উৎপল দত্তের বর্ণময় প্রতিভার বহুকৌণিক আলোকবিচ্ছুরণ নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। নাট্যকার, পরিচালক, অভিনেতা, তাত্ত্বিক আচার্য— এই চতুর্মুখ ব্রহ্মার মতো উৎপল তাঁর সৃজনে বারবার সৃষ্টিকর্তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে গেছেন। বিশ্ববিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব রিচার্ড শেখ্নার সম্পাদিত পত্রিকা ‘দ্য ড্রামা রিভিউ’ (টিডিআর) পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ তিনজন নাট্যপরিচালকের মধ্যে উৎপলকে অন্যতম বলে মান্যতা দিয়েছিল। যদিও রিচার্ড শেখ্নারের বিতর্কিত মার্কিন ‘লিভিং থিয়েটার’কে উৎপল ‘অপসংস্কৃতির কবরখানা’ বলে তুলোধনা করেছেন। বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস বিচার করলে উৎপলের নাট্যসৃষ্টির ব্যাপ্তি ও ঐশ্বর্য বিস্ময়কর। উৎপল দত্ত রচিত মৌলিক পূর্ণাঙ্গ ও একাঙ্ক নাটক, অনুবাদনাট্য, যাত্রাপালা ও পথনাটকের সংখ্যা ১০০–র বেশি। এর মধ্যে ৯০টি নাটক প্রকাশিত ও গ্রন্থিত। উৎপল দিকপাল পণ্ডিত ও বিদগ্ধ সমাজবিজ্ঞানী। বহু মৌলিক গ্রন্থের রচয়িতা। তিনি কবি ও ছোটগল্প লেখক। তিনি মূল স্রোতের বাণিজ্যিক ছবির শীর্ষ অভিনেতা এবং কয়েকটা কলোত্তীর্ণ সিনেমার অমর চরিত্রস্রষ্টা। উৎপল ক্রান্তিদর্শী রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও সম্মোহনী বাগ্মী। তিনি অগ্নিগর্ভ রাজনীতির নায়ক।
“আমি শিল্পী নই। নাট্যকার বা অন্য যে কোনো আখ্যা লোকে আমাকে দিতে পারে। তবে আমি মনে করি আমি প্রপাগান্ডিস্ট। এটাই আমার মূল পরিচয়।”
নিজের সম্পর্কে এমনই মন্তব্য করেছিলেন কিংবদন্তি বাঙালি নাট্যকার, অভিনেতা ও পরিচালক উৎপল দত্ত।
উৎপল দত্ত ১৯২৯ সালের ২৯শে মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্ম অবিভক্ত বাংলার বরিশালে। তিনি কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ইংরেজি বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন।
জীবনের প্রথম দিকে উৎপল দত্ত বাংলা মঞ্চনাটকে অভিনয় করতেন। তিনি ‘শেক্সপিয়ার আন্তর্জাতিক থিয়েটার কোম্পানি’র সাথে ভ্রমণ করেছেন বেশ কয়েকবার। কৌতুক অভিনেতা হিসেবেও তাঁর খ্যাতি রয়েছে। তিনি হিন্দি কৌতুক চলচ্চিত্র গুড্ডি, গোলমাল ও শৌখিনে অভিনয় করেছেন। এছাড়া সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় হীরক রাজার দেশে, জয় বাবা ফেলুনাথ এবং আগন্তুক সিনেমায় অভিনয় করে প্রচুর প্রশংসা কুড়িয়েছেন। মননশীল ছবি ছাড়াও অজস্র বাণিজ্যিক বাংলা ছবিতে খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন উৎপল দত্ত। তবে সবকিছু ছাপিয়ে তিনি নাট্যকার হিসেবেই সব থেকে বেশি পরিচিত পেয়েছেন।
উৎপল দত্ত যখন জন্মগ্রহণ করেছেন তখন বিশ্বব্যাপী বয়ে যাচ্ছে এক বিক্ষুব্ধ সময়। সমগ্র বিশ্ব এবং বিশেষ করে পাক-ভারতীয় উপমহাদেশে তখন প্রতিদিনের নতুন সকাল সম্পর্কে মন্তব্য করা কঠিন ছিল। বিশ শতকের প্রথম দশক থেকে বৈশ্বিক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতে থাকলো অর্থনৈতিক অবস্থা, সামাজিক মূল্যবোধের প্যাটার্ন, মানুষের আন্তর্জাগতিক ভূগোল এবং তৎসম্পর্কিত বাহ্যিক আচার-আচরণ, যা চল্লিশের দশকে গিয়ে আরো পরিণত হলো। উৎপল দত্তের বেড়ে ওঠা এই সময়ের ভেতরে। যে কারণে সে সময়ের বৈচিত্র্যসংযাত এবং রাজনৈতিক রসায়ন উৎপল দত্তের নাটকের প্রধান মনোযোগ।
কলেজ জীবনেই অভিনয় শুরু করেন উৎপল দত্ত। ১৯৪৭ সালে নিকোলাই গোগলের ‘ডায়মন্ড কাট্স্ ডায়মন্ড’ এবং মলিয়েরের ‘দ্য রোগারিজ অব স্ক্যাপা’ দিয়েই তার কলেজ জীবনের অভিনয় শুরু। নাটক দুটি প্রযোজনা করেছিল কলেজের ইংরেজি একাডেমি এবং পরিচালনায় অধ্যাপক ফাদার উইভার। ক্রমশ উৎপল ও কলেজের কয়েকজন সহপাঠী মিলে গড়ে তোলেন একটি নাট্যদল- ‘দ্য অ্যামেচার শেকসপিয়ারিয়ান্স’। তাঁদের প্রথম উপস্থাপনা ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ এবং ম্যাকবেথ নাটকের নির্বাচিত অংশ। সেই সময়েই ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে, ইংল্যান্ডের বিখ্যাত পরিচালক ও অভিনেতা জেফ্রি কেন্ডাল তাঁর ‘শেকসপিয়ারিয়ানা’ নাট্যদল নিয়ে ভারত সফরে আসেন। কেন্ডালের আহ্বানে উৎপল যোগ দেন সফররত সেই নাট্যদলে। ১৯৪৭-এর অক্টোবর থেকে জানুয়ারি ১৯৪৮ পর্যন্ত শেকসপিয়ারিয়ান নাট্যদল কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে তাদের প্রযোজনা মঞ্চায়ন করে। নাট্যমোদীরা অভিভূত হন। জেফ্রি কেন্ডালের দলে তখন নিয়মিত অভিনয় করেছেন তিনি। ইউরোপীয় থিয়েটার দলের শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা উৎপলের নাট্যজীবনে ফেলেছিল বিশেষ প্রভাব। এ সময়েই কেন্ডাল-কন্যা জেনিফারের সঙ্গে উৎপলের পরিচয়, অচিরেই যার উত্তরণ ঘটে প্রণয়ে। পরবর্তীকালে জেনিফারের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটলে তীব্র কষ্ট উৎপলকে ঘিরে ধরে। সে দহনের রেশ ছিল আজীবন। জেনিফারের সম্পর্ক মনে রেখে একাধিক কবিতাও লিখেছেন এ নাট্যকার। সহধর্মিণী শোভা সেনের কথন অনুযায়ী, উৎপলের ছিল কবিতা, ছিল ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতি অথবা কোনো তাৎক্ষণিক বক্তব্য প্রকাশের মাধ্যম।
উৎপল দত্ত কেবল একজন অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক ও লেখকই ছিলেন না, রাজনৈতিক দর্শনের দিক থেকে তিনি ছিলেন বামপন্থি ও মার্কসবাদী। তিনি আজীবন বামপন্থি ও মার্কসবাদী উৎপল দত্ত গণনাট্য সংঘের সক্রিয় সদস্য হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে নাটক প্রদর্শনে অংশ নেন। মঞ্চের পাশাপাশি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করে বেশ সুখ্যাতি পেয়েছিলেন তিনি। ১৯৫০ সালে ‘বিদ্যাসাগর’ সিনেমায় অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে তার যাত্রা শুরু হয়। ‘মাইকেল মধুসূদন’ সিনেমায় নাম ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করে চরিত্রাভিনেতা হিসেবে নিজের আসন পাকা করেন।
বাণিজ্যিক ছবিতে মূলত তিনি নেতিবাচক চরিত্রে অভিনয় করে সব থেকে বেশি খ্যাতি পান। ১৯৬৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত মৃণাল সেন পরিচালিত ‘ভুবন সোম’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার পান তিনি। কমেডি চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ‘গোলমাল’ (১৯৮০), ‘নরম গরম’ (১৯৮২) ও ‘রঙ বিরঙি’ (১৯৮৭) সিনেমার সুবাদে তিনবার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পান। ‘সাহেব’ (১৯৮৬) সিনেমার অভিনয়ের জন্য পার্শ্ব-চরিত্রে সেরা অভিনেতার মনোনয়ন পান ফিল্মফেয়ার আসরে।
শুধু অভিনেতা হিসেবেই নন, নির্দেশক ও নাট্যকার হিসেবেও তিনি ছিলেন অনবদ্য। বিখ্যাত অনেক বিদেশি নাটক বাংলায় রূপান্তর করেন। পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকে তিনি ছিলেন পশ্চিম বাংলার গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। শিল্প ও সাহিত্য সমালোচনার দুটি মানদণ্ড আছে : একটি রাজনৈতিক অপরটি শৈল্পিক। শ্রেণিবিভক্ত সমাজে প্রত্যেক শ্রেণির নিজস্ব রাজনৈতিক ও শৈল্পিক মানদণ্ড আছে। কিন্তু সব শ্রেণিবিভক্ত সমাজে সমস্ত শ্রেণিই সর্বদা শৈল্পিক মানদণ্ডের চেয়ে রাজনৈতিক মানদণ্ডকে স্থান দিয়ে থাকে। তবে উৎপল দত্ত তার রচিত ‘টিনের তলোয়ার’, ‘মানুষের অধিকার’, ‘ব্যারিকেড’, ‘অঙ্গার’সহ বেশকিছু নাটকের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন একই সঙ্গে রাজনৈতিক ও শৈল্পিক মানদণ্ডকে স্পর্শ করা সম্ভব।
বাংলা রাজনৈতিক নাটকের ইতিহাস শুরু বলা যায় দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকের মাধ্যমে। উনিশ শতকের মধ্যভাগে বাংলা নাটকের মূল চালিকাশক্তি ছিল সমাজ সংস্কারের মানসিকতা। রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’রা সেকালে সমাজে যে প্রবল প্রগতিশীল আন্দোলন উপস্থিত করেছিলেন, সেকালের নাটক মূলত তারই প্রতিফলন। ‘নীলদর্পণ’-এ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শোষণের নির্মম চিত্র উদঘাটনই ছিল মূল লক্ষ্য। এরপর জাতীয়তাবাদের উন্মেষ পর্বে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, কিরণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, হরলাল রায়, উপেন্দ্রনাথ দাস, উমেশচন্দ্র গুপ্ত, প্রমুখ মূলত ইতিহাসের প্রচ্ছদে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাজনৈতিক নাটক রচনা করেছিলেন। পরবর্তীকালে এই ধারা গিরীশচন্দ্র-দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রমুখের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছে। আর বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্বে বাংলা নাটককে প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক নাটকের ধারা হিসেবে যারা এগিয়ে নিয়ে গেছেন তাঁদের মধ্যে উৎপল দত্ত অন্যতম।
উৎপল দত্ত তাঁর অন্য নাটকের পাশাপাশি রাজনৈতিক নাটকে শাসক, শোষকশ্রেণির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন সরাসরি। শুধু তাই নয়, নাটক নিয়ে তিনি চার দেয়ালে ঘেরা থিয়েটারে আবদ্ধ থাকেননি, পৌঁছেছেন গণমানুষের কাছে; নাটকে সম্পৃক্ত করেছেন হাজার হাজার সাধারণ মানুষকে।
উৎপল দত্তের রাজনৈতিক নাটকগুলোর মধ্যে আবার পাওয়া যায় শ্রেণি চেতনা, ইতিহাস চেতনা ও মধ্যবিত্ত চেতনা। ‘টিনের তলোয়ার’, ‘রাতের অতিথি’, ‘ছায়ানট’, ‘সূর্যশিকার’, ‘মানুষের অধিকার’ প্রভৃতি নাটকে যেমন পাওয়া যায় শ্রেণি চেতনা সচেতনতা, তেমনি ‘টোটা’, ‘লাল দুর্গ’, ‘তিতুমীর’, ‘কল্লোল’, ‘দিল্লি চলো’, ‘ক্রুশবিদ্ধ কুবা’ প্রভৃতি নাটকের ইতিহাস চেতনা, ‘অঙ্গার’, ‘ফেরারি ফৌজ’ প্রভৃতি নাটকের মধ্যবিত্ত চেতনা তাঁর নাটককে দেয় ভিন্নমাত্রা।
উৎপল দত্তের নাটকে ভারতবর্ষের সমাজ, রাজনীতির পাশাপাশি উঠে এসেছে বিশ্বরাজনীতি, অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রয়াস, মানবতার জয়তু জীবনজিজ্ঞাসা প্রভৃতি বিষয়। ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ আজীবন সংগ্রামী। এখানে যেমন অন্যায়, অত্যাচার, দখল, শাসন-শোষণ নিত্য চলেছে, তেমন নিপীড়িত, শোষিত, সর্বহারা মানুষ তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে বারবার; আদায় করেছে তাদের কাক্সিক্ষত অধিকার। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক গণবিপ্লবের কাহিনী তার নাটকের অন্যতম বিষয়বস্তু। গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়কালে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, ১৮৫৭ সালের ভারতীয় মহাবিদ্রোহ, নীলবিদ্রোহ, সন্ন্যাসীবিদ্রোহ, ওয়াহাবি আন্দোলন, জালিয়ানওয়ালাবাগের রক্তাক্ত অধ্যায়, আজাদ হিন্দ ফৌজের দুঃসাহসিক অধ্যায়, ভারতের নৌবিদ্রোহ, দেশ বিভাগের মর্মন্তুদ ঘটনা ইত্যাদি। শুধু তাই নয়, বিশ্বের সংগ্রামী মানুষের মরণপণ সংগ্রামী ঘটনাগুলোও তাঁর নাটকে ধরা পড়েছে গভীর ইতিহাস বীক্ষার আলোকে। পৃথিবীর প্রথম শ্রমিক শ্রেণির রাষ্ট্রগঠনের যে ঘটনা আজো সর্বহারা শ্রেণির চোখের মণি সেই প্যারি কমিউন, অক্টোবর বিপ্লবের পূর্ব ও উত্তরকাল, ফ্যাসিবিরোধী সংগ্রাম, চীনের বিপ্লব, ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধ, কিউবা, ইন্দোনেশিয়া, একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় ও প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের কলঙ্কজনক ভূমিকা- সবই তিনি লিপিবদ্ধ করে গেছেন তাঁর নাটকের বিষয়বস্তুতে।
১৯৬৮ সাল। নানা পরিস্থিতিতে তখন অস্থির তাঁর জীবন। নিজের দল এলটিজি থেকে তখন তিনি বিতাড়িত। আগের বছরেই তাঁকে রাজনৈতিক কারণে জেলে যেতে হয়েছিল। চারিদিকের চেনা মানুষগুলি কেমন যেন অচেনা হয়ে উঠেছিল। তাঁর নাটক করার জায়গাটা তখন প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তিনি থেমে থাকার পাত্র নন। তাঁকে চলতেই হবে। তাই তিনি অভিনয়ের অন্য মাধ্যম খুঁজছিলেন। ছবিতে অভিনয় চলছিল। কিন্তু পাশাপাশি তিনি যাত্রার দিকে ঝুঁকলেন। খুব ইচ্ছে ছিল যাত্রার মাধ্যমটিকে নিয়ে কিছুটা পরীক্ষা নিরীক্ষা করা। বারবার বলতেন, ‘প্রকৃত, নিয়মনিষ্ঠ শিল্পী যদি খুঁজতেই হয়, তবে যাত্রায় যেতে হবে।’ ততদিনে দেখে ফেলেছেন ফণীভূষণ বিদ্যাবিনোদ, পঞ্চু সেনের অভিনয়। তাঁদের বলিষ্ঠ অভিনয় দেখে ঠিক করলেন যাত্রার জন্য পালা লিখবেন, নির্দেশনা দেবেন। তিনি উৎপল দত্ত। শুধু চলচ্চিত্র বা বাংলা নাট্যমঞ্চেই তাঁর অবদান ছিল তা নয়। অনেকটা অবদান তাঁর যাত্রাতেও রয়েছে।
যোগাযোগ ঘটে গেল। ১৯৬৮ সালে যাত্রার জন্য প্রথম পালা লিখলেন ‘রাইফেল’। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পটভূমিকায় লেখা। নতুন নাটক নয়। তাঁর ‘টোটা’ নাটকটিকেই একটু অদল বদল করেছিলেন। নিউ আর্য অপেরায় সেই নাটক একদিন পড়া হল। কিন্তু পালা শুনেই পঞ্চু সেন বলে দিলেন, ‘এই নাটক যাত্রায় চলবে না। খুব কঠিন হয়ে গিয়েছে। গ্রাম বাংলার দর্শক এই নাটক নেবে না।’
পঞ্চু সেনকে খুবই শ্রদ্ধা করতেন উৎপল দত্ত। তিনিও বুঝতে পারলেন, এই নাটক বদল করা দরকার। তিনি বললেন, ‘আমাকে সাতদিন সময় দিন, আমি একটা নতুন নাটক লিখে দেব।’ কিন্তু ততদিনে ‘রাইফেল’ নাটকের বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়ে গিয়েছে। নাম আর বদল করা যাবে না। তাই নামটি একই রেখে লেখা হল নতুন নাটক। ১৯৩০ সালের স্বাধীনতার লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটে লিখলেন নতুন নাটক। এবার পঞ্চু সেন বললেন, ‘শেষ দৃশ্যটা অন্যরকম করা দরকার। ঠিক জমেনি।’ সেই পরামর্শ মেনে উৎপল আবার তাঁর পালার পরিবর্তন করলেন। সেই নাটকে পঞ্চু সেন করেছিলেন ‘রহমৎ’ চরিত্র। রিহার্সালের সময় উৎপল দত্ত সব শিল্পীকে নানা বিষয় নির্দেশ করলেও পঞ্চু সেনকে কিছুই বলছিলেন না। পঞ্চুবাবু তাঁর নিজের মতো করে রিহার্সাল দিচ্ছিলেন। একদিন পঞ্চুবাবু বললেন, ‘আপনি সবাইকে সবকিছু বলে দিচ্ছেন, আমাকে কিছু বলছেন না তো!’ সে কথা শুনে উৎপল দত্ত বললেন, ‘আমি আপনার অভিনয় দেখে কিছু শিখছি।’ এমনই ছিল তাঁর শ্রদ্ধাবোধ।
১৯৬৮ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে অভিনীত হল ‘রাইফেল’। সাড়া ফেলে দিল সেই পালা। কিন্তু সেবছরই দলের মালিকের সঙ্গে টাকা পয়সা নিয়ে এমন সব অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেল যে, উৎপল সিদ্ধান্ত নিলেন, যাত্রায় আর নাটক দেবেন না। স্থির হল নিজেরাই যাত্রা দল গড়ে গ্রামগঞ্জে অভিনয় করবেন। তৈরি হল বিবেক যাত্রা সমাজ। দুটি পালা ঠিক হল। একটি ‘রাইফেল’ এবং অন্যটি ‘শোনরে মালিক’। কিন্তু বিবেক যাত্রা সমাজ চালানো গেল না। এর মধ্যেই সত্যম্বর অপেরার শৈলেন মোহান্তি এলেন উৎপল দত্তের কাছে। নতুন নাটক চাই। উৎপল দত্ত রাজি নন। কিন্তু মত বদলাতে হল। লিখলেন ‘জালিয়ানওয়ালাবাগ’। সেই কুখ্যাত হত্যাণ্ডের ঘটনা নিয়ে নাটক। পেলেন একদল ভালো অভিনেতাকে। ভোলা পাল (ছোট), মনোরঞ্জন চক্রবর্তী, শিবদাস মুখোপাধ্যায়, তপনকুমার, মোহন চট্টোপাধ্যায়, জয়শ্রী মুখোপাধ্যায়কে। রিহার্সালে এঁদের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন উৎপল।
পরের বছর পালা লিখলেন লোকনাট্যের জন্য। ‘দিল্লি চলো’। অসাধারণ হয়েছিল সেই পালা। সেখানে পেলেন শেখর গঙ্গোপাধ্যায়কে। সেই বছরেই লোকনাট্যে দিলেন আর একটি পালা ‘সমুদ্রশাসন’। সমুদ্রগুপ্তকে নিয়ে লেখা পালা। আরও দুটি পালা সে বছর হয়েছিল, একটি ‘নীলরক্ত’। অভিনীত হয়েছিল ভারতী অপেরায় এবং অন্যটি ‘ভুলি নাই প্রিয়া’। অভিনীত হয়েছিল শ্রীমা অপেরায়।
যাত্রায় আসার আগে পালার আঙ্গিক নিয়ে তিনি জানতে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। তখন শম্ভু বাগ, ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ পালাকারের প্রকাশিত বেশ কয়েকটি যাত্রার বই পড়ে তিনি পথ খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন। জানলেন যাত্রা কী, কেমন তার বৈশিষ্ট্য। কিন্তু তিনি পুরোপুরি সেই পথ অনুসরণ করলেন না। তার সঙ্গে মিশিয়ে দিলেন নিজস্বতা। যাত্রার আঙ্গিকের মধ্যে মিশিয়ে দিলেন নাটকের কম্পোজিশন এবং অভিনয়। বাচিক অভিনয়কেও অনেকটা বদলে দিলেন। শহরকেন্দ্রিক এলাকায় সেই সব পালা তুমুল সাফল্য পেলেও গ্রাম বাংলার মানুষের কাছে, তা অনেকটাই অধরা থেকে গিয়েছিল। তাই তাঁর সব পালাকে সেই অর্থে হিট বলা যায় না। অর্থাৎ ব্রজেন দের ‘সোনাই দীঘি’, শম্ভু বাগের ‘হিটলার’, ‘লেনিন’ বা ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘একটি পয়সা’, ‘পাগলা গারদ’ বা ‘মা-মাটি-মানুষ’ যে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, উৎপলের নাটক সেখানে পৌঁছতে পারেনি। এমনকী তরুণ অপেরায় শান্তিগোপাল তাঁর লেখা পালা ‘মাও সে তুং’ করেছিলেন, সেও বেশিদিন চলেনি। তার কারণ অবশ্য অন্য ছিল। উৎপল সেই নাটকে চিয়াং কাই শেকের চরিত্রটি দিয়েছিলেন গৌতম সাধুখাঁকে। কিন্তু সেটা মনঃপুত হয়নি শান্তিগোপালের। কেন না গৌতম তখন যাত্রায় নতুন। সুতরাং কয়েক পালার পর বন্ধ হয়ে যায় ‘মাও সে তুং’।
নির্দেশনার ক্ষেত্রে উৎপল দত্ত ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এটা অবশ্য বলাই যায় যে যাত্রায় তিনি এক ধরনের আধুনিকতার জন্ম দিয়েছিলেন। অবশ্য বিচার করলে বলতেই হয়, তিনি সময়ের চেয়ে একটু বেশি এগিয়ে ছিলেন। নাটকে যেমন একসময় নবনাট্য এসেছিল, চলচ্চিত্রে যেমন একটা নতুন ধারার ছবি তৈরির হাওয়া এসেছিল, উৎপল দত্তও যাত্রায় সেই নতুন যুগের হাওয়া আনার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তা স্থায়ী হয়নি। কেন না তাঁর মতো করে যাত্রাসৃষ্টি করার প্রতিভা পরবর্তীকালে পাওয়া যায়নি। তাই শুধু বাণিজ্যের নিরিখে তাঁর পালাকে মাপলে অনেকক্ষেত্রে ভুল হতে পারে।
অনেকে বলেন যাত্রায় রাজনৈতিক নাটকের তিনি ভগীরথ। কথাটা সর্বাংশে ঠিক নয়। তার আগেও যাত্রায় রাজনৈতিক নাটক হয়েছিল। কিন্তু তিনি রাজনৈতিক নাটককে নতুন ভাষ্যে উপস্থাপিত করেছিলেন। বলিষ্ঠ কনটেন্ট আর ফর্মের মধ্য দিয়ে সে সব প্রযোজনা ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। যাত্রায় উৎপল দত্ত সব সময় পছন্দ করতেন শেখর গঙ্গোপাধ্যায়, শিবদাস মুখোপাধ্যায়ের মতো বিশেষ কয়েকজন শিল্পীকে। এছাড়া ছিলেন অনাদি চক্রবর্তী, ইন্দ্র লাহিড়ী, নিরঞ্জন ঘোষ, মুকুন্দ দাস, বীণা ঘোষ, বর্ণালী বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। তরুণরা তাঁর ঘরানাতেই গড়ে উঠেছিলেন। আর প্রবীণরা পেয়েছিলেন অভিনয়ের পূর্ণতার স্বাদ। তৈরি হয়েছিল পারস্পরিক শ্রদ্ধার একটা স্থান।
বিজন মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে তাঁর একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ‘দিল্লি চলো’ পালায় বিজনবাবু অভিনয় করতেন ইংরেজ কর্নেল ব্রেনানের ভূমিকায়। রিহার্সালের আগে উৎপল দত্ত যখন তাঁকে দেখেন তখন তিনি লুঙ্গি পরা। বিড়ি টানছিলেন। এই মানুষটি সাহেবের ভূমিকায় অভিনয় করবেন, ভাবতে কেমন সঙ্কোচ হচ্ছিল উৎপলের। কিন্তু মঞ্চে তাঁর অভিনয় দেখে তিনি চমকে গিয়েছিলেন। পরে তিনি বলেছিলেন, ‘ইংরেজের ভূমিকায় এত ভালো অভিনয় তিনি আগে দেখেননি।’ মঞ্চে একটা দৃশ্য ছিল ব্রেনান বিপ্লবী প্রদ্যোতের চোখ উপড়ে নিচ্ছে। প্রদ্যোতের ভূমিকায় ছিলেন শেখর গঙ্গোপাধ্যায়। সেই দৃশ্যে ব্রেনানের নিষ্ঠুরতার অভিনয় দেখে মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে মঞ্চে উঠে পড়তেন ব্রেনানকে মারতে।
এরপর একে একে ‘সন্ন্যাসীর তরবারি’, ‘ঝড়’, ‘বৈশাখী মেঘ’, ‘সীমান্ত’, ‘তুরুপের তাস’, ‘সাদা পোশাক’, ‘দামামা ঐ বাজে’ ইত্যাদি পালা অভিনীত হল। কুড়ি বছর তিনি যাত্রার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এর মধ্যে তিনি লিখেছিলেন বাইশটি পালা। সব পালা তেমন দাগ কাটেনি। হিট এবং ফ্লপ মিশিয়েই তিনি রাজত্ব করেছেন।
যাত্রায় উৎপল দত্তের কেরিয়ার নিয়ে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে যাত্রা গবেষক দিবাকর ভৌমিক বলেছেন, ‘উৎপল দত্ত মঞ্চরীতির একজন দক্ষ নির্দেশক। সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তবে পালাকার রূপে তাঁর সম্পর্কে অভিযোগ আছে, যা মামুলি নয়। যাত্রাপালার যে সাধারণ বৈশিষ্ট্য, তা তাঁর কোনও পালাতেই নেই। সত্যি কথা বলতে কী এগুলিকে পালা না বলে নাটক বলাই শ্রেয়। তাঁর নাটকগুলির মধ্যে দু’চারটি জনসমাদর পেলেও কয়েকটি তো দারুণভাবে ব্যর্থ। গ্রামবাংলায় তাঁর নাটকগুলি জনপ্রিয়তায় ব্রাত্য।’
এই মত মেনে নিলেও বলতে হয়, উৎপল দত্ত যাত্রায় একটা যুগ। উৎপল দত্ত যাত্রায় এক নতুন ভাষ্যের রূপকার। অসীম শ্রদ্ধা ছিল তাঁর যাত্রার প্রতি। একবার তাঁর সঙ্গে একটি ছবির শ্যুটিংয়ের অবসরে নানা বিষয়ে কথা হয়েছিল। বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে যাত্রা প্রসঙ্গও এসেছিল। সেদিনই বুঝেছিলাম যাত্রা এবং যাত্রাশিল্পীদের প্রতি কতটা তাঁর শ্রদ্ধাবোধ। বলেছিলেন, ‘যাত্রায় যুক্ত হয়ে বুঝেছি এখানে কত শক্তিশালী শিল্পীরা আছেন। প্রফেশনালিজম শিখতে হলে যাত্রার শিল্পীদের থেকেই শেখা উচিত। দেখেছি তাঁদের কাছে যাত্রা একটা ধর্মের মতো। শিল্পকে প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌছে দিয়েছে যাত্রা। সেটা নাটক পারেনি।’
কিন্তু সবশেষে প্রেমিক উৎপলকে আমরা কয়জন চিনি?
এই বিষয়ে এ–যাবৎকাল বাংলা থিয়েটারের এক আশ্চর্যময়ী চরিত্র, কিংবদন্তি অভিনেত্রী শোভা সেনের সঙ্গে উৎপলের প্রেম, পরিণয় এবং সুদীর্ঘ যাত্রাপথে টালমাটাল দুর্যোগ ও অস্থির সময়ের চালচিত্র অক্ষয় হয়ে আছে। জানা যায়, ব্যক্তিজীবনের এক চরম সঙ্কটের মধ্যে শোভা সেন ১৯৬১ সালে যাবতীয় মানসিক যন্ত্রণার অবসান ঘটিয়ে তাঁর পূর্বতন স্বামী দেবপ্রসাদ সেনের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ করেন। তারপর গত শতকের পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি লিটল থিয়েটার গ্রুপে যোগ দিয়ে গুরুরূপে যাঁকে স্বীকার করেছিলেন, নিজের চেয়ে ৬ বছরের ছোট সেই প্রতিভাশালী নাট্যব্যক্তিত্ব উৎপল দত্তকে স্বামীরূপে গ্রহণ করেন। ১৯৬১ সালের ২৯শে মার্চ উৎপলের ৩২তম জন্মদিনে শোভা সেনের সঙ্গে বিয়ে হয়।
তারপরই ‘অঙ্গার’ নাটকের তিনশো রজনী অতিক্রান্ত হলে উৎপলদের দল বোম্বেতে আমন্ত্রিত হয়েছিল। বোম্বেতে পণ্ডিত রবিশংকরের ফ্ল্যাটে একদিন বহু বিশিষ্ট অতিথির সামনে ঘরোয়া অনুষ্ঠানে বিশ্ববরেণ্য সেতারশিল্পী উৎপল–শোভার রেজিস্ট্রি বিয়ের কথা ঘোষণা করেন। এই প্রসঙ্গে পরে শোভা সেন লিখেছিলেন, ‘আমার মানসিক শান্তি তখন অনেকটা ফিরে এসেছে। উৎপলের মতো স্বামী পেয়ে আমি সব হারানোর দুঃখ ভুলে গেলাম। অমন প্রশস্ত হৃদয়, উদারচেতা পুরুষ এদেশে সত্যিই বিরল।’ একথা ভুললে চলবে না যে, স্বামী উৎপলের উপর্যুপরি গ্রেপ্তার ও কারাবাস, বিশেষত ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ৭ মাস জেলে থাকার সময় সমস্ত প্রতিকূলতা ও সঙ্কটের মোকাবিলা করতে হয় এই তেজস্বী বীরাঙ্গনাকে।
তবে উৎপল কিন্তু শোভা সেনের শুধুমাত্র প্রেমিক নন। তিনি শোভা সেনের স্বামী, গুরু এবং পথপ্রদর্শক। তিনি শোভা সেনের জীবনে আলোকবর্তিকা। উৎপল প্রয়াত হওয়ার পর শোভা সেনের জীবনের ভরকেন্দ্রে ছিল স্বামী ও স্রষ্টার মহান, সমৃদ্ধশালী উত্তরাধিকার বহন ও সংরক্ষণ।
অন্যদিকে উৎপলের কাছেও শোভা সেন কি শুধুমাত্র প্রেমিকা? বোধহয় তা নন। স্ত্রী শোভা তাঁর মন্ত্রে দীক্ষিত দায়বদ্ধ শিল্পী এবং সহযোদ্ধা। এক লড়াকু অভিনেত্রী। তাই শোভা সেনের আত্মজীবনীর মুখবন্ধে উৎপল লিখেছেন যে, অভিনেত্রী শোভা সেনের ভূমিকার তলায় চাপা পড়ে যায় তাঁর অসামান্য সাংগঠনিক শক্তির কথা। তাঁর বক্তব্য ছিল যে, প্রথম এলটিজি এবং অবশেষে পিএলটি–র স্থিতি, সমৃদ্ধি ও বিকাশের নেপথ্যে সংগঠকরূপে শ্রীমতী সেনের অসামান্য অবদান স্বীকার করতে হবে। উৎপলের ভাষায়, ‘মঞ্চের ওপর তাঁর যে খ্যাতি গড়ে উঠেছে, তার চেয়ে নাট্য আন্দোলনের সফল সম্পাদক হিসেবে তাঁর যশের দাবি কম নয়।’
১৯৬৫ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর মহালয়ার দিন ‘ভারতরক্ষা’ আইনে গ্রেপ্তার হন উৎপল দত্ত। এরপর দীর্ঘ সাত মাস কারাগারের অন্তরালে দিন কাটে উৎপলের। কিন্তু কারাগারের দিনগুলিতেও দিনবদলের স্বপ্ন তাঁকে ছেড়ে যায়নি। জেলখানার বন্দিজীবনের দুঃসহ নরকযন্ত্রণার মধ্যেও উৎপল ইংরেজি ভাষাতে চারটি অসামান্য কবিতা লিখেছিলেন। এর মধ্যে দুটি কবিতা ১৯৯৪ সালে সিগাল কোয়াটার্লির প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। একটি কবিতার কথায় পরে আসছি। প্রেসিডেন্সি জেলের নোটবইটিতে আবিষ্কৃত সেই কাব্যসম্ভারই কবি উৎপলের সবচেয়ে পুরোনো সৃষ্টিসম্পদ।
১৯৬৬ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি উৎপল জেলখানার ডায়েরিতে লিখেছিলেন ইংরেজি কবিতা ‘মাই ওয়াইফ’। সেই কবিতার ছত্রে ছত্রে জীবনের প্রতি প্রচণ্ড আবেগ এবং স্ত্রীর জন্য ভালবাসার আলো ঠিকরে বের হচ্ছে। কিন্তু অন্যত্র উৎপল–রচিত ‘শোভাকে’ কবিতায় দেখা যায় স্ত্রী তাঁর কাছে শুধুমাত্র প্রেমিকা নন, তিনি এক নিরন্তর, নিরবচ্ছিন্ন প্রেরণা। তাই উৎপল এই কবিতায় স্ত্রী সম্পর্কে লিখেছিলেন,
“তোমার কাছে পাইনি ক্লীব বিশ্রাম
পাইনি নির্বোধ রাত্রির শান্তি,
তুমি এক অবিরাম তাড়না,
অশান্ত পথের হাতছানি,
... ... ...
এ সমাজে তুমি বাঁধা পড়ো না
তাই তুমি বিপ্লবের পথচারী।” …
‘শোভাকে’ কবিতায় কবি উৎপল আবেগশূন্যভাবে লেখেন,
“আমি জানি যদি আমি জেলে চলে যাই
তুমি পোড়–খাওয়া যোদ্ধার মতন
হঠাৎ হেসে বলবে, একজন গেল খরচের খাতায়,
রইল বাকি নয়।”
শোভা সেন কখনই উৎপলের কাছে শুধু স্বপ্নে ভাসা প্রেমিকা ছিলেন না। তাই এই কবিতার উপসংহারে তিনি লিখেছেন,
“তাই অনাগতের কুয়াশাঢাকা ভোরে
আমি চোখ মেলে দিয়ে দেখি
ব্যারিকেডে দাঁড়িয়ে তুমি আর আমি
লড়ে যাচ্ছি দুই কমরেড।”
প্রথম যৌবনের প্রেমিক উৎপলের খোঁজে এবার আমাদের ফিরে যেতে হবে দেশের স্বাধীনতা–পরবর্তী ৪০–এর দশকের শেষে। ১৯৪৭ সালে ভারত ইতিহাসের এক মহাসন্ধিক্ষণে উৎপলের জীবনে তাঁর গুরু জেফ্রি কেন্ডালের আবির্ভাব। গত শতকের চল্লিশের দশকে ইংল্যান্ডের প্রখ্যাত অভিনেতা ও পরিচালক জেফ্রি কেন্ডাল একটি ভ্রাম্যমাণ থিয়েটার দল নিয়ে প্রধানত শেক্সপিয়ারের নাটক মঞ্চস্থ করতে ব্রহ্মদেশ, শ্রীলঙ্কা ইত্যাদি দেশ ঘুরে ভারতে এসে পৌঁছোন। কেন্ডালের ভ্রাম্যমাণ থিয়েটার দলে তাঁর অভিনেত্রী স্ত্রী লরা, দুই কন্যা জেনিফার ও ফেলিসিটি এবং কয়েকজন ক্ষমতাবান কুশলী শিল্পী ছিলেন। এঁরা সবাই ছিলেন পেশাদার অভিনেতা–অভিনেত্রী— থিয়েটারই যাঁদের ধ্যানজ্ঞান এবং জীবিকানির্বাহের মাধ্যম। থিয়েটারের যাবতীয় কাজ— অভিনয়, মঞ্চসজ্জা, আলোকসম্পাত, নেপথ্যসঙ্গীত— তাঁদের রপ্ত করতে হত। ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে শিলং থেকে কেন্ডালের নট্ট কোম্পানি কলকাতায় আসে।
১৯৪৭ সালে মাত্র ১৮ বছরের প্রতিভাশালী যুবক উৎপল দত্ত সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ছাত্র থাকাকালীন সহপাঠীদের নিয়ে ‘দি অ্যামেচার শেক্সপিয়ারিয়ানস’ নাট্যদল গঠন করেছিলেন। তখন তিনি বিশ্বসাহিত্যের ক্ষুধার্ত ও অক্লান্ত পাঠক। ছাত্র অবস্থাতেই ইতিহাস, রাজনীতি, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, থিয়েটার, চলচ্চিত্র এবং ধ্রুপদী সঙ্গীতের জগতে একজন নিরলস অভিযাত্রী। সেই বয়সেই উৎপলের অসামান্য মস্তিষ্ক ঋদ্ধ হয়েছিল কান্ট, হেগেল, ফয়েরবাখ, মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন পাঠে। তাঁর সহপাঠী উত্তরকালের খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ ও অধ্যাপক পুরুষোত্তম লাল পরে লিখেছিলেন, ‘Utpal was born brilliant’।
১৯৪৭ সালে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ছাত্র উৎপলের একটি শেক্সপিয়ার প্রযোজনা দেখে জেফ্রি কেন্ডাল তাঁকে আমন্ত্রণ জানান। উৎপলের ভাষায়, ‘কলেজ, লেকচার, পরীক্ষা, পাঠ্যপুস্তক প্রভৃতির বিরক্তিকর মায়া’ কাটিয়ে তিনি কেন্ডালের ‘শেক্সপিয়ারিয়ানা’ নাট্যদলে যোগ দিয়েছিলেন। কেন্ডালের তীক্ষ্ণ জহুরির চোখ আসল সোনা চিনতে ভুল করেনি। কেন্ডালের শিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক প্রশিক্ষণে উৎপল কালক্রমে একজন প্রকৃত আন্তর্জাতিকমানের পেশাদার অভিনেতা ও পরিচালক হয়ে ওঠেন। তাই উৎপল ১৯৭২ সালে রচিত মৌলিক ও মননশীল গবেষণাগ্রন্থ ‘শেক্সপিয়ারের সমাজচেতনা’র উৎসর্গপত্রে লিখেছিলেন,
“আমার শেক্সপিয়ার পাঠের গুরু, শেক্সপিয়ার অভিনয়ের শিক্ষক জেফ্রি কেন্ডালকে।”
১৯৪৭ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত, এই পর্বে কেন্ডালের ‘শেক্সপিয়ারিয়ানা’ নাট্যদল বিপুল সাফল্য ও কৃতিত্বের সঙ্গে কলকাতার শিক্ষিত দর্শকদের অভিভূত করেছিল। ১৯৪৭–৪৮ সালে সবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য ভারতে অস্ত গেলেও কলকাতায় তখনও পুরোমাত্রায় সাহেবিয়ানার প্রভাব। তাই কলকাতার অভিজাত ও কুলিন ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় কেন্ডালের যাবতীয় নাট্যপ্রযোজনার বিস্তারিত সমালোচনা হয়েছিল। এই পর্যায়ে কেন্ডালের ‘শেক্সপিয়ারিয়ানা’ নাট্যপ্রযোজনায় ‘ম্যাকবেথ’, ‘হ্যামলেট’ ও ‘জুলিয়াস সিজার’ নাটকে উৎপলের অভিনয় ‘দ্য স্টেটসম্যান’–এর নাট্যসমালোচকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।
১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে কেন্ডালরা দেশে ফিরে গেলেন। জেফ্রি কেন্ডালকে গুরুরূপে বরণ করে তাঁর ‘শেক্সপিয়ারিয়ানা’ থিয়েটার দলের সুশৃঙ্খল সৈনিকের জীবন বেছে নিলেও উৎপল তাঁর নিজস্ব নাট্যদল ‘দি অ্যামেচার শেক্সপিয়ারিয়ানা’ বন্ধ করে দেননি। এই দলের ‘ওথেলো’ নাট্যাভিনয় দেখে ১৯৪৮ সালের ৫ জুলাই ‘দ্য স্টেটসম্যান’–এর নাট্যসমালোচক লেখেন,
“It was Utpal Dutta’s ‘Othello’ who dominated the play. Had Mr. Geoffrey Kendal of the ‘Shekespeareana’ been there last night he would have warmed his acting.”
কেন্ডালরা ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার পর ১৯৪৯ সালে উৎপলের নেতৃত্বে ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’ বা এলটিজি–র জন্ম হয়। ১৯৫১ সালে উৎপল ‘ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘে’ যোগ দেন। কিন্তু দশ মাস উৎপলের ভাষায় ‘জনতার মুখরিত সখ্যে’ থাকার পর প্রবল রাজনৈতিক বিতর্কে জর্জরিত হয়ে সঙ্ঘ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন।
১৯৫৩–৫৪ সালে জেফ্রি কেন্ডাল তাঁর থিয়েটার দল নিয়ে আবার ভারত সফরে এলেন। উৎপল গুরুর ডাকে সাড়া দিয়ে ভ্রাম্যমাণ শিল্পীদলের শরিক হন। নিজের নাট্যদল লিটল থিয়েটার গ্রুপ থেকে ছুটি নিয়ে উৎপল কেন্ডালের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। জেফ্রি কেন্ডালের দলে থাকার সময় তাঁর বড় মেয়ে জেনিফারের সঙ্গে উৎপলের গভীর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জেফ্রি কেন্ডাল তাঁর প্রিয়তম ছাত্র উৎপল দত্তকে নিজের সুযোগ্য উত্তরাধিকারী বলে মনে করতেন। উৎপলের প্রতি কেন্ডালের এই দুর্বলতা ও অনুরাগ আমৃত্যু অটুট ছিল। তাই কেন্ডাল দম্পতি উৎপলের সঙ্গে জেনিফারের এই প্রণয় নিয়ে খুবই সন্তুষ্ট ছিলেন।
উৎপলের মেজদা ব্রিগেডিয়ার মিহিররঞ্জন দত্ত ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ অফিসার। তিনি কর্মসূত্রে স্বাধীন ভারতের বিভিন্ন শৈলশহরে বসবাস করেন। তিনি যখন দেরাদুনে ছিলেন, তখন জেফ্রি কেন্ডাল সপরিবার তাঁর থিয়েটার দল নিয়ে সেখানে এলে খুবই হইচই হয়েছিল। অগ্রজ মিহিররঞ্জনের আন্তরিক আতিথ্যে কেন্ডাল–সহ দলের অন্য কলাকুশলীরা প্রায়শই পানভোজনে মিলিত হয়ে মেতে উঠতেন। এরপর মিহিররঞ্জন সিমলায় বদলি হন। কেন্ডাল তাঁর নাট্যদল নিয়ে সিমলায় অভিনয় করতে এলে আবার মিহিররঞ্জনের সঙ্গে দেখা হয়। সেই সময় একদিন মিহিররঞ্জন ছোট ভাই উৎপলকে সিমলার একটি বিখ্যাত রেস্তোরাঁতে আমন্ত্রণ জানান। উৎপল তাঁর প্রেমিকা কেন্ডালকন্যা জেনিফারকে নিয়ে সেখানে হাজির হন। মিহিররঞ্জন প্রেমিকা–সহ ছোট ভাইকে সাদরে আপ্যায়ন করেছিলেন। অর্থাৎ দুই পরিবারের মধ্যে এই প্রেমের সম্পর্ক স্বীকৃত ছিল। সে বড় রমণীয় স্বপ্নের সন্ধ্যা।
১৯৯৩ সালে উৎপল প্রয়াত হওয়ার পর দিল্লিতে তাঁর মেজদা অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার ব্রিগেডিয়ার মিহিররঞ্জনের সঙ্গে দেখা করতে যান শোভা সেন। সেই সময় মিহিররঞ্জন শোভা সেনকে সিমলার সেই ঘটনার প্রেক্ষিতে বলেন, ”ওদের তখন প্রেম চলছিল। উৎপল জেনিফারকে ভালবাসত।” এমন–কি বলেন, “জেনিফারের অনেক চিঠিই মার কাছে ছিল।” তখন শ্রীমতী সেনের উত্তর ছিল, “সে সব কথা আমি সবই জানি। সেই সমস্ত চিঠিও আমি দেখেছি।” অবশ্যই জেনিফারের সেই সব যৌবনের প্রেমপত্র তাঁর প্রেমিক উৎপলকে লেখা।
কিন্তু জেনিফার বা উৎপলের লেখা সেই সব মহামূল্যবান প্রেমপত্র এখনও অনাবিষ্কৃত থাকায় তা সাধারণ পাঠক, নাট্যগবেষক এবং ইতিহাসের ছাত্রদের কাছে অধরাই থেকে গেছে। উৎপলের মতো একজন ভারতবিখ্যাত সৃজনশীল ব্যক্তিত্বের একান্ত ব্যক্তিগত আবেগ বা অনুভূতির রোমান্টিক জগতের দরজা কেন ভাবীকালের গবেষকদের কাছে বন্ধ হয়ে থাকবে? কেনই বা তাঁর সমৃদ্ধশালী ব্যক্তিজীবনের বহু জটিল, রহস্যময় ও একক মুহূর্তের ছবি এখনও ধূসর অন্ধকারে আবৃত?
একই ঘটনা ঘটেছে বিশ্ববরেণ্য সত্যজিৎ রায়ের জীবনেও। শান্তিনিকেতনের ছাত্র অবস্থায় সত্যজিতের লেখা অগণিত প্রেমপত্র বিজয়াকে বাড়ির ভয়ে নষ্ট করে ফেলতে হয়েছিল। কেউ যদি দেখে ফেলে এই আশঙ্কায় সত্যজিতের চিঠি পড়ে তিনি ছিঁড়ে ফেলতেন। এর ফলে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।
সত্যজিৎ–গবেষক এবং দেশের শিল্পের ইতিহাস রচয়িতাদের হাত থেকে একটি হীরকখনি ফসকে গেল। কারণ এরমধ্যে সাত রাজার ধন অন্য এক মানিক আবিষ্কৃত হতেন। বিজয়া রায় নিজেও পরবর্তী সময়ে এর জন্য বেদনাহত হয়েছিলেন।
আমরা জানি, গুরুকন্যা জেনিফার কেন্ডালের সঙ্গে উৎপলের প্রথম যৌবনের সেই উদ্দাম, ভরাপ্রেম স্থায়ী হয়নি। এই বন্ধন ছিন্ন হওয়ার সঠিক কারণ জানি না। কিন্তু উৎপলের মনে এই প্রণয়বিচ্ছেদের তীব্র যন্ত্রণা ও দহনের জ্বালা গভীর ছাপ রেখে যায়। এমন–কি জেনিফারের সঙ্গে উৎপলের প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার এক দশক পরেও সেই প্রবল ক্ষত শুকিয়ে যায়নি। মোটামুটি ১৯৫৫ সালের পর উৎপলের সঙ্গে জেনিফারের কোনও সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু ১৯৬৫–৬৬ সালে সাত মাস প্রেসিডেন্সি জেলের বন্দিজীবনে উৎপল চারটি অনবদ্য ইংরেজি কবিতা লিখেছিলেন— সেটা আগেই বলেছি। এরমধ্যে একটি অপ্রকাশিত কবিতায় ফুটে উঠেছে মুছে যাওয়া পুরোনো প্রেমের স্মৃতিতে তিক্ত, ক্রুদ্ধ, যন্ত্রণাময় ছবি। কিন্তু কেন উৎপলের হৃদয়বিদারক রক্তাক্ত সেই কালজয়ী কবিতাটি এখনও অপ্রকাশিত? কেনই বা কবিতাপ্রেমী, নাট্যমোদী উৎপলচর্চার তন্নিষ্ঠ পাঠককুল এই সৃষ্টি থেকে বঞ্চিত? এলটিপি পর্বের প্রথম যুগে উৎপলের নাট্যসহযোগী অভিনেতা সমরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণেও এই প্রসঙ্গ এসেছে। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি এক রাতের বর্ণনায় এই সহ–অভিনেতা লিখেছেন, ‘এক রাতে তিনি হাপুস নয়নে কেঁদেছেন। নিজ গুরুকন্যার প্রতি প্রণয়ের ব্যর্থতা তাঁকে তীব্র জ্বালায় জ্বালিয়ে দিয়েছে। অশ্রুপাতে উচ্চকণ্ঠে নাম উচ্চারণ করে জ্বালা জুড়োতে চেয়েছেন।’ এই মর্মবিদারী বিষণ্ণ বিবরণে এক সংবেদনশীল, ক্ষতবিক্ষত প্রেমিক উৎপলকে খুঁজে পাওয়া যায়।
উৎপলের সঙ্গে জেনিফারের প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পরেও গত শতকের ষাটের দশকের গোড়ায় দুজনে একসঙ্গে উত্তম–সুচিত্রা জুটির চিরন্তন প্রেমের ছবি ‘সপ্তপদী’তে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই চলচ্চিত্রে ওথেলো ও ডেসডিমোনার চরিত্রে নেপথ্যশিল্পীরূপে উৎপল ও জেনিফারের অমরসৃষ্টি আমাদের মনে চিরভাস্বর। তার পরেও মার্চেন্ট আইভরি সংস্থার প্রযোজনায় ১৯৭০ সালে ‘বোম্বে টকিজ’ ছবিতে উৎপলের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন জেনিফার কেন্ডাল (কাপুর), অপর্ণা সেন ও শশী কাপুর। ইতিমধ্যে ১৯৫৮ সালে জেনিফার বিয়ে করেছিলেন হিন্দি চলচ্চিত্রের অভিনেতা শশী কাপুরকে।
উৎপলের প্রথম যৌবনের প্রেমিকা, দুর্দান্ত অভিনেত্রী গুরুকন্যা জেনিফারকে নিয়ে পরিণত বয়সেও কি তাঁর মনে আপশোসের কালো মেঘ জমেছিল? কারণ শশী কাপুরের ঘরনি হওয়ার পর জেনিফার মঞ্চের অভিনয় ছেড়ে দেন। এই ক্ষমতাশালী অভিনেত্রী জেনিফারের শিল্পীসত্তা অকালে স্তব্ধ হয়ে যাওয়ায় ১৯৭৭ সালের ‘লিটল থিয়েটার ও আমি’ শীর্ষক দীর্ঘ প্রবন্ধেও উৎপলের বিষণ্ণতা ও হতাশার কথা শোনা গেছে। জেনিফারের প্রতিভার বিকাশ না হতে পারায় উৎপলের চরম আশাভঙ্গের যন্ত্রণা খুব স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে। তারপর বহমান জীবনের প্রবল স্রোতের মধ্যে তাঁর চেতন ও অবচেতনে মণিমুক্তোর মতো অন্য কিছু কবিতায় উঠে এসেছে সেই ব্যর্থ প্রেমের তীব্র দহন ও বেদনার স্মৃতি। বাংলায় লেখা উৎপলের সেই কবিতা তাঁর কাব্যসঙ্কলনে স্থান পেয়েছে।
উৎপল রচিত ‘একটি ইংরেজি গান’ কবিতায় আবেগে কম্পমান, অনুভূতিপ্রবণ, স্বপ্নদ্রষ্টা প্রেমিক উৎপলকে আবিষ্কার করা যায়। পুরোনো প্রেমের স্মৃতিতে গভীর বিষাদের সুর বাজে নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত কবিমনে। তিনি লেখেন,
“একদিন শেক্সপিয়ারের নাটকে
অভিনয়কালে তুমি তাকিয়েছিলে আমার দিকে,
চারটে চোখ চুম্বনে রুদ্ধ,
পেটের মধ্যে প্রজাপতির পাখার ঝাপট (তোমার ভাষায়)
আর দুজনে পার্ট বলে গেলাম
স্রেফ অভ্যাসের বশে
সেইসব চাওয়ারা আবার প্রাণ পায়,
আবার প্রজাপতির পাখা ঝাপটায়
যখন শুনি অজ্ঞাত ইংরেজ কবির গান—
‘সবুজ আস্তিন’।”
তখন কবিমনের অবচেতন থেকে উঠে আসে প্রজাপতির মায়াবী রঙের এক রোমান্টিক স্বপ্নের জগৎ, চুরমার হয়ে গিয়েও যা স্মৃতির কুয়াশার চাদরে বিবর্ণ হয়ে যায়নি।
এই কবিতায় প্রাচীন ইংরেজি গানের রূপকথার গল্প ব্যাখ্যা করেন কবি উৎপল। সেখানে আছে ‘সবুজ হাতা’ পোশাকে সজ্জিত এক ‘নাম না জানা প্রিয়া’, তার প্রেমিককে অস্বীকার করে দ্বার রুদ্ধ করেছিল। সেই প্রত্যাখ্যানের বেদনায় গানটি হয়ে ওঠে মর্মভেদী। এই অজ্ঞাত ইংরেজি কবিতার বিরহের সঙ্গীত যেন এক সর্বকালীন রিক্ত ও ক্ষতবিক্ষত প্রেমের শাশ্বত উপকথা। কবি উৎপল লিখেছেন,
“আর যত কলহ তোমাতে আমাতে
অভিমান আর হিংস্র অপমান,
নখরে দন্তে আরণ্যক যুদ্ধ,
সব এসে ভিড় করে স্মৃতির টিকিটঘরে,
কেননা তুমিও তো দ্বার রুদ্ধ করেছিলে
আমার মুখের ওপরে।”
কবিতাটি পড়ে কি মনে হয় না যে, দিনের আলোর দাবদাহের মধ্যে রাতের তারারা এখনও ঝলমল করে? কিংবা রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘প্রেমের দুঃখ থাকে সমস্ত জীবন’। পুরোনো ব্যর্থ প্রেম কি গুনিনের হাত ফসকানো গোখরো সাপের মতো ফিরে ফিরে দংশন করছে কবিকে? জানি না। তবে এই কবিতার মানসপ্রতিমা যে কবির প্রথম যৌবনের প্রেমিকা বিদেশিনী অভিনেত্রী জেনিফার কেন্ডাল, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তাই এই কবিতায় উৎপল লিখেছেন,
“আমার কাছে সে–গান মানে তুমি
আর তোমার সুদূর মাতৃভূমি।
ধূসর সে গানে কুয়াশা আর বরিষন
যেন তোমায় জড়িয়ে ধরে গভীর আদরে,
ঈর্ষায় আমি মরি জ্বলে।”
আর এসব কারণেই সময়ে সময়ে তিনি হয়ে উঠেছেন অনিবার্য।
১৯৯৩ সালের ১৯শে আগস্ট ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে মাত্র ৬৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। উৎপল দত্ত উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের ও মঞ্চের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁর সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে।
(তথ্যসূত্র:
১- উৎপল দত্ত: রাজনীতি ও থিয়েটার, বাবলু ভট্টাচার্য, শুদ্ধস্বর (২০১২)।
২- উৎপল দত্ত, বিশ্বজিৎ পাণ্ডা, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ (২০১৬)।
৩- গদ্য সংগ্রহ, উৎপল দত্ত, দে’জ পাবলিশিং।
৪- টুওয়ার্ডস আ রেভলিউশনারি থিয়েটার, উৎপল দত্ত, নাট্যচিন্তা ফাউন্ডেশন (২০১৩)।
৫- আজকাল পত্রিকা, ২৫শে মার্চ ২০১৮ সাল।
৬- বর্তমান পত্রিকা, ৫ই আগস্ট ২০১৯ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত