বগুড়া থেকে কলকাতার দূরত্ব প্রায় ১৯৯ মাইল। জেলার সদর শহর বগুড়া করতোয়া নদীর পশ্চিমতটে অবস্থিত। বগুড়া আধুনিক শহর, ইংরেজদের হাতে ১৮২১ সালে এই শহরের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল এবং তখন থেকেই এটি জেলার সদর শহর। বগুড়া জেলার অন্তর্গত ভাসুবিহার গ্রাম ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম শহীদ প্রফুল্ল চাকীর জন্মভূমি। প্রফুল্ল চাকীর জন্ম – ১২৯৫ বঙ্গাব্দের ২৭শে অগ্রহায়ণ, ইংরেজি ১০ই ডিসেম্বর ১৮৮৮ সাল। ইতিহাস বলে, প্রফুল্ল চাকীর জন্মের প্রায় দেড়শো বছর আগে সেই বারেন্দ্রভূমে আরেক প্রফুল্ল জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তাঁর নাম দেবী চৌধুরাণী ওরফে প্রফুল্লমুখী। বিহার বা ভাসুবিহার প্রফুল্ল চাকীর পূর্বপুরুষদের আদি বাসস্থান নয়। প্রফুল্ল চাকীর বৃদ্ধ পিতামহ প্রাণকৃষ্ণনারায়ণ চাকী পাবনা জেলার অন্তর্গত চাঁচকিয়া গ্রামে বাস করতেন। প্রাণকৃষ্ণ চাকী উত্তর বঙ্গের এক বিশিষ্ট কায়স্থ বংশের খ্যাতনামা শাক্ত পরিবারে জন্মেছিলেন। প্রাণকৃষ্ণের একমাত্র পুত্র মহেন্দ্রনারায়ণ পিতৃবিয়োগের পরে বগুড়ার অন্তর্গত মাদলা গ্রামে এসে বাস শুরু করেন। তাঁর তিন পুত্র ছিল – ইন্দ্রনারায়ণ, লক্ষ্মীনারায়ণ ও চন্দ্রনারায়ণ। চন্দ্রনারায়ণ প্রফুল্ল চাকীর পিতামহ। পিতৃবিয়োগের পরে চন্দ্রনারায়ণ পৈতৃক গ্রাম মাদলা পরিত্যাগ করে বিহার বা ভাসুবিহার গ্রামে এসে বাস শুরু করেছিলেন। চন্দ্রনারায়ণের একমাত্র পুত্র ছিলেন রাজনারায়ণ। রাজনারায়ণের দুই বিবাহ – প্রথম স্ত্রী বিবাহের কয়েক বছর পরেই নিঃসন্তান অবস্থায় গত হন, পরে তিনি পুনরায় বিয়ে করেন। রাজনারায়ণের চারপুত্র – প্রতাপচন্দ্র, জগৎনারায়ণ, চারুচন্দ্র ও প্রফুল্লচন্দ্র; দুই কন্যা – কুসুম কামিনী ও সৌদামিনী। প্রফুল্ল চাকী যে সময় জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সেই সময়ে চাকী পরিবারের অবস্থা বেশ ভালো। সুতরাং তাঁর জাতকর্মাদি বেশ সমারোহের সঙ্গে সম্পন্ন করা হয়েছিল, আর পরিবারের চার ভাইয়ের মধ্যে তিনি সর্বকনিষ্ঠ বলে তিনি পরিবারের আদরের ছিলেন। প্রফুল্ল চাকীর যখন মাত্র তিন বছর বয়স, তখন তাঁর পিতৃবিয়োগ ঘটে – ১২৯৮ বঙ্গাব্দে সন্ন্যাস রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর পিতা রাজনারায়ণ প্রয়াত হন। এরপরে সংসারের হাল ধরেন তাঁর বড় ভাই প্রতাপচন্দ্র। প্রফুল্ল চাকীর হাতে খড়ি হয় পাঁচ বছর বয়সে। বাড়িতে গুরু মশাইয়ের কাছে বর্ণপরিচয় শেষ হলে তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা প্রতাপচন্দ্র তাঁকে নামুজা জ্ঞানদাপ্রসাদ মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। প্রফুল্ল চাকী ক্লাসের ‘ফার্স্ট বয়’ ছিলেন না। দিনরাত বইপড়া তাঁর অভ্যাস ছিল না। স্কুলের পড়া রীতিমতো তৈরি করতেন মাত্র। বাকি সময় খেলাধুলা করতেন ও অন্যান্য ভালো বই পড়তেন। গ্রাম্য বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ হবার পরে তাঁকে রংপুর শহরের উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষা লাভের জন্য পাঠানো হয়। তখন তাঁর ১৪ বছর বয়স। এই রংপুরে পড়তে গিয়ে তাঁর জীবনের আরেক অধ্যায়ের শুরু হয়েছিল।
১লা সেপ্টেম্বর ১৯০৫ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা করে, বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হবার দিন ঘোষণা হয়েছিল ১৬ই অক্টোবর। বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে সারা বঙ্গদেশে ১৬ই অক্টোবর রাখীবন্ধন পালিত হয়। ১৭ই অক্টোবর কোন কোন জায়গায় ছাত্ররা উপবাস করে খালি পায়ে বিদ্যালয়ে আসেন – বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল ও রংপুর স্কুলের ছাত্ররা এই অপরাধে দণ্ডিত হয়েছিলেন। ওই দিন রংপুর জেলা স্কুলে প্রফুল্ল চাকী, পরেশ মৌলিক প্রমুখ কয়েকজন ছাত্র এইভাবে প্রতিবাদ করার জন্য শাস্তি পেয়েছিলেন। প্রফুল্ল চাকী, প্রফুল্ল চক্রবর্তী, সুরেশ চক্রবর্তী, নরেন্দ্রনাথ সেন, কৃষ্ণজীবন সান্যাল, নরেন বক্সী, পরেশ মৌলিক ছিলেন রংপুর জাতীয় বিদ্যালয়ের ছাত্র। বিক্রমপুরের মধ্যপাড়ার বিশিষ্ট শিক্ষাব্রতী দেশকর্মী অধ্যাপক নৃপেন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯০৫ সালে এই রংপুর জাতীয় বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, এটাই ছিল বাংলার প্রথম জাতীয় বিদ্যালয়। এরপরে ২২শে অক্টোবর ব্রিটিশ সরকার ‘কারলাইল সার্কুলার’ জারি করে, এই সার্কুলার অনুসারে ছাত্রদের কোন রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগদান নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এই সার্কুলারের প্রতিবাদে ছাত্ররা গড়ে তোলে ‘এন্টি সার্কুলার সোসাইটি’। এই সময়ে বিপ্লবী বারীন ঘোষ রংপুরে আসেন এবং প্রফুল্ল চাকীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎকার ঘটে।
১৯০৫ সালে বিখ্যাত বরিশাল প্রাদেশিক সম্মেলনের সময়ে তখনকার পূর্ববঙ্গের প্রথম ছোটলাট ব্যামফিল্ড ফুলার এক আদেশ জারি করেন যে, কেউ বরিশালের সদর রাস্তায় ‘বন্দেমাতরম’ স্লোগান দিতে পারবে না। লোকমুখে আরেকটা প্রচার হয়েছিল – কেউ বন্দেমাতরম স্লোগান দিলে তাঁকে গুলি করে মানা হবে। বরিশাল শহরে গোর্খা সৈন্য ও পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এই অন্যায় আদেশের প্রথম প্রতিবাদ করেন মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতা’র আঠারো বছর বয়সের পুত্র চিত্তরঞ্জন। চিত্তরঞ্জন ঠাকুরতা এন্টি সার্কুলার সোসাইটির সদস্য ছিলেন। তিনি প্রথম বরিশাল শহরের রাস্তায় প্রকাশ্যে বন্দেমাতরম ধ্বনি তোলেন। গোর্খা সৈন্যরা ও পুলিশ তাঁকে গুলি করেনি বটে, কিন্তু লাঠি দিয়ে মেরে মৃতপ্রায় করে ফেলা হয়েছিল, তাঁর জ্ঞানহীন দেহটাকে একটা পুকুরের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়। পরে জনরোষের কথা চিন্তা করে পুলিশের এক কনস্টেবল তাঁর দেহ পুকুর থেকে উদ্ধার করে পুকুর পাড়ে রেখে দিয়ে যায়। মানুষের মধ্যে আগে থেকেই ক্ষোভের আগুন ধিক ধিক করে জ্বলছিল, এই ঘটনায় সেই আগুনে ঘি পড়ে। বিপ্লবীরাও ব্যামফিল্ড ফুলারের উপরে পাল্টা প্রতিশোধ নেবার পথ খুঁজছিলেন। ততদিনে বারীন ঘোষের হাত ধরে প্রফুল্ল চাকীও নাম লিখিয়েছেন বিপ্লবী দলে। ব্যামফিল্ড ফুলারকে হত্যার উদ্দেশ্যে বারীন ঘোষ তাঁর এক সহকর্মীকে নিয়ে রংপুরে গিয়ে পৌঁছান। সেই সময়ে তাঁদের টাকার প্রয়োজন। ঠিক হয়, রংপুর থেকে ১২ মাইল দূরে একটা বাড়িতে স্বদেশী ডাকাতি করা হবে। কিন্তু এটা শেষ পর্যন্ত বাস্তবে পরিণত হতে পারেনি। প্রফুল্ল চাকীও এই ডাকাতির প্রচেষ্টায় অংশ নিয়েছিলেন। এটাই ছিল তৎকালীন বঙ্গদেশে সর্বপ্রথম ডাকাতির প্রচেষ্টা। অবশ্য ফুলার হত্যার চেষ্টা বন্ধ হয়নি। ফুলারকে বিপ্লবীরা নজরে রেখেছিলেন। ফুলার সাহেবের ধুবড়ী থেকে রংপুর আসার কথা ছিল। ধুবড়ীতে বিপ্লব দলের একজন সহযোদ্ধাকে পাঠানো হয়েছিল এজন্য যে, ছোটলাটের স্পেশ্যাল ট্রেন ধুবড়ী ছেড়ে রংপুরের দিকে রওনা হলে তিনি রংপুরে সাথেসাথে টেলিগ্রাম করে খবর দেবেন। ওদিকে ঠিক হয়েছিল যে, রংপুর স্টেশন থেকে মাইলখানেক দূরে একটা সুবিধামত জায়গায় লাইনের নীচে ব্যাটারী লাগিয়ে বোমা রেখে আসা হবে। সাথে প্রস্তুত রাখা হয়েছিল দ্বিতীয় পন্থা – কোন কারণে যদি বোমা না ফাটে, তাহলে স্টেশনের বিপরীত দিকে প্রফুল্ল চাকী ও অন্য একজন বিপ্লবী সাথে রিভলভার ও হাতে লাল লণ্ঠন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন। তাঁরা লণ্ঠনটা লাইনে রাখবেন, যাতে স্পেশ্যাল ট্রেনের ড্রাইভার বিপদ সঙ্কেত মনে করে ট্রেন দাঁড় করিয়ে দেয়, আর তারপরে তাঁরা লাটের কামরায় ঢুকে তাঁকে গুলি করে খুন করবেন। কিন্তু এই অভিযানও অসমাপ্ত রইল। কারণ, জানা গেল যে, লাটসাহেব রংপুরে আসবেন না, তিনি স্টিমার করে গোয়ালন্দ রওনা হয়ে গেছেন। এই খবর পাবার সঙ্গে সঙ্গে বারীন ঘোষের নির্দেশে একজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে প্রফুল্ল চাকী ছুটলেন গোয়ালন্দের দিকে। সেখানে পৌঁছে তাঁরা দেখলেন যে লাটসাহেব সেখান থেকে স্পেশ্যাল ট্রেনে কলকাতায় রওয়ানা হয়ে গিয়েছেন। তাঁরাও লাটসাহেবের পিছনে পিছনে চললেন – কিন্তু ফুলার বধ আর করা সম্ভব হলনা। যদিও এর কিছুদিনের মধ্যে ফুলার সাহেবের পতন ঘটে – তিনি পদত্যাগ করেন। বঙ্গভঙ্গ জনিত আন্দোলনের কারণে বন্দেমাতরম পত্রিকায় তাঁকে শায়েস্তা খাঁর সঙ্গে তুলনা করে প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল। আর ফুলার পদত্যাগ করার পরে ইংলিশম্যান পত্রিকা লিখেছিল, এটা বধ্যমঞ্চে হত্যার সামিল, আন্দোলনকারীদের ভয় প্রদর্শনের কাছে এটা আত্মসমর্পণ।
১৯০৭ সালে প্রফুল্ল চাকী কলকাতায় আসেন এবং মুরারীপুকুরে যুগান্তর দলের সাথে যুক্ত হন। ১৯০৭ সালের প্রথমদিকে রংপুর গুপ্ত সমিতির উপশাখার প্রতিনিধিরূপে প্রফুল্লচন্দ্র কলকাতা মূলকেন্দ্রের সভ্য নির্বাচিত হন। এই সময়েই উল্লাসকর দত্ত, উপেন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ বিপ্লবীদের সাথে তাঁর পরিচয় ঘটেছিল। ১৯০৭ সালে দুর্গাপূজার ঠিক আগে, বিপ্লবী চারু দত্ত যখন দার্জিলিংয়ে রয়েছেন, তখন সেখানে ছুটি কাটাতে এলেন বাংলার তৎকালীন ছোটলাট স্যার এন্ড্রু ফ্রেজার। সেখানে তাঁর বেশ কিছু অনুষ্ঠানে যোগ দেবার কথা ছিল। চারু দত্ত আগে থেকে খোঁজ নিয়ে রেখেছিলেন যে ফ্রেজার স্টেশনের কাছের গির্জায় প্রতি রবিবার সকালে প্রার্থণায় যোগ দিতে আসেন, তাঁর সঙ্গে মাত্র একজন দেহরক্ষী থাকে। ইতিমধ্যে বারীন ঘোষের কাছ থেকে ফ্রেজার হত্যার জন্য বোমা এসে পৌঁছেছিল আর এক কাজকে রূপ দেবার জন্য প্রফুল্ল চাকীও দার্জিলিংয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন। চারু দত্ত ও প্রফুল্ল চাকী মিলে স্থির করেন, গির্জায় যাবার পথে ফ্রেজারের গাড়ির উপরে বোমা ছোঁড়া হবে। দুজনের স্থির বিশ্বাস ছিল যে এই অভিযান সফল হবে। কিন্তু ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের এই অভিযানের আগাম খবর পৌঁছে যায়, এবং ফ্রেজার নির্ধারিত রাস্তার পরিবর্তে হিলকার্ট রোড দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে গির্জায় উপস্থিত হন। গির্জাতেও আগাম পুলিশি পাহারার বন্দোবস্ত ছিল। এক ঘন্টা ধরে নির্ধারিত পথের ধারে অপেক্ষা করে শেষে হতাশ হয়ে প্রফুল্ল চাকী ফিরে আসেন। ফ্রেজার হত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপরে আবার ফ্রেজার হত্যার চেষ্টা হয়, দায়িত্বে সেই প্রফুল্ল চাকী, স্থান সেই দার্জিলিং। ঠিক পরের সপ্তাহে গভর্নর ইলেভেনের সঙ্গে কোচবিহার টিমের একটা ক্রিকেট ম্যাচ ছিল। জানা গিয়েছিল ফ্রেজার সেই খেলা দেখতে আসবেন। ঠিক হয়েছিল, ছোটলাটের ঠিক পিছনে যেখানে দর্শকদের ভিড় থাকবে সেখানে চারু দত্ত ও প্রফুল্ল চাকী থাকবেন, চারু দত্ত ইঙ্গিত করলে প্রফুল্ল বোমা ছুঁড়বেন। কিন্তু ফ্রেজার এবারেও এলেন না। হতাশ প্রফুল্ল পরের দিন কলকাতায় ফিরে চলে এলেন।
এরপরে প্রফুল্ল চাকীকে অন্য কয়েকজন বিপ্লবীর সাথে বাঁকুড়ায় একটা ডাকাতি করার জন্য পাঠানো হয়েছিল। সেটাও শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়। ১৯০৭ সালের অক্টোবর মাসে আবার ছোটলাট এন্ড্রু ফ্রেজারের ট্রেন ধ্বংস করে তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। বারীন্দ্র ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত, প্রফুল্ল চাকী ও বিভূতি সরকার এরজন্য চন্দননগরে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের সেই চেষ্টা সফল হয়নি। এরপরে নারায়ণগড়ে ছোটলাটের ট্রেন ধ্বংস করার দ্বিতীয় চেষ্টা হয় ১৯০৭ সালের ডিসেম্বর মাসে। স্থান নির্বাচনের জন্য প্রথমে পাঠানো হয়েছিল হরিশ ঘোষ ও শান্তি ঘোষকে, কিন্তু তাঁরা স্থান নির্বাচন ভালোভাবে করতে পারেননি বলে প্রফুল্ল চাকী ও বিভূতি সরকারকে পাঠানো হয়। নারায়ণগড় ও বেনাপুর স্টেশনের মাঝে একটা জায়গা তাঁরা মাইন বসানোর জন্য ঠিক করেন। ৬ই ডিসেম্বর রাত্রে তাঁদের পূর্ব-নির্বাচিত জায়গায় ছোটলাটের ট্রেন ধ্বংস করার জন্য প্রায় একফুট গর্ত করে বারীন ঘোষ, প্রফুল্ল চাকী ও বিভূতি সরকার মাইন পুঁতে রাখেন। মাইনটা ছয় পাউন্ড ডিনামাইট দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল, ফিউজ রেললাইনের উপরে রেখে একটা সুতোর সঙ্গে পাথরের ঢিল বেঁধে দেওয়া হয়েছিল যেন সেটা হওয়ায় উড়ে না যায়। কিন্তু প্রফুল্ল চাকীর এই অভিযানও সম্পূর্ণ সফল হলনা। বোমা ফাটল, রেললাইন বেঁকে ভেঙে গেল, কিন্তু গাড়ি উড়ল না। তবে ইঞ্জিনখানা জখম হল, খড়গপুর স্টেশন থেকে আরেকটা ইঞ্জিন এনে রেললাইন ঠিক করে লাটসাহেবের ট্রেন নিয়ে যাওয়া হল।
ব্যার্থতার পরে ব্যর্থতা। কিন্তু পরপর এতগুলো ব্যর্থতা সত্বেও কিন্তু বিপ্লবী নেতৃত্ব প্রফুল্ল চাকীর উপরে বিশ্বাস হারাননি। তাঁর মূল কারণ এতগুলো ব্যর্থতা সত্বেও প্রফুল্ল চাকীর ধৈর্য্য ও দৃঢ়তা, সাথে অবশ্যই তাঁর অভিজ্ঞতা। এরপরেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যার। দায়িত্ব দেওয়া হয়, প্রফুল্ল চাকী ও একজন যুবককে যিনি মাত্র বারো বছর বয়স থেকে ‘সাহেব মারতে’ ব্যগ্র ছিলেন – তাঁর নাম ক্ষুদিরাম বসু। কিংসফোর্ড হত্যার আদেশ পালন করার জন্য কলকাতার ১৫নং গোপীমোহন দত্ত লেনের বাড়ি থেকে বোমা ও পিস্তল সমেত মজঃফরপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন প্রফুল্ল চাকী। বোমা বানিয়ে দিয়েছিলেন হেমচন্দ্র দাস ও উল্লাসকর দত্ত। হাওড়া স্টেশনে মিলিত হন এমন দু’জন তরুণ, যাঁরা একে অপরকে চিনতেন না, এমনকি নামও জানতেন না। তারপরে তাঁরা ট্রেনে করে রওয়ানা দেন মজঃফরপুরের উদ্দেশ্যে। এরপরের ঘটনা সকলেরই আজ জানা।
(তথ্যসূত্র:
১- অগ্নিযুগের প্রথম শহীদ প্রফুল্ল চাকী, হেমন্ত চাকী।
২- প্রফুল্ল চাকী, জলধর মল্লিক, গ্রন্থতীর্থ।
৩- শ্রী অরবিন্দ ও বাঙ্গলায় স্বদেশী যুগ, গিরিজাশঙ্কর রায়চৌধুরী, অরুণা প্রকাশন।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত