আজকালকার ছোটরা জানেই না ঝুলন কী! অতীতে শুধু যে দেবালয়েই এই ঝুলন সাজানো হত তা নয় ছোট ছেলেমেয়েরা বাড়িতেও সাজাতো ঝুলন। তা নিয়ে উন্মাদনাও কম ছিল না। কার ঝুলন সাজানোর কত ভাল হয়েছে তা নিয়েও চলত প্রতিযোগীতা। ঠাকুর দেবতা ছাড়াও কখনও কখনও বর্তমান সমাজ, বন জঙ্গল পশু পাখিতেও সাজানো হতো ঝুলনে। তখনকার মৃতশিল্পীরা এই ঝুলন সাজানোর জন্য নানা ধরণের মূর্তি বানাতেন। কোথাও কোথাও রীতি ছিল ঝুলনযাত্রা শেষ দিন রাধাকৃষ্ণকে দোলা বসিয়ে, নাম কীর্তন করে, গৃহস্থের বাড়ি বাড়ি পরিক্রমা করা। তবে এখন সে সব অতীত। আজকাল কিছু বিশেষ মন্দির ছাড়া ঝুলন সাজানো হয়না কোথাও।
শাস্ত্রে বলছে –
“অনুগ্রহায় ভূতানাং মানুষং দেহমাশ্রিতঃ।
ভজতে তাদৃশীঃ ক্রীড়াঃ যাঃ শ্রুত্বা তৎপরো ভবেৎ।।”
অর্থাৎ, ‘‘ভগবান ভক্ত অভক্ত নির্বিশেষে সকলকে অনুগ্রহ করবার জন্য গোলকধাম থেকে ভূলোকে এসে লীলা করেন।’’
এই লীলার কারন সম্বন্ধে শাস্ত্রে বলছে – ভগবানের এই দিব্যলীলার আনন্দ মাধুরী শ্রবন করে ভক্তগণ দিব্য ও অমৃত ভক্তি লাভ করবে। বিষয়ভোগে মত্ত মানবের মনে শ্রীভগবানের অপার লীলা শ্রবনের পর শুদ্ধ ভক্তি জন্মাবে এবং সে ভগবানের শ্রীচরণে মনোনিবেশ করবে। ভগবান গোবিন্দের নিত্য অষ্টকালীন লীলা গুলি হল – ‘নিশান্ত’, ‘প্রাতঃ’, ‘পূর্বাহ্ণ’, ‘মধ্যাহ্ন’, ‘অপরাহ্ণ’, ‘সায়াহ্ন’, ‘প্রদোষ’ ও ‘নক্ত’। এই লীলাগুলির মধ্যে একটি ‘দিব্যলীলা’ হল ‘ঝুলন যাত্রা’। ঝুলন শব্দের সাথে ‘দোলনা’ শব্দটিই ফুটে ওঠে। ভগবান মধুসূদনের এই দিব্যলীলার কথা স্মরণ করে ভক্তেরা তাই শ্রীরাধামাধব সুন্দরকে দোলনা তে বসিয়ে পূজো করেন। ভক্তের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় শ্রীভগবানের ঝুলন লীলার অপূর্ব সঙ্গীত –
“গগনে কৃষ্ণ মেঘ দোলে –
কিশোর কৃষ্ণ দোলে বৃন্দাবনে।
থির সৌদামিনী রাধিকা দোলে নবীন
ঘনশ্যাম সনে।।
দোলে রাধা শ্যাম ঝুলন-দোলায়
দোলে আজি শাওনে।।
পরি’ ধানি রঙ ঘাঘরি, মেঘ রঙ ওড়না
গাহে গান, দেয় দোল গোপীকা চল-চরণা,
ময়ূর নাচে পেখম খুলি’ বন-ভবনে।।
গুরু গম্ভীর মেঘ-মৃদঙ্গ বাজে আঁধার
অশ্রুর তলে,হেরিছে র্রজের রসলীলা অরুন লুকায়ে মেঘ-কোলে।
মুঠি মুঠি বৃষ্টির ফুল ছুঁড়ে হাসে
দেব-কুমারীরা হেরে অদূর আকাশে,
জড়াজড়ি করি’ নাচে, তরুলতা উতলা পবনে।।”
‘ঝুলন পূর্ণিমা’ হল শ্রীকৃষ্ণের অনুগামীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। ‘অমাবস্যায় পরের একাদশী’ থেকে আরম্ভ করে ‘শ্রাবনী পূর্ণিমা’ পর্যন্ত চলে উৎসবের সমারোহ। এটি দোল পূর্ণিমার পরবর্তী বৈষ্ণবদের বড়ো উৎসব। ‘দোলনা সাজানো’, ‘ভক্তিমূলক গান’, ‘নাচ’, সব মিলিয়ে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার এটি একটি বিশেষ উৎসব। ভারতের এই উৎসবে গত বছর পর্যন্ত দেশ-বিদেশ থেকে বহু দর্শনার্থীদের আগমন ঘটত – এবছর সেটা সম্ভব নয় ‘অতিমারীর কারণে’।
‘নবদ্বীপে’ ঝুলন উৎসব একটি বিশেষ আকর্ষণ। ‘বৃন্দাবন’, ‘মথুরা’ আর ‘ইসকন’ মন্দিরে মহা সমারোহে পালিত হত এই ঝুলন। এই বছরও হবে – কিন্তু সেই উন্মাদনা থাকবে না। এই উৎসব সাধারণত শ্রাবণ মাসেই হয়ে থাকে। ঝুলনযাত্রা বা লীলা – ‘বর্ষার লীলা’। ঝুলন পূর্ণিমাকে ‘শ্রাবণী পূর্ণিমা’ও বলা হয়। পৌরাণিক মতে বৃন্দাবনে রাধা-কৃষ্ণর প্রেমলীলাকে কেন্দ্র করে দ্বাপরযুগে এই ঝুলন উৎসবের সূচনা হয়েছিল।
শ্রাবণ মাসের প্রতিপদ তিথি থেকে আবম্ভ হয়ে পূর্ণিমা তিথি পর্যন্ত পাঁচ-দিন ব্যাপী এই অনুষ্ঠানটি উদযাপন করা হয়। ‘রাখি পূর্ণিমা’র মাধ্যমে ঝুলন যাত্রার সমাপ্তি ঘটে।
শ্রীকৃষ্ণের দ্বাদশ যাত্রার কথা শাস্ত্রে উল্লেখ আছে, কিন্তু আমরা সবগুলো পালন করি না। কিছু কিছু বিশেষ উল্লেখযোগ্য যাত্রানুষ্ঠান নিয়মিতভাবেই অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়, যেমন- ‘রথযাত্রা’, ‘রাসযাত্রা’, ‘দোলযাত্রা’, ‘স্নানযাত্রা’, ‘ঝুলনযাত্রা’ ইত্যাদি। শাস্ত্রকাররা এসব যাত্রাগুলোকে বিশেষ ‘তাৎপর্যমন্ডিত’ ও ‘তত্বসমৃদ্ধ’ বলে উল্লেখ করেছেন। অনাদি কাল থেকেই শ্রীকৃষ্ণ বিগ্রহ রূপে মন্দিরে দেবালয়ে, ভক্তের গৃহে স্থায়ীভাবে পূজিত হয়ে আসছেন। রাধা কৃষ্ণের বিগ্রহ দোলনা বা ঝুলনায় স্থাপন করে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে দোলান হয়। এখানে প্রতীকী হিসেবে শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন – ‘পরা প্রকৃতি’ বা ‘পুরুষোত্তম’ আর রাধারাণী হচ্ছেন – ‘অপরা প্রকৃতি’ বা ‘ভক্ত স্বরূপিনী’। সুক্ষ্ম অর্থে ভক্ত ভগবানের খেলা। প্রশ্ন জাগতে পারে দোলায় রাধা গোবিন্দের বিগ্রহ স্থাপন করে পূর্ব-পশ্চিম দিক দিয়ে ঝোলানোর তাৎপর্য কী? এ বিষয়ে, ‘শাস্ত্রীয়’, ‘ভৌগোলিক’ ও ‘বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা’ও রয়েছে। এই অনুষ্ঠানে দোলনাটি দোলানো হয় পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে। সূর্যের উদয় অস্ত ও অবস্থানের দিক নির্দিষ্ট করেই তা করা হয়। সূর্য হচ্ছে পৃথিবীতে সর্ব প্রকার শক্তির উৎস। আর পৃথিবীর গতি হচ্ছে – দু’টো, ‘আহ্নিকগতি’ ও ‘বার্ষিক গতি’। দুই গতিধারায় বছরে দু-বার ‘কর্কটক্রান্তি’ ও ‘মকরক্রান্তি’ রেখায় গিয়ে অবস্থান করে। তখন ঘটে সূর্যের ‘উত্তরায়ন’ ও ‘দক্ষিণায়ন’ অবস্থান। সেই কারণেই শ্রীকৃষ্ণের দোলযাত্রা অনুষ্ঠানে দোলনাটিকে ঝোলানো হয় উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে।
যাত্রা বলতে আমরা কি বুঝি? যাত্রার অর্থ হল কোনো লক্ষ্যবস্তুকে বা উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কোনো নির্দিষ্ট স্থান থেকে নির্ধারিত পথে অভিষ্ট স্থানে পৌঁছে যাওয়া। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ‘দ্বাদশ যাত্রা’র কথা শাস্ত্রে উল্লেখ আছে, তারমধ্যে বিশেষ কিছু হল ‘রথযাত্রা’, ‘রাসযাত্রা’, ‘দোলযাত্রা’, ‘স্নানযাত্রা’, ‘ঝুলনযাত্রা’ ইত্যাদি।
ঝুলনযাত্রা বহুযুগ আগে থেকে ব্রজভূমি বৃন্দাবনে মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে, শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীরাধিকা তাঁদের ‘অষ্টসখী’ – ‘ইন্দুরেখা’, ‘চিত্রা’, ‘চম্পকলতা’, ‘ললিতা’, ‘বিশাখা’, ‘তুঙ্গবিদ্যা’, ‘সুদেবী’ এবং ‘রঙ্গদেবী’র সাথে লীলা করেছিলেন ঐ দিনে। ঝুলনের অপর নাম ‘হিন্দোলনলীলা’। ব্রজবাসীরা এই সময় কদমগাছে ঝুলা (দোলনা) বেঁধে রাধাকৃষ্ণকে দোল খাওয়ান।
রাধা কৃষ্ণের ঝুলনযাত্রা অনুষ্ঠানটি কবে কোনো সময়ে সর্ব প্রথম আরম্ভ করা হয়েছিল, সেটা জানা নেই,তবে শাস্ত্র ধারণা মতে, এ অনুষ্ঠানটি খুব সম্ভবতঃ খ্রীস্টপূর্ব ‘এগারো দশকে’ দ্বাপর যুগে আরম্ভ হয়েছিল, গোপালকে দোলনায় তুলে মা যশোদা ঝোলাতেন। পরবর্তীতে কৃষ্ণের সঙ্গী সাথীরা গরু চরানোর সময় জঙ্গলের বড় বড় গাছের ডাল থেকে ঝুলানো ঝুলনায় কৃষ্ণকে বসিয়ে খেলা করতেন। আবার কখনো কৃষ্ণকে নিয়ে গোপ সখা সখিরা সুন্দর সুন্দর ফুল পুষ্পমালা দিয়ে দোলনা সাজিয়ে ঝুলনার আনন্দ উপভোগ করতেন।
শাস্ত্র মতে ‘রাধা’ হচ্ছেন ‘কৃষ্ণের হলাদিনী শক্তি মহামায়া’। রাধা হচ্ছেন ‘কৃষ্ণ ভক্ত শিরোমনি’। কৃষ্ণ শক্তিতে, কৃষ্ণপ্রেমে তিনি আরাধিতা ও বলিয়ান তাই তো তিনি রাধা। তাকে বলা হয় জীবজগতের প্রতীকী স্বত্বা, কৃষ্ণ ভক্তের আরাধ্য দেবী। শ্রীকৃষ্ণের প্রেমভক্তিতে তিনি বলিয়ান তাই রাধা রানীর কৃপা হলে অতি সহজেই কৃষ্ণ কৃপা হয়। আবার রাধা শক্তিতে কৃষ্ণ শক্তিশালী তাই তো তাঁরা উভয় মিলে এক ও অভিন্ন।
রাজাও নেই রাজত্বও গিয়েছে। তবু ফিকে ঝাড়বাতিতে টিমটিমিয়ে ঝুলন সাজাচ্ছে রাজবাড়ির মন্দিরগুলি।
এখনও শহরের ‘জহুরিপট্টি’তে ‘বর্ধমান রাজবাড়ির লক্ষীনারায়ণ জিউ মন্দির’, ‘নতুনগঞ্জের রাধাবল্লভ জিউ মন্দির’ কিংবা ‘শ্যামসুন্দর মন্দির’ পাঁচ দিনের ঝুলনযাত্রার আয়োজন করে। পূজো, আরতির পাশাপাশি কোথাও বাউল গান কোথাও লোকসঙ্গীত কোথাও আবার রামায়নী গানের আসর বসে। তবে উদ্যোক্তা এবং অর্থের অভাবে রাতভর ব্যাপী যাত্রা, পালাগানের আসর কিংবা তরজা গানের আসর বসাতে পারে না মন্দির কমিটিগুলি। পুরনো দিনের স্মৃতিচারণাই তখন ভরসা তাঁদের।
জানা যায় যে, আগে লক্ষীনারায়ণ জিউ মন্দিরকে সাতটি কাঠরায় (খুপরি) ভাগ করে কোনওটিতে কৃষ্ণ পদসেবা চিত্র, কোনওটিতে নৌকোবিলাস, কালিয়াদমন, নরনারী কুঞ্জ ইত্যাদি সাজানো হত। বাহারি সাজে রাধাকৃষ্ণের মূর্তির সঙ্গে বিদ্যুতের রোশনাইয়ের খেলায় জমকালো ছিল ঝুলনের সেই সন্ধ্যাগুলি। রাতের দিকে বসতো কবিগান, তরজা গানের আসর। অ্যামেচার পার্টির যাত্রাও হতো। এখন অবশ্য সেই জৌলুসের কিছুই অবশিষ্ট নেই। তখন রাজকোষ থেকে বর্ধমানের ছোটো রাজকুমার লক্ষাধিক টাকা খরচ বাবদ দিতেন। এখন পাঁচ দিনের বরাদ্দ কমে দাঁড়িয়েছে দশ হাজারে। তবু তার মধ্যেই পূজার্চনা সেরে মন্দির কমিটি এক দিন কীর্তন ও বাউল গানের আসর বসানোর চেষ্টা করতেন গত বছর পর্যন্ত।
এখানেই একসময় গান গেয়ে গিয়েছেন কামারকুণ্ডুর বিখ্যাত কীর্তনীয়া জুড়ি ‘সতীশ মান্না ও জবারানি’ কিংবা সিঙ্গুরের ‘নিতাইদাস বাউল’। এখন অবশ্য স্থানীয় শিল্পীরাই ভরসা। এমনকী আশপাশের জেলা থেকে নামী বাউল শিল্পীদের আনারও সামর্থ্য থাকে না সবসময়। বদল এসেছে ঝুলনের ভোগেও। আগে কীর্তন শেষে প্রতিদিনই রাজবাড়ির রসুই ঘরে লুচি, আলুর দম, কালিয়া এবং পোলাও খাওয়ানো হতো। এখন সেখানে ভক্তদের কপালে জোটে লুচি-সুজি। তবে নিয়ম মেনে ঝুলন চতুর্দশীতে ক্ষত্রিয় রাজাদের বংশানুক্রমিক ‘মহনদা পূজা’ বা ‘চন্ডীকাপূজা’ হয় এখনও। তবে রাজ পরিবারের কেউ আর আসেন না। কেবল রাজ কোষাগার থেকে আসে কিছু ‘তংকা’।
নতুনগঞ্জের রাধাবল্লভ মন্দিরের জৌলুসও আগের মতো নেই আর। এখন নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর সংসারে নিয়মনিষ্ঠা করে ঝুলন সাজানো হয়। প্রতিদিনই সন্ধ্যায় পালা কীর্তনও হয়। এমনকী ঝুলনে পাঁচ দিনের একদিন ‘রাইরাজাও’ সাজানো হয়। শ্যামসুন্দর মন্দিরেও ঝুলনের সময় প্রতিদিন নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও গান হয়। রাজগঞ্জের মোহন্তস্থলেও এখন নামে মাত্র ঝুলনযাত্রা হয়। অথচ এক কালে রাজাদের মোহন্ত বা পুরোহিতেরা বিশাল জাঁকজমক করে ঝুলন উৎসব করতেন সেখানে। এখন ঝুলন এলেই ছোটদের সেই সব ইতিহাস শোনাতে বলেন মোহান্তেরা।
অথচ কি দিন ছিল অতীতে!!!
সদর দরজাতে সাদা কাগজে আলতা দিয়ে লেখা থাকত ‘ঝুলন দেখে যান’, ‘পয়সা দিয়ে যান’– ইত্যাদি স্লোগান। দেখে তো ঠাকুরদাদের চোখ কপালে উঠত। এ কী ছেলেখেলা? ঠাকুমারা গলা উঁচিয়ে পাল্টা দিতেন, খেলাই তো! তোমাদের কেষ্ট যদি … ময়দানে নামতেন মায়েরা। মানে মধ্যস্থতা করতেন। ঠাকুরদা-ঠাকুমা দ্বৈরথ থামত। মায়ের সংসারে টান পড়ত। কড়াইয়ের চার ধারে মাটি দিয়ে পুকুর বানানো হত। তাতে ভাসিয়ে দেওয়া হত মাজনে পাওয়া হাঁস। তুলসীতলার মাটিতে ঠাকুরদার পুরনো ধুতির টুকরো মাখিয়ে উল্টো আনাজের ঝুড়িতে ফেলে পাহাড় তৈরি করা হত। দোলের মেলা থেকে নানা পুতুল কেনা হত। সেই সৈন্য, দইওলা, ধানঝাড়ায় ব্যস্ত কৃষককৃষানি, পুকুরে জল আনতে যাওয়া বউ, ইত্যাদি দিয়ে সাদৃশ্যহীন এক মঞ্চ তৈরি করা হত। মাঝে দোলা খেতেন রাধাকৃষ্ণ। সন্ধ্যাবেলায় পাশের বাড়ির পুরুতদাদা আসতেন পুজো করতে। বাড়ির মা-কাকিমারা আনতেন লুচি-আলুভাজা আর পান্তুয়া। যাঁরা ঝুলন দেখে দক্ষিণা দিতেন তাঁদেরও ডাকা হত। প্রসাদ পেতেন সকলে। বসত বিনোদনের আসর। ঝুলনের গান, কবিতার সঙ্গে পরিবারের ছোটকা গান ধরতেন “দোলে দোদুল দোলে ঝুলনা”। সেই সময়ের হিট গান। বাড়ির ঠাকুমার কণ্ঠে শোনা যেত চণ্ডীদাস –
“সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম
কানের ভিতর দিয়ে মরমে পশিল গো
আকুল করিল মোর প্রাণ।”
কেউ হয়তো ধরতেন,
“গগনে কৃষ্ণ মেঘ দোলে
কিশোর কৃষ্ণ দোলে বৃন্দাবনে।
থির সৌদামিনী রাধিকা দোলে নবীন
ঘনশ্যাম সনে।।
দোলে রাধা শ্যাম ঝুলন-দোলায়
দোলে আজি শাওনে।। …”
এই রোম্যান্টিক গীতিকবিতা বাস্তবিকই অন্তরে ঢেউ তোলে। দুলে ওঠে হৃদিযমুনা, ব্যাকুল হয় প্রাণপাখি। স্বর্গের প্রেম নেমে আসে মর্ত্যে। দৈবপ্রেম মানবপ্রেমের মহিমা লাভ করে ধন্য হয়।
বৈষ্ণবদের অবশ্য পালনীয় অনুষ্ঠান হল শ্রীরাধাকৃষ্ণের ঝুলনযাত্রা। ‘বৃষভানুর কন্যা’, ‘আয়ান ঘোষের পত্নী’ রাধা। মহাভারতে আমরা শ্রীকৃষ্ণের জীবন ও কার্যকলাপের বিশদ বিবরণ পাই। কিন্তু সেখানে রাধা অনুপস্থিত। রাধা নামে কোনও চরিত্রের দেখা পাই না। এমনকি শ্রীমদ্ভাগবতেও রাধার কোনও উল্লেখ পাই না। সেখানে শুধু পাই কৃষ্ণের এক প্রেমিকা-সখীকে। পরবর্তী কালে ‘ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে’, ‘দেবী ভাগবত’, ‘পদ্মপুরাণে’ রাধা আসেন। সে সব জায়গায় রাধার নানা রূপ। কিন্তু ‘রাধা’ কী? ‘রা’ অর্থে লাভ করা আর ‘ধা’ অর্থে ধাবমান হওয়া, শ্রীহরির দিকে ধাবমান হওয়া। ‘ভক্তির’ সাহায্যে ভগবানের সান্নিধ্য পাওয়া। এই আধ্যাত্মিক চেতনা বৈষ্ণব কবিদের কাব্যমহিমায় শেষ পর্যন্ত মানবী-প্রেমের দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে। রাধা-কৃষ্ণের প্রেম মানবিক সম্পদের রূপ নেয়। বিশেষ করে বাঙালির জনজীবনে ও সমাজচেতনায় ব্যাপক প্রভাব ফেলে। কালক্রমে বৈষ্ণবদের একটি অনুষ্ঠান বাংলার লোকপার্বণে পরিণত হয়।
রাধা-কৃষ্ণের বিগ্রহ দোলায় স্থাপন করে দোল দেওয়া এই অনুষ্ঠানের প্রধান অঙ্গ। তখন এই উৎসব শুধু রাধা-কৃষ্ণের মন্দিরে নয়, পাড়ায় পাড়ায় ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরাও এতে মেতে উঠত। এই ঝুলনে ছোটোরা রাধাকৃষ্ণকে ঘিরে নানা ধরনের পুতুল দিয়ে দৃশ্য তুলে ধরত। দোলনায় দুলতেন দেবতা। ছোটোদের হাতের ছোটো টানে দোল খেতেন রাধাকৃষ্ণ। রাতে জম্পেশ খাওয়াদাওয়া। এক সময় পাড়ার বাড়িতে বাড়িতে ঝুলন হত। যেন এক প্রতিযোগিতার হাট।
কোথাও কোথাও তেরো দিন ব্যাপী এই যাত্রা-উৎসব চলত। উত্তরপ্রদেশের ‘মথুরা’, ‘বৃন্দাবন’ এবং পশ্চিমবঙ্গের ‘শান্তিপুর’ ও ‘মায়াপুরের’ ঝুলনযাত্রা বিখ্যাত। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু ভক্ত গত বছর পর্যন্ত ভিড় জমাতেন মন্দিরে মন্দিরে। পূজার বেদী থেকে তুলে আনা হয় রাধাকৃষ্ণকে। সোনার কিংবা রুপোর দোলায় দুলতে থাকেন দেবতা। সে এক মনোরম দৃশ্য। নিত্যনতুন পোশাক আর ফুলে ফুলে সেজে ওঠে দোলা। রকমারি ভোগ দেওয়া হয় দেবতাকে। পরে তা ভক্তদের বিতরণ করা হত। শ্রীকৃষ্ণের শতনাম, কীর্তন, ভজন ও আরতি হয় দিনরাত।
‘আমেদাবাদের কৃষ্ণ মন্দির’, ‘বেঙ্গালুরুর হরেকৃষ্ণ হিল ও বৈকুণ্ঠ হিল’, ‘ভুবনেশ্বরে কাঠিয়াবাবার আশ্রম’, ‘বৃন্দাবনের বাঁকেবিহারী’, ‘মথুরার দ্বারকাধীশ মন্দিরে’ও জাঁকজমক সহকারে ঝুলন উৎসব পালিত হয়। নদীয়া জেলার পালপাড়াস্থিত ‘শ্রী মহেশ পণ্ডিতের বাড়ি’, ‘শ্রীপাট’, শান্তিপুরে শ্রীরাধাকৃষ্ণ মন্দিরে ঝুলনযাত্রা পালিত হয়। শ্রীধাম পুরীতে দশমী থেকে সপ্তাহব্যাপী ঝুলন উৎসব ও মেলা বসত। এ ছাড়াও ঝুলন হয় ‘বরাহনগরে শ্রীপাঠবাড়ি আশ্রম’, ‘হাওড়া শিবপুরে বঙ্গীয় নিম্বারক আশ্রম’, ‘সুখচরের শ্রীরাধামা গোপালজি মন্দির’, ‘বেলুড় রাসবাড়ি’, ‘টালিগঞ্জের বড় রাসবাড়ি’, ‘রাসবিহারীর রাধাকৃষ্ণ মন্দির’ ও ‘শীলপাড়ার ভজনাশ্রমে’। ঝুলনযাত্রার শেষ রাখিপূর্ণিমায়।
কলকাতার ঝুলন প্রসঙ্গে ‘ঝুলনবাড়ি’-র কথা বিশেষ উল্লেখ্য। এই নামেই পরিচিত ‘বউবাজারের রামকানাই অধিকারী’র বাড়ি। প্রায় ২০০ বছর আগে এই পরিবারের আদিপুরুষ ‘কৃষ্ণমোহন অধিকারী’ ঝুলন উৎসবের প্রচলন করেন। পরে তাঁর পৌত্র ‘রামকানাই অধিকারী’ সাড়ম্বরে এই উৎসবের প্রচলন করেছিলেন। এই বাড়ির রাধাবল্লভ জিউর ঝুলন উৎসব আজও বহু মানুষকে আকৃষ্ট করে। এ বাড়িতে এই ঝুলন উৎসব হয় পাঁচ দিন ধরে। আর তাই এই পাঁচ দিনে দেবতাকে বিভিন্ন বেশে সাজানো হয়। প্রথম দিন ‘রাখাল বেশ’, দ্বিতীয় দিন ‘যোগী বেশ’, তৃতীয় দিনে ‘সুবল বেশ’, চতুর্থ দিনে হয় ‘কোটাল বেশ’ এবং শেষ দিনে ‘রাজ বেশ’। প্রথম দিনে হোম করে ঝুলন উৎসবের সূচনা করা হয়। এর পরে দেবতাকে এক এক দিন এক এক রকমের ভোগ নিবেদন করা হয়। পুরনো ঐতিহ্য বজায় রেখে গত বছর পর্যন্ত পাঁচ দিনের এই উৎসবে আত্মীয় সমাগম হত। এই পরিবারে ঝুলন উৎসবের আরও এক আকর্ষণ ছিল ধ্রুপদী সঙ্গীতের আসর। ‘রামকানাই’ নিজে ভাল পাখোয়াজ বাজাতেন, এমনকী, তিনি যদুভট্টের সঙ্গে সঙ্গত করতেন। ‘যদুভট্ট’ ছাড়াও আসরে এক কালে আসতেন ‘অঘোরনাথ চক্রবর্তী’, ‘রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামী’ প্রমুখ শিল্পী। পরবর্তী কালে আসতেন ‘জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ’, ‘ভিজি যোগ’, ‘মালবিকা কানন’, ‘এটি কানন’, ‘হীরু গঙ্গোপাধ্যায়’ প্রমুখ শিল্পী। গত বছর পর্যন্ত বসেছিল এই আসর – এবছর সবই অতীত।
চালতাবাগান অঞ্চলে বিনোদ সাহা লেনে বঙ্কুবিহারী সাহা প্রতিষ্ঠিত রাধাকৃষ্ণের ঝুলন মন্দিরে ঝুলনযাত্রা উপলক্ষে বিশেষ পুজো হয়ে থাকে। এই উপলক্ষে বিশেষ ভোগ নিবেদন করা হয়। মন্দির চত্বরে ছোট ছোট ঘরগুলির মধ্যে কৃষ্ণলীলা ও মহাভারতের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলি মাটির পুতুল দিয়ে সাজানো হয়। ওই একই রাস্তায় মণ্ডল পরিবারের রাধাকৃষ্ণ জিউর মন্দিরে ঝুলন হয়। একাদশী থেকে দ্বিতীয়া পর্যন্ত মোট সাত দিন ধরে চলে এই ঝুলন উৎসব। প্রথম দিন রাধাকৃষ্ণের ‘যুগল বেশ’, দ্বিতীয় দিনে ‘অনন্ত দর্শন’, তৃতীয় দিনে ‘রাসলীলা’, চতুর্থ দিনে ‘নৌকাবিলাস’, পঞ্চম দিনে ‘চন্দ্রাবলীকুঞ্জ’, ষষ্ঠ দিনে ‘রাইরাজা’ এবং সপ্তম দিনে ‘মিলন বেশ’। ঝুলন উপলক্ষে প্রতি দিন নিবেদন করা হয় লুচি, মালপোয়া, সুজি ইত্যাদি। ঝুলন উপলক্ষে ওই এলাকার আর এক আকর্ষণ ছিল জমজমাট মেলা। মেলা বসত বিনোদ সাহা লেনে এবং বিবেকানন্দ রোডের ফুটপাথের কিছুটা অংশ জুড়ে।
তেমনই দক্ষিণ কলকাতার টালিগঞ্জ রোডে বাওয়ালির মণ্ডল পরিবারের উদয়নারায়ণ মণ্ডল প্রতিষ্ঠিত মদনমোহন জিউর মন্দিরে, যা বড় রাসবাড়ি বলে পরিচিত, আজও পালিত হয় ঝুলন উৎসব। এখানে ঝুলন হয় তিন দিনব্যাপী। এই সময় প্রতি দিন ভোরে দেবতাকে ডাবের জল দিয়ে স্নান করানো হয় এবং প্রতি দিন নতুন ভাবে সাজানো হয়। ঝুলন উপলক্ষে হত নামসংকীর্তন। এই সময় প্রতি দিন ২৫-৩০ রকমের ফলের নৈবেদ্য, লুচি, সুজি নিবেদন করা হয়। অন্য দিকে, কুমোরটুলি অঞ্চলে গোকুলচন্দ্র মিত্র প্রতিষ্ঠিত রাধামদনমোহন জিউর মন্দিরে সাড়ম্বরে পালিত হয় ঝুলন উৎসব। এই উপলক্ষে বহু ভক্ত সমাগম হত।
তবে শুধু কলকাতাতেই নয়, মফসসলের বিভিন্ন মন্দিরেও চলে ঝুলন উৎসব। তার মধ্যে খড়দহের শ্যামসুন্দরের ঝুলন উৎসব এবং ইছাপুরের নবাবগঞ্জের ঝুলনের মেলায় আজও দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসেন। তেমনই নদিয়ার শান্তিপুরের বড়গোস্বামী বাড়িতে কয়েক’শো বছর ধরে সাড়ম্বরে হয়ে আসছে রাধারমন জিউর ঝুলনযাত্রা। উৎসব চলে তিন দিন ধরে। দেবতাকে পরানো হয় এক এক ধরনের বেশ। মূল পুজোটি হয় পূর্ণিমার দিনে। সে দিন উদয়াস্ত ভাগবত পাঠ হয়। এই উপলক্ষে অসংখ্য ভক্ত সমাগম হত। ঝুলন উপলক্ষে হয় বিশেষ অন্নভোগ। বড়গোস্বামী ছাড়াও ‘শ্যামচাঁদ মন্দির’, ‘গোকুলচাঁদ মন্দিরে’ এবং অন্যান্য বিগ্রহবাড়িতে এই উৎসব হয়ে থাকে। কিছু কিছু জায়গায় হয় পুতুল ঝুলন। এখানে নানা ধরনের পুতুল দিয়ে সাজানো হয়।
তবে নবদ্বীপের ঝুলনের আলাদা আকর্ষণ বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী মানুষের কাছে। এক দিকে যেমন কিছু পাড়ায় দেখা যায় সর্বজনীন ঝুলন উৎসব, অন্য দিকে পুরনো মঠে কিংবা মন্দিরে ঐতিহ্যশালী ঝুলন উৎসব। বেশ কিছু সর্বজনীন রাস উৎসবে দেখা যায় থিমের প্রাধান্য। তবে নবদ্বীপের পুরনো মঠে-মন্দিরে আজও মেলে সাবেক ঝুলনের আমেজটা। যেমন মহাপ্রভু মন্দিরে রাধাকৃষ্ণের ঝুলন নয়, হয় শ্রীচৈতন্যের ঝুলন উৎসব। উৎসব চলে এক পক্ষ কাল, প্রতিপদ থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত। তেমনই সমাজবাড়িতে বৃন্দাবনের গোস্বামী মতে তেরো দিন ধরে ঝুলন হয়। এ ছাড়াও ‘মোহন্তবাড়ি’, ‘রাধা মদনমোহন মন্দির’, ‘গোবিন্দবাড়ি’, ‘গোরাচাঁদের আখড়া’, ‘বলদেববাড়ি’ ইত্যাদি মঠ-মন্দিরে উৎসবের ভিন্ন ভিন্ন মেজাজ দেখা যায়।
মহিষাদল রাজবাড়ির দু’শো বছরের বেশি পুরনো ঝুলনযাত্রা উৎসব জৌলুস হারালেও রাজ ঐতিহ্যের রীতিনীতি আজও অটুট। রাজবাড়ির কুলদেবতা মদনগোপালজিউর রাধাকৃষ্ণের ঐতিহ্যবাহী ঝুলনযাত্রা দেখতে আজও দূরদূরান্তের মানুষ এসে ঝুলন পূর্ণিমায় ভিড় করতেন। এক সময় ঝুলনযাত্রাকে ঘিরে মেলা বসত। যাত্রা, কীর্তন, পালাগান হত কয়েকদিন ধরে। গ্রামগঞ্জের মানুষ আসতেন ঝুলনযাত্রা ও রাজবাড়ি দর্শনে। রাজবাড়ি সেজে উঠতো বাহারি আলোয়। সুসজ্জিত হয়ে মন্দিরে আসতেন রাজপরিবারের সদস্যরা। মন্দিরপ্রাঙ্গণে ঝুলন মন্দিরে আলাদা করে সাজানো হতো রাধাকৃষ্ণকে। রাজবাড়ির ঝুলনের সেই আড়ম্বর না থাকলেও এখনও ঐতিহ্য মেনেই পাঁচদিন ধরে মদনগোপালজিউর মন্দিরে ঝুলন উৎসব হয়। নিয়ম করেই সেই উৎসবে যোগ দেন রাজবাড়ির সদস্যরাও। দর্শনার্থীদের পূর্ণিমার দিন পোলাও ভোগ বিতরণ করা হয়। রাজপরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, ‘রানি জানকীদেবী’র সময়ে রাজবাড়িতে ঝুলন উৎসবের সূচনা হয়। রথযাত্রা, দুর্গাপুজো, রাস উৎসবের মতোই জানকীদেবী রাজবাড়িতে ধুমধামের সঙ্গে ঝুলনযাত্রারও প্রচলন করেন। রাজবাড়ির রথই বর্তমানে সর্বজনীন হয়ে গিয়ে মহিষাদলের রথ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। রথের পাশাপাশি পুরনো রাজবাড়ি অর্থাৎ রঙ্গিবসান প্যালেসের সামনে রাজারা দুর্গামণ্ডপ গড়ে তোলেন। বাংলার আটচালার আদলে সেখানে রয়েছে নাটমন্দির ও নহবতখানা। রাজবাড়ির বাইরে রয়েছে রাসমঞ্চ। সুদৃশ্য কারুকাজ করা ইটের তৈরি সেই রাসমঞ্চ কয়েক বছর আগে ভেঙে পড়েছে। একইভাবে ঝুলনের জন্য রাজবাড়ির মদনগোপালজিউর মূল মন্দিরে ঢোকার মুখে বাঁদিকে আলাদা ঝুলন মন্দির গড়ে তোলা হয়েছে। ২৫-৩০বছর আগেও ঝুলনযাত্রা উপলক্ষে রাজবাড়ির পাশে মেলা বসত। বহু জায়গা থেকে মানুষজন আসতেন। সন্ধ্যায় কীর্তনগান, রাধাকৃষ্ণের পালাগান হত। বাইরে থেকে কীর্তনীয়ারা আসতেন। এখন আগের মতো সেই ধুমধাম করে ঝুলনযাত্রা হয় না। তবে সমস্ত রীতিনীতি মানা হয়।
জিয়াগঞ্জের নেহালিয়া রায়বাহাদুর বাড়িতে পাঁচদিনব্যাপী ঐতিহ্যবাহী ঝুলন উৎসব হয়। রায়বাহাদুর বাড়ির ১৭৬ বছরের প্রাচীন এই ঝুলনকে কেন্দ্র করে রীতিমতো উৎসবে মেতে উঠতেন জিয়াগঞ্জ শহরবাসী। ঝুলন উৎসব উপলক্ষে নেহালিয়া রায়বাহাদুর বাড়ির সামনের মাঠে বসত ১৫ দিন ব্যাপী মেলা। জিয়াগঞ্জের নেহালিয়ার রায়বাহাদুর সুরেন্দ্রনারায়ণ সিংহের রায়বাহাদুরবাড়ির ঝুলন উৎসবের খ্যাতি মুর্শিদাবাদ জেলাজুড়ে। ১২৫০ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ১৭৬ বছর আগে রায়বাহাদুর সুরেন্দ্রনারায়ণ সিংহের পূর্বপুরুষ উদিতনারায়ণ সিংহ-র সময়ে রাধামোহন বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা হয়। রাধামোহন বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার বছর থেকেই ঝুলন উৎসবের প্রচলন হয়। রায়বাহাদুরবাড়ির মন্দিরে কষ্টিপাথরের কৃষ্ণ ও অষ্টধাতুর শ্রীরাধা রয়েছেন। রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি এখানে রাধামোহন নামে পরিচিত। সারাবছর রাধামোহন রুপোর গয়নায় সাজানো থাকলেও ঝুলন উৎসব ও জন্মাষ্টমী উৎসবে রাধামোহনকে সোনার গয়নায় সাজানো হয়। শ্রীরাধা ও কৃষ্ণের মাথার মুকুট, গলার মালা, হাতের বালা, কোমরের বিছে, পায়ের নূপুর, এবং কৃষ্ণের বাঁশি সমস্তই সোনার। আগে ঝুলন উৎসব উপলক্ষে মন্দিরের সামনে নাটমন্দিরে কলকাতার বিখ্যাত যাত্রাদলগুলি যাত্রাপালা মঞ্চস্থ করত। সেই যাত্রা দেখতে মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন এলাকার জমিদার ও রাজারাও রায়বাহাদুর বাড়িতে আসতেন। তবে, এখন কলকাতার যাত্রাদলগুলি না এলেও গতবছর পর্যন্ত ঝুলনের পাঁচদিন ধরে পুরনো ঐতিহ্য মেনে মন্দিরের সামনের নাটমন্দিরে স্থানীয় দলগুলি কৃষ্ণযাত্রা, কীর্তন ও বাউলগান করত। বাড়ির বাইরে মেলার সামনে মঞ্চে আলকাপ বা পঞ্চরস অনুষ্ঠিত হত। রায়বাহাদুর বাড়ির ঝুলন উৎসব একাদশী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত পাঁচদিন চললেও ঝুলন উপলক্ষে মেলা জন্মাষ্টমী অর্থাৎ দু’সপ্তাহব্যাপী চলত। ঝুলনের পাঁচদিন রাধামোহনকে রকমারি ভাজা, তরকারি, চাটনি, পায়েস সহ অন্নভোগ দেওয়া হয়।
এবছর হয়ত সমস্ত রীতিনীতি মেনে ঐতিহ্যবাহী জায়গাগুলোতে অনুষ্ঠিত হবে ঝুলন – কিন্তু থাকবেনা ভক্ত ও দর্শনার্থী সমাগম।
(তথ্যসূত্র:
১- Essential Hinduism by Steven J. Rosen, Praeger (২০০৬)।
২- Vaiṣṇavism: Its Philosophy, Theology, and Religious Discipline by S. M. Srinivasa Chari, Motilal Banarsidass (২০২৭)।
৩- উইকিপিডিয়া।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত