষীটি তাঁর কাজের সহায়ক হবে। সুন্দর সেই ‘শুকপক্ষী’ নিয়ে অদৃশ্য যাত্রা করলেন, অবশেষে তাঁর প্রণয়িনীর পিতৃরাজ্যে গিয়ে উপস্থিত হলেন। ক্রমে তিনি সেই রাজ্যের রাজধানীতে গিয়ে পৌঁছালেন। সুন্দর একটা গাছের নিচে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানে এক ‘মালিনী’ ফুল বিক্রি করতে আসল, সে রাজ অন্তঃপুরে ফুলের যোগান দিত। সুন্দরের সঙ্গে মালিনীর পরিচয় হল। মালিনী তাঁকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিল। সুন্দর সেই মালিনীকে ‘মাসি’ বলে সম্বোধন করল। মালিনীর কাছে সুন্দর ‘রাজকন্যা বিদ্যা’র বিস্তৃত পরিচয় পেল, সাথে তাঁর বিবাহের প্রতিজ্ঞার কথাও শুনল। বিদ্যার প্রতিজ্ঞা ছিল – যে তাঁকে বিদ্যায় পরাজিত করতে পারবে তাঁকেই সে বিয়ে করবে, অন্য কাউকে নয়। রাজকন্যা বিদ্যার এই প্রতিজ্ঞার কথা শুনে সুন্দর তাঁর সাথে দেখা করার জন্য অধীর হয়ে উঠল। মালিনী প্রত্যেকদিন রাজবাড়ীতে ফুল নিয়ে যেত। সুন্দর সেই ফুলের মধ্যে একছড়া অতি চিকন মালা গেঁথে তাঁর সঙ্গে দিয়ে দিল। মালার সঙ্গে একটি লেখায় নিজের পরিচয় লিখে দিল। মালার সঙ্গে সেই লেখা পেয়ে, সেটা পড়ে বিদ্যা সুন্দরের প্রতি আসক্ত হল। বিদ্যা মালিনীকে জানাল যে, সরোবরে স্নানের সময়ে সে তাঁর বোনপো কে দেখতে চায়। স্নানের ঘাটে দু’জনের সাক্ষাৎ হল, সঙ্কেতে আলাপও হল। সুন্দর সঙ্কেতে রাজকন্যা বিদ্যাকে জানালো যে সে সেই রাত্রেই তাঁর সঙ্গে দেখা করবে। কিন্তু কিভাবে সুন্দর রাজঅন্তঃপুরে প্রবেশ করবে, সেটা ভেবে পেল না। অনন্যোপায় হয়ে সে কালীকে ডাকতে লাগল। কালী তাঁর সম্মুখে আবির্ভুতা হলেন, বললেন – ‘‘আমার বরে মালিনীর গৃহ থেকে বিদ্যার গৃহ পর্যন্ত সুড়ঙ্গপথ হয়ে যাবে, তুমি সেই সুড়ঙ্গপথে গিয়ে বিদ্যার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে’’। সেই সুড়ঙ্গপথে সুন্দর রাজকন্যা বিদ্যার ঘরে প্রত্যেকদিন যাতায়াত করতে লাগল। ‘গন্ধর্বমতে’ তাঁরা ‘বিবাহ’ করে নিল, কালক্রমে বিদ্যা ‘গর্ভবতী’ হল। এক দাসী গিয়ে রাণীর কাছে এই সংবাদ দিল। এই সংবাদ পেয়ে ভীষণ রেগে গিয়ে রাণী প্রথমে বিদ্যাকে ভীষণ ভর্ৎসনা করলেন, তারপরে রাজাকে গিয়ে সব জানালেন। রাজা সব শুনে ‘কোটাল’কে ডাকলেন, তাঁকে আদেশ দিলেন যে, বিদ্যার ঘরে গোপনে যে যাতায়াত করে তাঁকে ধরতে হবে। কিন্তু বহু চেষ্টা ও অনুসন্ধানের পরেও সুন্দর ধরা পড়ল না। গোপনে সুড়ঙ্গপথে সে যেমনভাবে বিদ্যার ঘরে যাতায়াত করত, তেমন করতে লাগল। অবশেষে ‘কোটাল’ অন্য এক কৌশল নিল, সে বিদ্যার সমস্ত ঘর সিঁদুর দিয়ে রাঙিয়ে দিল। সুন্দর বিদ্যার ঘরে আসলে সেও সিঁদুরে রঞ্জিত হয়ে গেল। ফলে তাঁকে নিজের পোশাক থেকে সিঁদুরের দাগ তোলার জন্য সেটিকে ‘রজকের কাছে’ দিতে হল। রজকের গৃহে সিঁদুরে রঞ্জিত বস্ত্রের সন্ধান করে কোটাল সুন্দরকে ধরে ফেলল। রাজা তাঁর শিরচ্ছেদ করার আদেশ দিলেন। সুন্দরকে বেঁধে শিরচ্ছেদ করার জন্য ‘দক্ষিণ মশানে’ নিয়ে যাওয়া হল। সুন্দর মশানে কালীর স্তব পাঠ করল। কালী আবির্ভূত হলেন এবং রাজাকে নির্দেশ দিলেন যে তিনি যেন বিদ্যাকে সুন্দরের হাতে সমর্পণ করেন। রাজা সুন্দরের আসল পরিচয় পেয়ে সানন্দে রাজি হলেন। সুন্দর বিদ্যাকে বিবাহ করে নিয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করল।
প্রাচীনকাল থেকে প্রায় সব দেশের ‘লোক-সাহিত্যে’ ‘চোরের বুদ্ধির প্রখরতা’ সম্পর্কে নানা গল্প প্রচলিত আছে। ‘ইউরোপীয় লোকসাহিত্যের’ও একটি সাধারণ বিষয় (motif) হল, ‘princess won by cleverness’ (সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, ৪৫তম সংখ্যা, পৃষ্ঠা: ২১৭-১৮)। সংস্কৃত ভাষায় ‘চতুর’ শব্দের থেকেই ‘চৌর’ শব্দজাত। এতে উপস্থিত বুদ্ধির অনুশীলন হয়ে থাকে বলে প্রাচীনকালে এটি একটি ‘শিক্ষণীয় ও উচ্চশ্রেণীর বিদ্যা’ বলে কল্পিত হত। বাংলার অনেক রূপকথায় দেখতে পাওয়া যায় যে, রাজপুত্র অন্যান্য বিদ্যালাভের সঙ্গে ‘চৌর্য্য বিদ্যা’তেও বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করে দেশান্তরের রাজকন্যাকে কৌশলে হরণ করে আনছেন। প্রাচীন বাংলায় চোরের এই বিচিত্র জীবন কাহিনী অবলম্বন করে পাঁচালী আকারে বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাব্য রচিত হয়েছিল। ‘বীর কাশীশ্বর’ রচিত ‘চোর-চক্রবর্তী’ নামে একখানি কাব্য অতীতে বহুবার বটতলায় মুদ্রিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের প্রাচীন পুঁথিশালায় ‘চৌর-চক্রবর্তী কথা’ নামে এই শ্রেণীর আরেকটি পাঁচালী আকারের ক্ষুদ্র কাব্য রক্ষিত আছে। ‘শ্রী চিন্তাহরণ চক্রবর্তী’ সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় এর পরিচয় প্রদান করেছিলেন (সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, ৪৫তম সংখ্যা, পৃষ্ঠা: ২১৭-১৮)। তার ‘চোর নায়ক’ ‘বিজয়নগরের রাজমন্ত্রীর পুত্র’, নাম – ‘খরবর’। ‘কাব্য’, ‘জ্যোতিষ’ ও ‘অন্যান্য শাস্ত্র’ অধ্যয়ন করে সে, ‘‘কৌতুকে শিখিল উত্তম অধম চৌরবিদ্যা’’। সেই কাহিনীতে দেখা যায়, খরবর কালীর সাহায্যে রাজার শয়নকক্ষ থেকে রাণীকে চুরি করে, কিন্তু বহু অনুসন্ধান করেও ‘কোটাল’ চোরের সন্ধান পায় না। যে ‘চতুষষ্টিকলা’ লোকের কাছে বিশেষ আদর ও সম্মান পেত, তার মধ্যে ‘চুরিবিদ্যা’রও স্থান দেখতে পাওয়া যায়।
বঙ্গদেশের বাইরেও চোরের এই প্রকার ‘বুদ্ধি-বিচক্ষণতা সম্বন্ধে’ নানা গল্প প্রচলিত রয়েছে (The Art of Stealing in Hindu Fiction, Bloomfield, American Journal of Philosophy, Vol – XXXIV, page: 97-133 & 193-239)। উড়িষ্যায় প্রায় বিদ্যা-সুন্দরের গল্পের অনুরূপ ‘মুঘলমারীর রাজকন্যা শশীসেনার গল্প’ প্রচলিত আছে। এই শ্রেণীর গল্প যে বহু প্রাচীন কাল থেকেই ভারতের সর্বত্র প্রচলিত হয়ে আসছে, ভারতীয় প্রাচীন সাহিত্যে তার বিস্তৃত উল্লেখ থেকেই জানতে পারা যায়। ‘কথাসরিৎসাগর’, ‘দশকুমার-চরিত’ ইত্যাদি সংস্কৃত গ্রন্থে ‘রাজপুত্রের চুরিবিদ্যা শিক্ষা’ বিষয়ক অনেক গল্প বর্ণিত হয়েছে। কালক্রমে ‘চৌর্য্যশাস্ত্র’ নামে এক বিশেষ শাস্ত্র সম্বন্ধে সংস্কৃতে কতকগুলি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থও রচিত হয়। এদের একটির নাম ‘ষন্মুখকল্প’ ও অপর একটির নাম ‘চোরচর্য’ বা ‘চৌর্য্যস্বরূপ’। সংস্কৃত ভাষায় বিদ্যাসুন্দরের একখানি সমগ্র কাব্যও রচিত হয়েছিল (‘জীবানন্দ বিদ্যাসাগর’ সম্পাদিত ও প্রকাশিত, ১৯১৮ সাল)। কিন্তু সেটিকে খুব একটা প্রাচীন বলে গবেষকরা মনে করেন না। গবেষকরা মনে করেন যে, অনেকগুলো বাংলা বিদ্যাসুন্দর লিখিত হবার পরে ঐ গ্রন্থটি লেখা হয়েছিল। মনে করা হয়, ‘বররুচি’ই সংস্কৃত ভাষায় লেখা ‘আসল বিদ্যাসুন্দর কাব্যের লেখক’। কিন্তু সেটা ‘জনশ্রুতি’ মাত্র। ‘বেহুলার কাহিনী’ নিয়েও সংস্কৃতে কাব্য রচিত হয়েছে, ‘চণ্ডীমঙ্গলের কাহিনী’ও সংস্কৃতে রচিত হয়েছিল, কিন্তু সেইজন্য বেহুলা ও চণ্ডীর সংস্কৃত ভাষায় লেখা কাহিনীকেই ‘পদ্মাপুরাণ’ ও ‘চণ্ডীমঙ্গলের’ মূল বলা যেতে পারে না। ‘বিদ্যাসুন্দর-উপখ্যানম’ নামক ‘বাংলা ও নাগরীর অদ্ভুত মিশ্র অক্ষরে লেখা’ ও ‘বিক্রমাদিত্যের সভাকবি বররুচি কতৃক রচিত’ বলে উল্লিখিত একটি ‘সংস্কৃত পাণ্ডুলিপি’ অতীতে আবিষ্কৃত হয়েছিল (The Long-lost Sanskrit Vidyasundar, Proceeaings of the Oriental Conference, Second Session, S.C.Mitra, Calcutta, 1923, page: 215-20)। গবেষকদের মত, সেই পুঁথিটি কোন ‘বাঙালি লিপিকর দ্বারা’ অত্যন্ত আধুনিককালে লেখা। বঙ্গদেশে প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে ‘বররুচি’ এই শ্রেণীর একটি কাব্যের রচয়িতা এবং ‘উজ্জয়িনী’ এই কাহিনীর ঘটনাস্থল, অতএব মনে হয়, এই জনশ্রুতিকে ভিত্তি করেই উপাখ্যানটি পরবর্তীকালে কোন বাঙালি দ্বারা রচিত হয়েছিল – এ থেকে ‘বঙ্গদেশে ও বাংলাভাষায় বিদ্যাসুন্দরের কাহিনীর উদ্ভব’ হয়েছে, সেটা গবেষকরা সঙ্গত মনে করেন না। ‘বররুচি প্রণীত সংস্কৃত বিদ্যাসুন্দর’কে বাংলা বিদ্যাসুন্দর কাহিনীর মূল বলে কেউ কেউ নির্দেশ করেছেন – কিন্তু তাতে এটা প্রমাণিত হয় না যে সংস্কৃত কাহিনী থেকেই বাংলা কাহিনীটির উদ্ভব হয়েছিল। তবে সংস্কৃত থেকেই যে এই গল্পের কতকগুলো অংশ বাংলার পূর্বোল্লিখিত কোন ‘লৌকিক চোরের কাহিনী’র সঙ্গে এসে যুক্ত হয়ে ‘বিদ্যাসুন্দরের কাহিনীর বর্তমান রূপ’ ধারণ করেছিল, সেই বিষয়ে গবেষকরা সহমত পোষণ করেন। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় যে এই সংস্কৃত আখ্যায়িকাটি কি এবং এটি কোথা থেকে আসল?
কাশ্মীরের বিখ্যাত ‘কবি বিলহণ’ রচিত ‘চৌর-পঞ্চাশিকা’ একটি সংস্কৃত খণ্ডকাব্য। এর ‘পঞ্চাশটি শ্লোকে’ কবি ‘তাঁর প্রেমিকার উদ্দেশ্যে গভীর হৃদয়াবেগ’ প্রকাশ করেছেন। এটি সম্পূর্ণ ‘ধর্মাভাব-বিবর্জিত’। কথিত আছে, ‘কবি বিলহণ’ কোন এক রাজকন্যার সাথে ‘গুপ্ত প্রণয়ে’ আবদ্ধ ছিলেন। রাজা সেটি জানতে পেরে তাঁকে প্রাণে বধ করতে উদ্যত হন। ‘বিলহণ’ তখন ‘পঞ্চাশটি শ্লোক’ রচনা করে রাজকন্যার প্রতি ‘তাঁর অন্তরের গভীর প্রণয়’ জ্ঞাপন করেন। এটাই ‘বিদ্যাসুন্দরের কাব্যের মূল’ বলে মনে হয়। ‘কাশ্মীরি কবি বিলহণ’ আনুমানিক খ্ৰীস্টীয় দ্বাদশ শতকের ব্যক্তি ছিলেন। অতএব দ্বাদশ শতকেই এটি রচিত হয়েছিল, পরে সর্বত্র প্রচার লাভ করেছে। কাশ্মীরের প্রচলিত কাহিনীতে রাজকন্যার পিতার নাম ‘বীরসিংহ’ – বাংলা বিদ্যাসুন্দরেও রাজার সেই একই নাম। ওদিকে ‘দক্ষিণাত্যে প্রচলিত একই কাহিনীতে’ চরিত্রগুলোর নাম একটু স্বতন্ত্র, অবশ্যই সেটা স্থানীয় প্রভাব বলে স্বীকার করতে হয়। ক্রমে ‘চৌর-পঞ্চাশিকা’র কাহিনীটি বঙ্গদেশে এসে উপস্থিত হয় এবং সেটি এখানে ‘আগে থেকেই প্রচলিত একটি প্রণয়কাহিনীর অন্তর্ভুক্ত’ হয়ে পড়ে। কিন্তু সেই ‘আগে থেকে প্রচলিত প্রণয়কাহিনীটি’ যে কি সেটা আর এখন বলার কোন উপায় নেই। গবেষকরা মনে করেন যে ‘ভাগবত পুরাণ’ গ্রন্থের অন্তর্গত ‘ঊষা-অনিরূদ্ধের কাহিনী’টিও এর ভিত্তি হতে পারে। ‘মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে’ ‘ঊষা-অনিরূদ্ধের কাহিনী’টিও ব্যাপক প্রচার লাভ করেছিল এবং সেই কাহিনীটি ‘মনসামঙ্গল’ গ্রন্থেরও অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিল, হয়ত সেটির থেকেই ‘বিদ্যাসুন্দরের কাহিনী’ প্রেরণা পেয়েছিল বলে গবেষকদের অভিমত। কেউ কেউ আবার মনে করেন যে, ‘পালি ভাষায় রচিত’ ‘উমমগগ জাতক’ থেকে বিদ্যসুন্দরের গল্পটি এসেছে। কিন্তু ‘উমমগগ জাতকের কাহিনী’ যে বাংলা সাহিত্যে প্রচলিত ছিল, তার কোন প্রমাণ আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। অপরপক্ষে ‘ঊষা-অনিরূদ্ধের কাহিনী’ যে প্রচলিত ছিল তার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। সুন্দর ‘মশানে’ নীত হয়ে ‘চৌর-পঞ্চাশিকার অনুরূপ সংস্কৃত শ্লোক’ আবৃত্তি করলেন। অবশ্য দু’জন বাঙালি বিদ্যাসুন্দরের লেখক – ‘কঙ্ক’ ও ‘কাশীনাথ’ – সম্ভবতঃ ‘বাংলার অবিমিশ্র প্রাচীন লৌকিক কাহিনীটি’ নিয়েই কাব্য রচনা করেছিলেন, ‘বিলহণের চৌর-পঞ্চাশিকা’ তাঁদের কাব্যে স্থানলাভ করেনি। এই ‘প্রণয়কাহিনীর মধ্যে’ একটি ‘গুপ্ত চৌর্য্যের বৃত্তান্ত জড়ি’ত রয়েছে বলে, ক্রমে দেবী কালীকে এনে এই কাব্যের মধ্যে স্থান দেওয়া হয়েছে। ‘শক্তি দেবী কালীর মাহাত্ম্যই’ যে এই কাহিনীর মুখ্য বর্ণিত বিষয় নয়, তা একজন ‘বৈষ্ণব কবি’ ও একজন ‘মুসলমান কবি’ লিখিত ‘বিদ্যাসুন্দরের কাহিনী’ থেকেও জানতে পারা যায়।
বাংলার ‘বিদ্যাসুন্দরের কাহিনীর আদি রচয়িতা’ কে? শেষ অনুসন্ধান পর্যন্ত বিদ্যাসুন্দরের যত পুঁথি সম্বন্ধে জানা গেছে তা থেকে মনে হয় ‘পূর্ব ময়মনসিংহের অধিবাসী কবি কঙ্কের রচিত বিদ্যাসুন্দর’ই প্রাচীনতম। কঙ্কের লেখা বিদ্যাসুন্দরের পুঁথি আবিষ্কার করেছিলেন ‘চন্দ্রকুমার দে’। এর একটা পুঁথি তিনি প্রখ্যাত গবেষক ‘দীনেশচন্দ্র সেন’কে দিয়েছিলেন, এছাড়া আরও একটা পুঁথি তাঁর সন্ধানে ছিল বলে তিনি আরেক প্রখ্যাত গবেষক ‘আশুতোষ ভট্টাচার্য’কে জানিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় অপর পুঁথিটি আজও অপ্রকাশিত। ‘চন্দ্রকুমার দে’ ১৩২৫ ও ১৩২৬ বঙ্গাব্দে ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত ‘সৌরভ’ পত্রিকায় ‘কবি কঙ্কের বিস্তৃত বিবরণ’ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু ‘কবি কঙ্ক’কে বিদ্যাসুন্দরের একমাত্র কবি বলে মেনে নেওয়া যায় না। কারণ, কঙ্কের পুঁথি যিনি আবিষ্কার করেছিলেন বলে দাবি করেছিলেন, তিনি ছাড়া প্রাচীন বাংলার আর কোনও গবেষক ও প্রাচীন পুঁথি অনুসন্ধানকারী কঙ্কের আর কোনও পুঁথি দেখতে পেয়েছিলেন বলে জানা যায় না। দ্বিতীয়তঃ, ‘কবি কঙ্ক’ যে ভাষার ব্যবহার করেছিলেন – গবেষকদের মতে সেটা বেশ ‘নবীন’, সেই ভাষাকে ‘প্রাচীন ভাষা’ বলে গ্রহণ করা কঠিন। তবে ভাষা কালক্রমে পরিবর্তিত হতে পারে। কিন্তু আরেকটা সমস্যা হল কঙ্কের কাব্য রচনার নির্দিষ্ট কোন সময়ের উল্লেখ পাওয়া যায় না। গবেষকরা অনুমান করেন যে ‘কবি কঙ্ক শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর সমসাময়িক’ ছিলেন। কঙ্ক ‘ব্রাহ্মণ বংশে’ জন্মে, শৈশবে পিতৃমাতৃহীন হয়ে এক ‘চণ্ডালের গৃহে’ বড় হয়েছিলেন। পরে তাঁকে সমাজে পুনরায় ব্রাহ্মণ পর্যায়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন ‘গর্গ’ নামে এক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত, কিন্তু ব্রাহ্মণ সমাজের ঘোর বিরোধিতায় সেটা আর সম্ভব হয়নি। কঙ্কের লেখা বিদ্যাসুন্দর কিন্তু ‘কালীর মাহাত্ম্য-প্রচারক’ কাব্য নয়। ‘বিপ্রগ্রামবাসী এক পীরের আদেশে’ কবি কঙ্ক তাঁর কাব্য রচনা করেছিলেন, সেইজন্য তাঁর কাব্যে উল্লেখিত দেবতা হলেন ‘সত্যপীর’ বা ‘সত্যনারায়ণ’। কঙ্ক তাঁর কাব্যকে ‘পীরের পাঁচালী’ বলে উল্লেখ করে নিজেই লিখেছিলেন – ‘‘গুরুর আদেশে গাহি পীরের পাঁচালী’’। অবশ্য এছাড়া আর কাহিনীর কোন বিষয়ে পার্থক্য নেই। ‘সত্যপীরের উল্লেখ’ থাকার জন্য কোন কোন গবেষক মনে করেন যে, কঙ্কের কাব্য খ্রীস্টিয় ষোড়শ শতাব্দীর রচনা হতে পারে না। কিন্তু ‘স্কন্দপুরাণে’ও ‘সত্যপীরের উল্লেখ’ পাওয়া যায়। ‘স্কন্দপুরাণ’ এরও পূর্ববর্তী রচনা। বিদ্যাসুন্দরের কবিদের মধ্যে কাব্যে উল্লেখিত স্থানসমূহের নামের কোন স্থিরতা ছিল না। ‘বিদ্যা ও সুন্দরের নাম’ ছাড়া অন্য নামগুলোতেও অনেক সময় অনৈক্য দেখা যায়। অবশ্য এতে মূল কাহিনীর কোন ক্ষতি-বৃদ্ধি হয় নি, ‘কালিকামঙ্গলে দেবতা মুখ্য নন’। ‘কঙ্কের কাব্য’ ও ‘তাঁর পরে যেসব কালিকামঙ্গল কাব্য’ লেখা হয়েছিল সেগুলোর কতগুলো বিষয়ে একটু ‘পার্থক্য’ দেখা যায়। মূল কাহিনীর বর্ণনাতেও সামান্য কিছু ব্যতিক্রম আছে। কঙ্কের কাব্য ‘আদিরস’ প্রধান নয়। ‘চৈতন্যে আসক্তি’ দেখে গবেষকরা মনে করেন যে তিনি ‘বৈষ্ণব’ ছিলেন, সেই জন্য তিনি নিজের রচনায় কোথাও ‘নীতির সংযম লঙ্ঘন’ করেন নি। কঙ্কের রচনা সরল ও মধুর, তাঁর লেখার অনেক জায়গায় ‘বৈষ্ণব কবিতার সুর’ও ধ্বনিত হতে শোনা যায়। একটা সময়ে ‘ময়মনসিংহ অঞ্চলে’ ‘কঙ্কের বিদ্যাসুন্দর’ ব্যাপক প্রচার লাভ করেছিল।
কবি কঙ্কের পরবর্তী আর যে সকল ‘বিদ্যাসুন্দরের বা কালিকামঙ্গলের কবির নাম’ ও তাঁদের ‘রচনার মোটামুটি সময়কাল’ জানা যায় তাঁরা হলেন – ‘শ্রীধর কবিরাজ’ বা ‘দ্বিজ শ্রীধর’ (গৌড়ের শাসক ফিরোজ শাহের সমসাময়িক), ‘শা’বারিদ খান’ (প্রকৃত সময়কাল জানা যায় না), ‘গোবিন্দ দাস’ (প্রকৃত সময়কাল জানা যায় না), ‘কৃষ্ণরাম দাস’ (১৫৮৬ শকাব্দ বা ১৬৬৪ খ্রীস্টাব্দ), ‘প্রাণরাম চক্রবর্তী’ (১৫৮৮ শকাব্দ বা ১৬৬৬ খ্রীস্টাব্দ), ‘বলরাম চক্রবর্তী’ (নির্দিষ্ট সময় জানা যায় না, তবে তিনি রামপ্রসাদ ও ভারতচন্দ্রের পূর্ববর্তী কবি), ‘রামপ্রসাদ সেন’ (প্রকৃত সময়কাল জানা যায় না, তবে গবেষকরা অনুমান করেন তাঁর লেখা বিদ্যাসুন্দর বা কালিকামঙ্গল ভারতচন্দ্রের কাব্যের দুই-এক বছর আগে লেখা হয়েছিল), ‘নিধিরাম আচার্য’ (১৬৭৬ শকাব্দ বা ১৭৫৬ খ্রীস্টাব্দ), ‘দ্বিজ রাধাকান্ত’ (প্রকৃত সময়কাল জানা যায় না), ‘কবীন্দ্র’ (রামপ্রসাদ ও ভারতচন্দ্রের পূর্ববর্তী, তাঁর রচনা খ্রীস্টিয় অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে রচিত হয়েছিল বলে গবেষকরা অনুমান করেন)। এই সকল কবি ছাড়াও ‘মধুসূদন’, ‘ক্ষেমানন্দ’, ‘বিশ্বেশ্বর দাস’, ‘কবিচন্দ্র’ প্রভৃতি প্রণীত কালিকামঙ্গলের নাম পাওয়া যায় – কিন্তু এঁদের সম্বন্ধে বিস্তারিত কোন তথ্য পাওয়া যায় না।
‘মধ্যযুগের বাংলার কালিকামঙ্গল’ বা ‘বিদ্যাসুন্দর কাব্য’গুলো আলোচনা করলে দেখা যায়, এরা প্রধানতঃ দুটো ধারা অনুসরণ করে এগিয়েছিল – ‘পশ্চিমবঙ্গের একটা ধারা’ এবং ‘চট্টগ্রামের একটা ধারা’। চট্টগ্রামের ধারাটি যে কেবলমাত্র ‘প্রাচীনতর’ ছিল সেটাই নয় – সেটা নানা দিক দিয়ে ‘অত্যন্ত শক্তিশালী’ ছিল। কারণ, কয়েক শতাব্দীর ভেতর দিয়ে চট্টগ্রামের ধারা অগ্রসর হয়েছিল। এর মধ্যে ‘অশ্লীলতার বর্ণনা’ অপেক্ষাকৃত অল্প। উদ্দিষ্ট দেবী কালিকা এতে একেবারে ‘বিলীন’ হয়ে যান নি। পশ্চিমবঙ্গের ধারাটি ‘ভারতচন্দ্রের আগে পর্যন্ত’ তেমন শক্তি সঞ্চয় করতে পারে নি। এর মধ্যে দেবী ‘পটভূমিকায় বিলীন’ হয়ে গিয়েছিলেন, ‘মানবিক লালসা’ উদ্দম নৃত্য করেছিল। চট্টগ্রামের ধারাটিতে ‘ভক্তিভাব’ কখনও একেবারে বিদূরিত হয়ে যায় নি। বিদ্যাসুন্দরের কাহিনী ছাড়াও পরবর্তীকালে আরও একটা ‘কালিকামঙ্গল কাব্য’ রচিত হয়েছিল বলে জানতে পারা যায়। সেই কালিকামঙ্গলের রচয়িতা ছিলেন ‘রাঘব কবীন্দ্র’। ‘মঙ্গলকোটের অধিপতি বৎসমল্লের বিরুদ্ধে’ ‘নাগরাজ যমঘন্টের যুদ্ধবৃত্তান্ত’ নিয়ে সেটা রচিত হয়েছিল। ‘বৎসমল্ল’ ছিলেন ‘শিবভক্ত’, ওদিকে ‘যমঘন্ট’ ছিলেন ‘কালীভক্ত’ – শেষপর্যন্ত ‘যমঘন্টের বিজয় বর্ণনা করে’ সেই কাহিনী সম্পূর্ণ হয়েছিল। কিন্তু সেই রচনার কবির কোনও পরিচয় আজ পর্যন্ত জানতে পারা যায় নি।
(তথ্যসূত্র:
১- বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস, শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য, এ. মুখার্জী এন্ড কোং প্রাইভেট লিমিটেড (২০০০)।
২- Hindu Goddesses: Visions of the Divine Feminine in the Hindu Religious Tradition, David R. Kinsley, Motilal Banarsidass (২০০৫)।
৩- Book Of Kali, Seema Mohanty, Penguin India (২০০৯)।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত